এক দিন আগে জলঢাকা পৌরসভায় জয়ী মেয়রের সমর্থকদের সঙ্গে পরাজিত প্রার্থীর কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
Published : 01 May 2024, 11:44 PM
নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভায় পরাজিত মেয়র প্রার্থীর পক্ষে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সমাবেশের পর উপজেলা আওয়ামী লীগের দুপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন নেতাকর্মীরা।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায়পৌরসভার জিরো পয়েন্টে লাঠিসোঁটা হাতে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে নীলফামারী-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাদ্দাম হোসেন পাভেল সমাবেশ করেন। অপরদিকে নবনির্বাচিত মেয়রের পক্ষে সমাবেশ করে উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের একাংশ।
এর আগে দুপুরে উপজেলারবগুলাগাড়িধওলার মোড়েপৌরসভায় জয়ী মেয়রের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে পরাজিত মেয়র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে উভয়পক্ষের অন্তত আটজন আহত হয়েছে।
গত ২৮ এপ্রিল জলঢাকা পৌরসভার উপ-নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন প্রয়াত মেয়র ইলিয়াছ হোসেন বাবলুর ছেলে নাসিব সাদিক হোসেন নোভা। এতে পরাজিত হন সাবেক মেয়র ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি বহিষ্কৃত ফাহমিদ ফয়সাল চৌধুরী কমেট।
নির্বাচনের দুদিন পর মঙ্গলবার দুপুরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিবাদে জড়ান বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় জয়ী মেয়রের এক কর্মীকে আটক করে পুলিশ।
পরে দুপুর দেড়টার দিকে জলঢাকা পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক লাভলুর রশিদের নেতৃত্বে পরাজিত মেয়র প্রার্থীর কমেট চৌধুরীর কর্মী-সমর্থকরা শহরের পেট্রোল পাম্প মোড় এলাকায় সড়ক অবরোধ করে রাখে। এ সময় জলঢাকা-নীলফামারী ও জলঢাকা-রংপুর সড়কে প্রায় দুই ঘণ্টা যানচলাচল বন্ধ ছিল। অবরোধ চলাকালে কমেট চৌধুরীর ওপর হামলায় জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়।
পরে নীলফামারীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোস্তফা মঞ্জুর ও জলঢাকা থানার পরিদর্শক মুক্তারুল আলমের হস্তক্ষেপে অবরোধকারীদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তফা মঞ্জুর বলেন, “সাবেক মেয়রের ওপর হামলার প্রতিবাদে তার কর্মী-সমর্থকরা সড়ক অবরোধ করেন। ঘটনাটি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলে তারা অবরোধ তুলে নেন। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।”
বিজয়ী মেয়র নাসিব সাদিক হোসেন নোভার কর্মী ধওলার মোড় এলাকার মশিয়ার রহমান বলেন, “মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে এলাকার মাজেদুল ইসলামের কয়েকটি হাঁস ওই এলাকার জমির উদ্দিন ভাসার মাছচাষ প্রকল্পে যায়। এ নিয়ে জমির উদ্দিনের সঙ্গে মাজেদুলের কথা কাটাকাটি হয়।
“এক পর্যায়ে জমির উদ্দিন ও তার লোকজন কমেট চৌধুরীকে খবর দেয়। পরে লাঠিসোঁটা নিয়ে কমেটি চৌধুরী তার কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে আমাদের ওপর হামলা করে। এতে আমিসহ মহসেনা (২৮), আব্দুর রাজ্জাক (৪৫), মহসীন (৩০) আহত হন। এর মধ্যে গুরুতর মহসেনা ও মহসীনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।”
নবনির্বাচিত মেয়র নাসিব সাদিক হোসেন নোভা বলেন, “পরাজয় মেনে নিতে না পেরে কমেট চৌধুরী ও তার লোকজন আমার কর্মী সমর্থকদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও কর্মী-সমর্থকদের মারপিট করেছেন। ঘটনাটি শোনার পর পুলিশে জানাই।
“পরে নিজেকে বাঁচাতে কমেট চৌধুরী আহত হওয়ার ভান করেন। নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যা হামলার নাটক সাজিয়ে রংপুর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তিনি। তার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করা হয়েছে।”
এ বিষয়ে জানতে ফাহমিদ ফয়সাল চৌধুরী কমেটের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
ঘটনাটি দুই মেয়র প্রার্থীর হলেও তাদের পক্ষে-বিপক্ষে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে নীলফামারী-৩ আসনের সংসদ সদস্য এবং পৌর আওয়ামী লীগ।
নোভার কর্মী-সমর্থকদের হামলা ও বাড়িঘর ভাঙচুরের প্রতিবাদে বিকাল সাড়ে ৫টায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ট্রাফিক মোড় এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয় জলঢাকা পৌর আওয়ামী লীগ।
অপরদিকে পরাজিত সাবেক মেয়র কমেট চৌধুরীর পক্ষ নিয়ে একই সময়ে শহরের জিরো পয়েন্ট এলাকায় সমাবেশের ডাক দেন সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের নেতা সাদ্দাম হোসেন পাভেলের কর্মী-সমর্থকরা।
সন্ধ্যা ৬টায় সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে শহরের পেট্রোল পাম্প মোড় থেকে সহস্রাধিক কর্মী-সমর্থক লাঠিসোঁটা নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে জলঢাকা জিরো পয়েন্ট মোড়ে গিয়ে সমাবেশ করেন। সমাবেশে পরাজিত মেয়র প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগ ও পৌর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং নবনির্বাচিত মেয়র নাসিব সাদিককে হুঁশিয়ার করেন সংসদ সদস্য সাদ্দাম হোসেন।
সভায় সংসদ সদস্য সাদ্দাম হোসেন পাভেল বলেন, “কমেট চৌধুরী সাবেক মেয়র। দিনে দুপুরে তার গায়ে হাত দেওয়া হয়েছে, এটা আমরা কখনই মেনে নিতে পারি না। তিনি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। হামলাকারীদের মধ্যে একজনকে ধরেছে পুলিশ। বাকিদেরও ধরতে হবে।
“যদি কোনো চক্র (উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশে) আসামিদের ধরতে বাধা দেয় তবে সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। আমি এখানে ছোট থেকে বড় হয়েছি। সাবেক মেয়রের গায়ে হাত দেওয়ার আগে আমার লাশের ওপর দিয়ে যেতে হবে।”
পরে রাত ৮টায় শহরের বঙ্গবন্ধু চত্বর থেকে নবনির্বাচিত মেয়রের কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা ও বাড়িঘরে ভাঙচুরের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের করে পৌর আওয়ামী লীগ। পরে এক সমাবেশ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ, উপজেলা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতারা এতে বক্তব্য দেন।
সমাবেশে আব্দুল মজিদ দাবি করেন, “একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরাজিত মেয়র প্রার্থী কমেট চৌধুরী তার লোকজন নিয়ে নির্বাচিত মেয়রের কর্মী-সমর্থকদের বাড়িঘর ভাঙচুর এবং তাদের মারপিট করেন।
“সেটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা সাদ্দাম হোসেন পাভেল। তার কর্মকাণ্ডে আমরা হতভম্ব হয়েছি।”
জলঢাকা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে নীলফামারী-৩ আসনটি ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। তবে ভোটে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে হারিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যুবলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন পাভেল জয়ী হন।
“ওই নির্বাচনে ফাহমিদ ফয়সাল চৌধুরী কমেট তার কর্মী-সমর্থকদের সাদ্দাম হোসেন পাভেলের পক্ষে ভোট দেওয়াসহ নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে নির্দেশ দেন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে কমেট চৌধুরীর ‘ঋণ পরিশোধ’ করছেন তিনি। জলঢাকা পৌর সভার মেয়র পদের উপ-নির্বাচনে কমেট চৌধুরীকে জয়ী করতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন সাদ্দাম হোসেন পাভেল।”
তিনি বলেন, “আমরা উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নাসিব সাদিক হোসেন নোভার পক্ষে কাজ করেছি। এ জন্য সংসদ সদস্য সাদ্দাম হোসেন পাভেল আমাদের বিভিন্নভাবে হুমকিসহ গায়ের চামড়া তুলে নেওয়া হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন।”
জলঢাকা থানার পরিদর্শক মো. মুক্তারুল আলম বলেন, দুপক্ষই শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করেছে। সাবেক মেয়র কমেট চৌধুরীর ওপর হামলার ঘটনায় তার এক কর্মী মামলা করেছেন। এরই মধ্যে আব্দুর রাজ্জাক নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
অপরদিকে নবনির্বাচিত মেয়র নোভার কর্মী-সমর্থকদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও মারপিটের ঘটনায় একটি মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।