জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় ফেনীর ১৪৩টি মন্দিরের আংশিক ক্ষতি হয়েছে।
Published : 09 Oct 2024, 09:11 AM
ফেনী শহরের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী জয় কালীবাড়ি মন্দিরের দুর্গাপূজা সবসময়ই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে আগ্রহের। এখানকার প্রতিমা ও আলোকসজ্জার একটা আলাদা জৌলুস থাকে; যা সব মানুষকে আকর্ষণ করে।
বড় পরিসরের হওয়ায় জয় কালীবাড়ি মন্দিরে শুধু সেখানকার প্রতিমাই গড়া হত না; আশপাশের আরও কয়েকটি মন্দিরের প্রতিমাও এখানে তৈরি করতেন শিল্পীরা।
কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় মন্দিরে পানি উঠে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে পানি থাকার কারণে প্রতিমা তৈরির উপকরণের সংকটও দেখা যায়। ফলে এবার আর সেই মন্দিরে প্রতিমাই তৈরি করা যায়নি।
জয় কালীবাড়ি মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী তপন কুমার দাস বলছিলেন, “বন্যা পরবর্তী সময়ে খড়, মাটি ও অন্যান্য উপকরণের সংকট থাকায় এবার দুর্গা প্রতিমা চট্টগ্রাম থেকে তৈরি করে আনতে হয়েছে।”
বিগত বছর প্রায় আট লাখ টাকা খরচ করে দুর্গাপূজা করা হলেও এবার বন্যা পরিস্থিতির কথা বিবেচনায় নিয়ে এবং অর্থ সংকটের কারণে পূজার খরচ তিন লাখ টাকায় নামিয়ে আনতে হয়েছে বলে জানান তপন কুমার।
একই অবস্থা শহরের বাঁশপাড়া দুর্গা মন্দিরের। বিগত সময়ে শহরের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ পূজা হয়েছে এখানে। পূজা শুরুর আগ থেকেই এখানে মানুজন আসতেন আলোকসজ্জা দেখা আর ঢাকের বাদ্য শোনার জন্য।
কিন্তু পঞ্চমীর বিকালেও সেই মন্দির ছিল অনেকটাই নিষ্প্রাণ। বন্যায় সময় মন্দির ছিল পানির নিচে। এক মাসের জঞ্জাল সরিয়ে কোনো মতে পূজার আয়োজন করা হচ্ছে বলে জানালেন আয়োজকরা।
বাঁশপাড়া দুর্গা মন্দিরের সভাপতি হরিপদ সাহা মঙ্গলবার বিকালে বলছিলেন, “আগের বছরগুলোতে পূজার খরচ ছিল ১১ থেকে ১২ লাখ টাকা। এবার তিন-চার লাখে সারতে হবে।”
বন্যায় ১৪৩টি মন্দিরের ক্ষতি
উজানের পাহাড়ি ঢল আর অতি ভারি বৃষ্টির কারণে ২১ অগাস্ট সকাল থেকে ফেনীতে ভয়াবহ বন্যা শুরু হয়। সীমান্তবর্তী পরশুরাম ও ফুলগাজীতে মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের অর্ধশতাধিক স্থানে ভাঙন ধরে প্রায় ১০ ফুট পানিতে প্লাবিত হয় জেলার ছয় উপজেলা। ঘরে আটকা পড়েন কয়েক লাখ মানুষ। বের হতে না পারায় ঘরেই মারা যান কয়েকজন।
বন্যায় জেলার ছয় উপজেলায় প্রাণহানি হয়েছে ২৯ জনের। বন্যার ভয়াবহতা এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, নিহত অনেককে কবর দেওয়ার মাটি পাওয়া যায়নি। চিরকুট লিখে কিছু মরদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল কলাগাছের ভেলায়।
প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ফেনীতে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে দিনযাপন করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হন ১১ লাখ মানুষ। ক্ষতির কবলে পড়ে বাড়ি-ঘর, কৃষিজমি, পুকুর-খামার, গবাদিপশু।
সেই বন্যার রেশ এখনও কাটেনি। অনেকে এখনও ঘরবাড়ি ঠিক করতে পারেননি। বন্যা গেলেও মানুষের এখন চলছে টিকে থাকার লড়াই।
এই অবস্থার মধ্যেই জেলার ১৪৬টি মন্দিরে দুর্গা পূজা হচ্ছে। গতবারের চেয়ে দুটি বেশি মন্দিরে পূজা হচ্ছে বলে জানালেন ফেনী জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হীরালাল চক্রবর্তী।
এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৪৭টি পূজার মধ্যে পৌর এলাকায় পড়েছে ১২টি। এখানে গত বছরের চেয়ে দুটি মন্দিরে বেশি পূজা হচ্ছে। এ ছাড়া ফুলগাজী উপজেলায় ৩৩টি, সোনাগাজীতে ২৩টি, দাগনভূঞায় ১৯টি, পরশুরামে সাতটি এবং ছাগলনাইয়ায় পাঁচটি মন্দিরে পূজা উদযাপিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মোসাম্মদ শাহীনা আক্তার বলেন, “গেল বন্যায় ফেনীর ছাগলনাইয়ায় একটি মন্দির সম্পূর্ণ ক্ষতি হয়েছিল। এ ছাড়া জেলার ১৪৩টি মন্দির আংশিক ক্ষতি হয়েছিল। জেলায় দুর্গাপূজায় ১৪৬টি মন্দিরের জন্য সাড়ে ১২ মণ করে চাউল বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে।”
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বোধন পূজার মাধ্যমে শারদীয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে জানিয়ে ফেনী পৌর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সমর দেবনাথ বলেন, ৯ অক্টোবর মহাষষ্ঠী, ১০ অক্টোবর মহাসপ্তমী, ১১ অক্টোবর মহা অষ্টমী, ১২ অক্টোবর মহানবমী এবং ১৩ অক্টোবর দশমী শেষে ঘাটে প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে পূজার পরিসমাপ্তি ঘটবে।
জয় কালীবাড়ি মন্দির, জগৎনাথ বাড়ি মন্দির, গুরুচক্র মন্দির, বাঁশপাড়া দুর্গা মন্দির, দক্ষিণ সহদেবপুর সার্বজনীন পূজা মন্দিরসহ বেশ কয়েকটি জায়গা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ মণ্ডপের প্রতিমাই এবার বাইরে থেকে তৈরি করে আনা হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যেই অধিকাংশ প্রতিমার বস্ত্র পরিধানের কাজও শেষ হয়েছে। তবে অন্যান্য বছর যেমন মন্দিরে দৃষ্টিনন্দন ফটক, বর্ণিল আলোকসজ্জা, বাদ্যের ঘটা থাকে এবার অনেকটাই সাদামাটা।
কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এর কারণ মূলত দীর্ঘস্থায়ী বন্যার জের এবং রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর নানা অনিশ্চয়তা।
তবে প্রতিটি মন্দির ঘিরেই আনসার, পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা দেখা গেছে।
সোনাগাজী উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সমর দাস বলেন, “বিগত বছরের তুলনায় এবার পূজায় জৌলুস কিছুটা কমেছে। এর মধ্যেও উপজেলার নয়টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ২৩টি মণ্ডপে দুর্গা পূজা হচ্ছে।
“তবে কয়েকটি মন্দিরের সড়ক কাঁচা হওয়ায় বৃষ্টিতে চলা কষ্টকর হয়ে পড়ে। প্রতিবারই প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে আশ্বস্ত করা হলেও পূজা মণ্ডপের যাতায়াতের সব সড়ক সংস্কার করা হয়নি।”
প্রতিমাশিল্পী কানাই পাল বলেন, এবার বন্যার কারণে প্রতিমা তৈরির খড়, মাটি, কাঠসহ বিভিন্ন সরঞ্জামের সংকটের মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। এবার তার দলের ১৬টি প্রতিমা তৈরির কথা থাকলেও সময় ও লোকবল সংকটের কারণে দুটি মন্দিরের কাজ করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এবার তাদের লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছে।
ভয়াবহ বন্যার কারণে হিন্দু ব্যবসায়ীরা ব্যাপক অর্থ সংকটের মধ্যে পড়েছেন। প্রতিবার পূজার আগে চাঁদা সংগ্রহ করা হলেও এবার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তা করা যায়নি বলে জানান ফেনী জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সহদেব চন্দ্র দাস।
তিনি আরও বলেন, অপরদিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে জনপ্রতিনিধি না থাকায় তাদের তরফ থেকে কোনো অনুদানও পাওয়া যায়নি। এতে করে এবার অনেকটা নিরানন্দে পূজা উদযাপিত হচ্ছে।
আনন্দ নেই দরিদ্র পরিবারে
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত করতেই হিমশিম খাচ্ছেন দরিদ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। সেখানে পূজার আনন্দ তাদের কাছে অনেকটা অধরাই থেকে যাচ্ছে।
পূজা মানেই, পরিবারের সবার জন্য অন্তত একটি নতুন কাপড়। সেটাও কেনার সামর্থ হচ্ছে না অনেকের। ফলে দরিদ্র এলাকায় পূজার জৌলুস যেমন কমে গেছে; ঠিক তেমনি আনন্দও কমেছে।
ফেনী শহরের উত্তর সহদেবপুর এলাকার বাসিন্দা কণিকা রানী সরকার বলছিলেন, এবারের বন্যায় তাদের ঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঘরের খাট, তোষক, বালিশ সব পানিতে ভেসে গেছে, কিছুই নেই। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার স্বামী। তিনিও বন্যার পর কাজ হারিয়ে এখন বেকার।
বলছিলেন, “এখন তো কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। ঘরের আসবাবপত্র ঠিক করব নাকি দুইবেলা খাব সেটা নিয়েই হিমশিম খাচ্ছি। এবার আমাদের পূজার কোনো আয়োজন নেই, আমেজও নেই।”
একই এলাকার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রিক চন্দ্র দে বলছিল, প্রতিবার পূজার সময় বাবা-মা তাকে নতুন জামা-কাপড় কিনে দেয়। কিন্তু এবার সে জামা পায়নি। তার ছোট বোন আনুষ্কাও পায়নি। বন্যায় তাদের বই-খাতাও ভিজে গেছে। তাদের মন ভাল নেই।
সদর উপজেলার কালিদহ ইউনিয়নের চেওরিয়া এলাকার বাসিন্দা রাজিব দাস বাবলু বলেন, “বন্যা পরবর্তীতে পূজায় এবার আগের মত আনন্দ-উচ্ছ্বাস নেই। বাচ্চাদের জন্য নতুন জামাও কেনা হচ্ছে না। অনেকটা নিরানন্দে কাটবে দুর্গাপূজা।”
ফুলগাজী পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জয় মজুমদার বলেন, “সরকারি চাউল বরাদ্ধ ছাড়া তেমন কোনো সহায়তা এবার মেলেনি। বিগত বছরের তুলনায় কিছুটা জৌলুস কমেছে এবারের পূজায়।”
জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি শুকদেব নাথ তপন জানান, বন্যা পরবর্তীতে ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে দুর্গাপূজায় ব্যয় সংকোচন করতে হয়েছে। প্রতিটি পূজা মন্দিরের জন্য সরকারিভাবে ৫০০ কেজি করে চাউল বরাদ্দ করা হয়েছে।
এ ছাড়া পৌরসভা ও পাশের ১৬টি মন্দিরে ১৬ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছেন পৌর প্রশাসক গোলাম মোহাম্মদ বাতেন। অপরদিকে জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে ১৪৬টি মন্দিরে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
শুকদেব নাথ তপন বলেন, “প্রতিটি পূজা মণ্ডপে আনসার সদস্যের পাশাপাশি পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। তাদের সঙ্গে সেনাবাহিনী মাঠে তৎপর থাকলে নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে পূজা উদযাপন করা যাবে।”
ফেনীর পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান জানান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রেখে সরকারি সব নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গোৎসব উদযাপন করতে পূজা উদযাপন পরিষদ নেতাদের অনুরোধ করা হয়েছে। মন্দিরের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে তাদের বলা হয়েছে।