এ ঘটনায় দুপুর সাড়ে ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন উপাচার্য।
Published : 12 Jan 2025, 08:50 PM
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক পাঁচটি হলে কোরআনের পোড়া কপি পাওয়া গেছে। এ নিয়ে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
পরে ঘটনাটি তদন্তে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মোহা. ফরিদ উদ্দিন খানকে আহ্বায়ক করে নয় সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাদেরকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ আমীর আলী হলের মাঝে মুক্তমঞ্চে, শহীদ হবিবুর রহমান, শহীদ জিয়াউর রহমান হলের মসজিদের তাকে এবং মতিহার ও মাদার বখশ হলের ছাদে পোড়া কোরআন শরিফের কপি পাওয়া যায়।
এ ঘটনায় দুপুর সাড়ে ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব। তিনি বলেন, “এ ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক তাদের শনাক্ত করতে পারলে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। আমরা এরই মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। এ ঘটনায় অপরাধীদের ছাড় দেওয়া হবে না।”
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
এদিকে পোড়া কোরআন শরিফ পাওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। বিকালে প্রশাসন ভবনের সামনে থেকে তারা বিক্ষোভ মিছিল বের করে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন। পরে তারা সিনেট ভবনের সামনে প্যারিস রোডে সমাবেশ করে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত খুঁজে বের করে শাস্তির দাবি জানান।
এ সময় শিক্ষার্থীদের ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’, ‘আল-কোরআনের অপমান, সইবে নারে মুসলমান’, ‘অ্যাকশন টু অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশান’, ‘ইসকনের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশান’, ‘দালালের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশান’সহ নানা স্লোগান দিতে দেখা যায়।
প্রতিবাদ সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষার্থী মুজাহিদ ফয়সাল বলেন, “এখানে এসে জানতে পারলাম, আরও তিনদিন আগেও নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে এরকম ঘটনা ঘটেছিল। আপনারা গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখবেন, গত ৫ তারিখের পরে যারা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে, তারাই এই কাজ করেছে। এখানে দাঁড়িয়ে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিলাম, এর ভিতরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে।”
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসুদ বলেন, “সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে এখানে এসেছি। প্রত্যেক ধর্মের মানুষই এমন ঘটনায় মর্মাহত হবেন৷ পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে আমাদের অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো রামুর সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷ আমরা আর কোনো দাঙ্গা চাই না, হতে দেব না। এ ঘটনায় দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে বিচার হোক সেটাই চাই।”
এ সময় প্রতিবাদ সমাবেশে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
শিহাব খান নামে শহীদ জিয়াউর রহমান হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, “আজ আমাদের শহীদ জিয়াউর রহমান হলের মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করার পর প্রতিদিনের মতো আমরা কোরআন তেলাওয়াত করতে গিয়ে দেখি, দুটি কোরআন শরিফের প্রথম দিকের দুটি সুরা এবং শেষের দিকের দুটির সুরা পুড়িয়ে বুক সেলফে রাখা হয়েছে।
“এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, দুটি কোরআন শরিফের হার্ড কভারসহ প্রথম ও শেষের কিছু পৃষ্ঠা এবং মাঝখানের ৭০ শতাংশ পৃষ্ঠা অক্ষত রয়েছে, এতে করে এটা নিশ্চিত যে কোরআন শরিফগুলো কোনোভাবে কয়েল বা অন্য কোনো আগুনে পুড়েনি।”
তিনি বলেন, “তার মানে, এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা না। কোনো এক গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বড় কোনো উদ্দেশ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য পরিকল্পিতভাবে কাজটি করেছে। বিষয়টা অনেক হৃদয়বিদারক।”
শিক্ষার্থীরা জানান, সৈয়দ আমীর আলী হলে একটি কোরআনের প্রথম দুই-তিন প্যারার মত পুড়িয়ে হলের মুক্তমঞ্চে রাখা ছিল। সকালে সেটা দেখতে পান তারা।
সৈয়দ আমীর আলী হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ফিরোজ আহমেদ বলেন, “এখানে আমরা দেখি কোরআনের প্রথম দুই-তিন প্যারার মত পোড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে জিয়া হলে দুইটা কোরআন পুড়ানো হয়েছে, সেটারও প্রথম দুই-তিন প্যারা। মনে হচ্ছে, এটি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে। অন্য কোনো একটা দল আমাদের মাঝে দাঙ্গা বাঁধানো বা ফ্যাসাদ তৈরি করার চেষ্টা করছে। তদন্ত সাপেক্ষে এটার সঙ্গে যেই জড়িত হোক তা উদঘাটন হোক এবং তাদের যথাযথভাবে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হোক।”
দুপুর ১২টার দিকে শহীদ জিয়াউর রহমান ও সৈয়দ আমীর আলী হলে পোড়া কোরআন পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে ক্যাম্পাসে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এর কিছুসময় পর শোনা যায় শহীদ হবিবুর রহমান ও মতিহার হলেও পোড়া কোরআন পাওয়া গেছে।
ওই দুই হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানান, অন্যান্য হলে পোড়া কোরআন পাওয়ার খবর শুনে শহীদ হবিবুর রহমান হলের মসজিদের বুক সেলফে খোঁজ নিতে যান মসজিদের খাদেম মজিবুল ইসলাম। সেখান থেকে তিনি একটি পোড়ানো কোরআন উদ্ধার করেন। তবে, কোরআনটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়নি।
অন্যদিকে মতিহার হলের প্রথম ব্লকের ছাদে কাগজের ছাই দেখতে পান শিক্ষার্থীরা। ছাইয়ের পাশেই কোরআন শরিফের কয়েকটি ছেঁড়া পাতা পড়েছিল।
‘এটা উসকানি ও গভীর ষড়যন্ত্র’
বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ছাত্র-ছাত্রী ও কর্মচারী-কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, “এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্য যা কিছু করা লাগে আমরা করব। এটা একটি উসকানি ও গভীর ষড়যন্ত্র। আমরা এই ষড়যন্ত্রে পা না দিয়ে এর জঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে চাই। ঘটনাটা পূর্বপরিকল্পিতভাবে ঘটনা হয়েছে, যা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। এ ঘটনায় দোষীদের খুব দ্রুত খুঁজে বের করা হবে।”
সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, “এ ঘটনায় আবাসিক হলের প্রাধ্যক্ষরা নিজ নিজ জায়গা থেকে থানায় অভিযোগ দেবেন। একই গোষ্ঠী সম্ভবত একই সময়ে রাতের আঁধারে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট, তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে ইতিহাস আছে, সেই জায়গা থেকে আমাদের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের আবেগ–অনুভূতিতে আঘাত হেনে সেই সম্প্রীতির জায়গাটা বিনষ্ট করার চেষ্টা করছে।”
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, “ঘটনাটা পূর্বপরিকল্পিত মনে হচ্ছে। চারটি হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার প্যাটার্নও একই রকম। একইভাবে পবিত্র কোরআন শরিফে আগুন দেওয়া হয়েছে। এটা অত্যন্ত নিচু প্রকৃতির ন্যাক্কারজনক কাজ।”
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে উপাচার্য বলেন, “আমার ছাত্রছাত্রীদের ধন্যবাদ দিতে চাই, তারা এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে সামনে রেখে অত্যন্ত ধৈর্য, সহশীলতা ও শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। এই ধরনের ঘটনা ঘটার পরেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সম্প্রীতি এবং যে সম্পর্ক, আমরা সেটাকে অটুট দেখতে পাচ্ছি। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এখনো ঘটেনি। যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা অত্যন্ত নিকৃষ্ট শ্রেণির মানুষ।
“তাদের একটি মাত্র উদ্দেশ্য, আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্প্রীতির জায়গাটা নষ্ট করা এবং একটা উসকানি ও হানাহানি তৈরি করা। এটাকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। এরই মধ্যে পুলিশ প্রশাসন এবং গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা জরুরি সভা করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫ হাজারের মতো পরিবারের সদস্য। বেশিরভাগই ছাত্রছাত্রী। তাদের মধ্যে যে সম্পর্ক, এটাকে যেন কারও উসকানি এবং খুব খারাপ ধরনের মানুষের ফাঁদে পা দিয়ে নষ্ট না করা হয়। আমরা এ ব্যাপারে বদ্ধপরিকর যে আমাদের ছেলেমেয়েরা শান্তিতে থাকবেন। তাদের ভেতরে ভালো সম্পর্ক থাকবে। কোনো নোংরা কাজে, যে ফাঁদ পাতা হয়েছে, সেখানে পা দেবে না।”
সংবাদ সম্মেলনে সহউপাচার্য (একাডেমিক) ফরিদ উদ্দিন খান, সহউপাচার্য (প্রশাসন) মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন, জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক আখতার হোসেন মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।
পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার পরামর্শ
এদিকে, পাঁচটি আবাসিক হলে কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেওয়া যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেকোনো সময় পরিচয়পত্র দেখতে চাইতে পারে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক আখতার হোসেন মজুমদার।
তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে রাবি ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের বিনা অনুমতিতে প্রবেশ ও অবস্থান নিষিদ্ধ করে দেওয়া পূর্বের নিষেধাজ্ঞা যথারীতি বহাল আছে।