“সামনে আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, যদি অলৌকিক কিছু না ঘটে-তাহলে রক্ষা নাই। মানুষের তো ক্ষতি হবেই, গরু-ছাগল সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে,” বলেন সমরেন্দ্র কর্মকার।
Published : 16 May 2024, 01:38 AM
এ মৌসুমেই সবচেয়ে বেশি দিন ধরে দাবদাহ দেখেছে বাংলাদেশ, যদিও ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড এখনো ছুঁতে পারেনি। তবু সাত দশকের জীবদ্দশায় এমন গরম কখনো সইতে হয়নি রাজশাহীর মোস্তাফিজুর রহমানের।
রেকর্ড ভাঙা-গড়ার এ মৌসুমে ৩০ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল যশোরে, সেখানে থার্মোমিটারের পারদ ওঠে ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রা দেশের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ।
এর আগে ১৯৮৯ সালের ২১ এপ্রিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছিল বগুড়ায়। আর স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের নথিভুক্ত ইতিহাসের সর্বোচ্চ।
ওই বছরের গরমের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে রাজশাহীর আইনজীবী মোস্তাফিজুর বলেন, সেবছর মনে রাখার মত গরম তিনি অনুভব করেননি। স্মরণে রাখার মত গরম তিনি পেয়েছিলেন ১৯৭৯ সালে। সেবার রাজশাহী অঞ্চলে খরা হওয়ার ফলে দীর্ঘদিন বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়নি।
“তাও এবারের মত টানা গরম ছিল না, দু-তিন দিন টানা গেছে, আশেপাশে বৃষ্টি হত- সেটার একটু ঠান্ডা বাতাস আসত। এখন রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে গাছপালা সব কেটে ফেলছে, রাস্তার উত্তাপটা বেশি লাগে। এত লম্বা সময় ধরে উত্তপ্ত অবস্থা, সারা রাতেও দেয়াল ঠান্ডা হয় না। দেয়ালে হাত দিলে গরম অনুভব হয়।”
এ মৌসুমে রাজশাহীর সর্বোচ্চ ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় গত ৩০ এপ্রিল। ১৬ এপ্রিলের পর থেকে টানা দুই সপ্তাহ ৪০ ডিগ্রির উপরে তাপমাত্রা ছিল সেখানে।
রাজশাহীর এ বাসিন্দা বলেন, “খুব দরকার না হলে বাইরে বের হই না, মনে হচ্ছে হল্কা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। রাতে ১০টা পর্যন্ত এ বাতাসটা থাকছে। আগে সব বাড়ির সামনে পুকুর ছিল, সেগুলো সব ভরাট হয়ে যাচ্ছে, সব বাড়ির সামনে বাগান থাকত- এখন সব কমে দোকান হয়ে যাচ্ছে।”
গত ৩১ মার্চ থেকে টানা ৩৭ দিন ধরে দাবদাহ বয়ে গেছে দেশে; এর আগে কখনোই এতো সময় ধরে তাপপ্রবাহ দেখেনি বাংলাদেশ। মাঝে বৃষ্টিতে গরম কিছুটা কমলেও সপ্তাহখানেকের বিরতি দিয়ে আবার শুরু হয়েছে দাবদাহ।
আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ২০১৪ সালে ৫-৩০ এপ্রিল টানা ২৬ দিন টানা তাপপ্রবাহ ছিল। ২০১৬ সালে ৬-৩০ এপ্রিল টানা ২৫ দিন তাপপ্রবাহ ছিল। ২০২৩ সালে ১৩ এপ্রিল থেকে ৫ মে টানা ২৩ দিন তাপপ্রবাহ বয়ে যায়।
যশোর শহরের পালবাড়ি এলাকার ষাটোর্ধ্ব নাসরিন বেগম বলছিলেন, তার জীবদ্দশায় বৃষ্টিহীন এমন দীর্ঘ সময় তিনি কখনো দেখেননি।
অবশ্য আগে প্রচুর গাছপালা থাকায় সেখানে বিশ্রামের অবকাশ ছিল, সঙ্গে বইত ঠান্ডা বাতাস; ফলে ততটা কষ্ট হত না। এখন পরিস্থিতি বদলেছে।
নাসরিন বলছিলেন, “আমাদের ছোটবেলায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আইত, সব রেখে দৌড় দিতাম। পরিবেশটা ভালো ছিল, সে কারণে এমন গরম কখনো লাগেনি। কাদামাটি দিয়ে তখন খেলতাম। এখন গাছপালা নেই, রোদে মাথা চকবক চকবক করে ঘুরতে থাকে।”
নিস্তার নেই পাহাড়েও
২০২৩ সালের এপ্রিলে রাঙামাটির গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৫ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এবার রেকর্ড করা হয়েছে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রাঙামাটিতে এপ্রিল মাসের ‘স্বাভাবিক’ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার কথা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস; অথচ এবার এপ্রিলে টানা কয়েকদিন ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় সেখানে। পার্বত্য আরেক জেলা বান্দরবানের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রাঙামাটিতে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছাড়িয়ে যাবার নজির আগে থাকলেও এবারের মত লাগাতার ৩৭ ডিগ্রির উপরে তাপমাত্রা কখনো ছিল না। এই এপ্রিলের শুরুর দিকেও এলাকাটির তাপমাত্রা ৩৬, ৩৭ ডিগ্রিতেই ছিল।
তবে অন্যান্য বছরের উপাত্ত পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, গত ৩০ বছরের মধ্যে রাঙামাটিতে সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উঠেছিল ২০১৪ সালে; তবে কোনো বছর দীর্ঘ সময় ধরে ৩৭ ডিগ্রির ওপরে ওঠেনি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী নিকি মারমা তাদের বর্ষবরণ উৎসব সাংগ্রাইয়ের সময় থেকে এখন পর্যন্ত লম্বা ছুটিতে খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়িতে অবস্থান করছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, বর্তমানে সেখানে যেমন গরম পড়ছে, তেমনটা ৫ বছর আগেও দেখা যায়নি। তখন পঞ্জিকা উল্টে গরমকাল এলেও সেটা প্রকৃতিতে প্রকট হয়নি।
“এখন সহ্য করার মত না। যারা কাজ করে, তাদের অনেক কষ্ট হয়। হিটস্ট্রোকের ভয়ে সবাই কাজ করতে ভয় পায়। দেখা যায়, একটু কাজ করতেই হাঁপিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎও থাকে না এখানে, এ কারণে আরও অসহ্য অবস্থা।”
নিকি বলেন, গত ৫ বছর ধরে পাহাড়ে গাছ কেটে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সেগুনগাছ লাগানোর প্রবণতা বেড়েছে, যার ফলে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গরম।
“আগে এলাকাগুলোতে বড় বড় গাছ ছিল, গরম পড়লে কাজের ফাঁকে গাছের নিচে বসত। এখন উন্নয়নের নামে গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। যার ফলে যারা কাজ করে, তাদের গরমে জিরিয়ে নেওয়ার কোনো পথও নেই।”
রাঙামাটির লংগদু উপজেলার সীমান্ত প্রহরী আদর্শ বিদ্যালয়ের শিক্ষক রিমেল চাকমা বলেন, এক দশক আগেও এখানে এমন গরম পড়েনি। এবার বৃষ্টি না হওয়ায় গত ১১ এপ্রিল থেকে সেখানে খাবার পানির সংকট তৈরি হয়েছে।
“হয়ত তাপমাত্রা আগেও বেশি উঠত, কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ বাতাসের কারণে সেটা টের পেতাম না। কিন্তু এখন তো গাছ কম, সেই বাতাসও নাই। গরমের কারণে বাচ্চারা ক্লাসে আসতেছে না, ২০/৩০ ভাগ আসে। অভিভাবকরা পাঠাতে চায় না। একবারে বিদ্যুৎ থাকে না, তাই রুমে ঘুমানো যায় না।”
লংগদু এলাকার কৃষক রিকেন চাকমা বলেন, গত দুই-তিন বছর ধরে এখানে গরম বেড়েছে। তবে সাড়ে চার দশকের জীবনে এমন গরম কখনো পাননি তিনি।
“গরমে মানুষ অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে, বাচ্চারা কান্নাকাটি করে। কাজ করতে বাইরে যেতে পারছি না, বাড়িতে বসে আছি। বাড়ি থেকে বের হওয়া যায় না, এমন উত্তাপ। আমাদের ছোটবেলায় এমন গরম পড়েনি, এবারই প্রথম এমন।”
এবার এত গরম কেন?
চলতি মৌসুমে দেশে তাপপ্রবাহ শুরু হয় ৩১ মার্চে। দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম টানা ৩৭ দিন ধরে তাপপ্রবাহ চলেছে।
এপ্রিল মাস এমনিতেই উষ্ণ, তবে এ মাসটির ‘স্বাভাবিক’ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকার কথা।
কিন্তু এবার এপ্রিলে গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ২০২৩ সালের এপ্রিলের গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৮১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরের আবহাওয়ার গড় অবস্থা বা জলবায়ু বিবেচনা করে তারা গড় ‘স্বাভাবিক’ তাপমাত্রা ঠিক করেছেন।
“প্রত্যেক এপ্রিল মাসে প্রতিদিনের একটা গড় তাপমাত্রা পাওয়া যায়, পুরো মাসের গড় করা হয়। এভাবে ৩০ বছরের এপ্রিল মাসের তাপমাত্রা হিসাব করে যে গড় পাওয়া যায়, সেটাকে গড় ধরা হয়। এই এপ্রিল মাসে যে গড় তাপমাত্রা পাওয়া গেছে, সেটা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ ডিগ্রি বেশি।”
আবুল কালাম মল্লিক মনে করেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশসহ আশেপাশের এলাকার তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে।
তিনি বলেন, “আগে বাংলাদেশের পশ্চিম অংশে বেশি তাপমাত্রা আসত, ক্রমান্বয়ে সারা দেশেই বেড়ে চলছে। এ সময়টাতে আমাদের দেশ উষ্ণ থাকে, কিন্তু এসব নিয়ামকের কারণে জলবায়ু ও আবহাওয়াগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হচ্ছে, যে কারণে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ১৯৮০’র দশকের পর থেকে তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে, এখন ব্যাপ্তিটা বেড়েছে।”
গত ৩০ এপ্রিল যশোরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা স্বাধীনতার পর তৃতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। গত বছরের এপ্রিলে সেখানে তাপমাত্রা এসেছিল ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বাকি দিনগুলোতে তা ৩৬ থেকে ৪০ ডিগ্রির মধ্যেই ছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, যশোরে এপ্রিল মাসে ‘স্বাভাবিক’ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার কথা ৩৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যদিও এবার তা এসেছে ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আগের বছরের এপ্রিলে ছিল ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এবার চুয়াডাঙ্গায় ১৬ এপ্রিল থেকে মাসের বাকি সময়টাতে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির উপরে ছিল। তার আগের সময়েও ৪০ ডিগ্রির আশেপাশেই ছিল তাপমাত্রা। এর আগের বছরের ১৩ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে তাপমাত্রা উঠেছিল ৪১ থেকে ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি পর্যন্ত। বাকি সময় তা ৪০ ডিগ্রির নিচেই ছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, চুয়াডাঙ্গায় এপ্রিল মাসে ‘স্বাভাবিক’ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার কথা ৩৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যদিও এবার এসেছে ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি, যেখানে আগের বছরে তা ছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই মৌসুমে সবচেয়ে বেশি তাপপ্রবাহ চলায় গরমের অনুভূতিও বেশি হচ্ছে এবার।
“(১৯৭২ সালে) রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা (৪৫.১ ডিগ্রি) উঠলেও, ওই সময় মাঝেমধ্যে আবার বৃষ্টিও হত, বজ্রঝড় হয়েছে। বজ্রঝড় হলে পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়। এবার ওই পরিস্থিতিটা নাই। কারণ দীর্ঘদিন বৃষ্টি হয়নি। তাপমাত্রা একেকদিন বেশি আসতেই পারে, কিন্তু মাঝে দুয়েকদিন বৃষ্টি হলে এটা হত না।”
সমরেন্দ্র বলেন, ২০১৪ ও ১৯৯৫ সালেও দেশে দীর্ঘদিন তাপপ্রবাহ বিরাজ করেছিল, তবে এবারের মত কষ্টকর পরিস্থিতি আসেনি।
“১৯৭৯ সালেও খরার পরিস্থিতি ছিল, অনেকদিন বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু এবার বৃষ্টিহীন দিনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। গত তিন দশকে দশমিক ৭ বা তার বেশি তাপমাত্রা বেড়ে গেছে।”
দিন দিন তাপমাত্রা বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি জনঘনত্ব বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে দায়ী করছেন।
সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, “এখন শহরে মানুষ বেড়েছে, বড় বড় দালান বেড়েছে, জলাশয় কমেছে। নগরায়নের কারণে ঢাকা শহরে অন্যান্য এলাকার চেয়ে তাপমাত্রা এভারেজে ২-৪ ডিগ্রি বেশি থাকে। এসি, জেনারেটর ব্যবহার করা হয়- এগুলোর হিটটা যাবে কোথায়? সেটা ভূপৃষ্ঠতেই থাকে।
“আগে গাছ বেশি ছিল, সেগুলা নাই এখন। ফসলি কমিয়ে নগরায়ন করা হচ্ছে, খাল-বিল যা ছিল, তাও নেই। এর ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাতও কম হবে, কারণ তাপমাত্রার কারণে বায়ুমন্ডলের বিন্যাস বদলে যাচ্ছে। বৃষ্টিগুলো কাতার, সৌদি আরবের দিকে চলে গেছে, যেখানে এসময়ে কখনো বৃষ্টি হয় না- সেখানে বন্যা হয়ে গেছে।”
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবছর পৃথিবীতে এল নিনো সক্রিয়; যে সময়টাতে আবহাওয়া অস্বাভাবিক থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে নগরায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেভাবে জলাশয় ও বনায়ন কমেছে, সেটিই বড় প্রভাব ফেলছে।
“অনেক গাছ থাকলে তাপমাত্রাটা কমে আসত। যে সুযোগ সুবিধাটা আমরা পেতাম, সেটা পাচ্ছি না এখন। জলাশয়গুলো তাপ ধরে রাখে, গাছ শোষণ করে, কংক্রিটের কারণে মাটির নিচে পানি যেতে পারে না। কংক্রিট তাপ ধরে রাখে, গ্লাস তাপ রিফ্লেক্ট করে।”
উষ্ণায়নের প্রসঙ্গ টেনে অধ্যাপক সাইফুল বলেন, “ধীরে ধীরে পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে, কারণ কার্বন ডাই অক্সাইড বাড়ছে। এসব কারণে গ্রাম থেকে শুরু করে সব জায়গার তাপমাত্রা বাড়ছে।”
জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে মোটাদাগে শিল্পোন্নত দেশগুলোর দায় দেখছেন তিনি।
“যারা এর ভিক্টিম, তাদেরকে ওই দেশগুলোর সহায়তা করা উচিত।”
গাছ ঘেরা এলাকা কমছেই
দেশের বন ও বনভূমি দেখভালকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ছিল ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ একর। এর মধ্যে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫২ একরই বেদখল হয়ে আছে।
একটি দেশের পরিবেশ-প্রকৃতি ঠিক রাখতে অন্তত ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার হলেও বাংলাদেশে মোট আয়তনের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ এলাকায় বনভূমি রয়েছে বলে জানিয়েছেন খোদ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী।
আর ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট পরিচালিত প্ল্যাটফর্ম গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে প্রায় ৬ লাখ ৭ হাজার ৬২০ একর। এই সময়ে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ আগের তুলনায় ১৩ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে ২০১৭ সালে; প্রায় ৭০ হাজার একর।
এই সময়ে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমে যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। তালিকায় প্রথম নামটি দক্ষিণ আমেরিকার দেশ সুরিনাম; যেখানে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে প্রায় ৬ লাখ ২২ হাজার ৪৪০ একর, দ্বিতীয় স্থানে থাকা দেশটি হচ্ছে আফ্রিকার দেশ মালাউই; সেখানে কমেছে ৬ লাখ ১০ হাজার ৯০ একর বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমি।
গবেষণার তথ্যে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৪৯ লাখ সাড়ে ৯৬ হাজার একর (২০ লাখ ২২ হাজার হেক্টর) প্রাকৃতিক বনভূমি ছিল, যা মোট ভূমির ১৬ শতাংশ। প্রতিবছরই সেই বনভূমি কমছে। শুধু ২০২৩ সালেই বনভূমি কমেছে প্রায় ৪৪ হাজার একর।
এই বিশাল এলাকার গাছগাছালি ধ্বংস না হলে অন্তত ৭৫ মেগাটন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ঠেকানো যেত।
ফরেস্ট ওয়াচের গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সবচেয়ে বেশি কমেছে চট্টগ্রামে; ৫ লাখ ৭০ হাজার ৫৭০ একর, যা মোট কমে যাওয়া বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার ৯৪ শতাংশ। এরপর যথাক্রমে আছে সিলেট, সেখানে কমেছে ২০ হাজার ৬৭৪ একর, ১৩ হাজার ৯৮০ একর, রংপুরে কমেছে ১ হাজার ১৯০ একর, রাজশাহীতে ৭৯৮ একর, খুলনায় ৫০১ একর, বরিশালে কমেছে প্রায় ২৪৫ একর।
গত ২০ বছরে চট্টগ্রাম অঞ্চল যে পরিমাণ বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা হারিয়েছে, তার ৭৬ শতাংশই বান্দরবান ও রাঙামাটিতে। এই সময়ে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সবচেয়ে বেশি উজাড় হয়েছে বান্দরবানে- ২ লাখ ৯ হাজার ৭৯২ একর। এছাড়া রাঙামাটিতে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৬১০ একর, খাগড়াছড়িতে ৬০ হাজার ৫৪১ একর, চট্টগ্রামে ২৩ হাজার ১০৪ একর ও কক্সবাজারে ২২ হাজার ৭৮৩ একর বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা ধ্বংস হয়েছে।
কী দিন আসছে সামনে?
এভাবে চলতে থাকলে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, “দূষণ বন্ধ করা, গাছ রক্ষা করার কোনো লক্ষণ দেখছি না। প্রতিনিয়তই দূষণ বাড়ছে, বাতাস, নদী দূষণ বেড়েই চলছে। ঢাকার যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটার রিকভার করা যাবে কি না জানি না।”
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, এভাবে চলতে থাকলে সামনে আরো টানা তাপপ্রবাহ ভোগ করতে হবে।
“আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, যদি অলৌকিক কিছু না ঘটে- তাহলে রক্ষা নাই। মানুষের তো ক্ষতি হবেই, গরু-ছাগল সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। এমনিতেই চিল, শকুন নাই হয়ে গেছে। কারণ তারা এই তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে না।”
স্বাভাবিক আবহাওয়া ফিরিয়ে আনতে পরিকল্পিত নগরায়ন, গাছ লাগানো, মৃত জলাশয়গুলোকে বাঁচিয়ে তোলার মতো কার্যক্রম নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন সমরেন্দ্র কর্মকার।
“গাছ তাপ শোষণ করে, গাছ যত মোটা হবে, তার ভেতরে তত বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড ঢুকবে। ফসলি জমি ফসলি রাখতে হবে। জেনারেটরের ব্যবহার কমাতে হবে। ঢাকা শহরে অনেক হিট এক্সপোজ করে। সেগুলো এলাকাতেই থাকে। খুব পরিকল্পিতভাবে নগরের উন্নয়ন করতে হবে।”
গাছ কাটাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করার দাবি জানান তিনি।
ঢাকাকে বাসযোগ্য করার উপায় কী, এমন প্রশ্নের উত্তরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত দুই-তিন দশক ধরে এ শহরের উপর সবচেয়ে বেশি অত্যাচার হয়েছে।
“আমাদের ভবনগুলো এখন নিজেরাই তাপ উৎপাদন করছে এবং ধরে রাখছে। এখন যা সবুজ আছে সেটাকে রক্ষা করতেই হবে। সবুজ এলাকা বাড়াতে হবে। ঘরের আশেপাশে, ফুটপাতে, যেখানে জায়গা আছে- সেখানে, ছাদেও বড় গাছ লাগানো যায়।
“যেখানে গাছ লাগানো হবে, সেখানে থেকে কংক্রিট তুলে ফেলতে হবে এবং জলাশয়গুলো ফেরানোর চেষ্টা করতে হবে। নাহলে সামনে যে আরো ভয়ংকর বছরগুলো আসবে সেগুলো অনেক বেশি ভোগাবে।”
বুয়েট অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলামের পর্যবেক্ষণ, শহরের পরিধি বাড়ানো গেলে এবং বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে ঢাকামুখী মানুষের এখনকার মতো স্রোত থাকবে না। ফলে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা যাবে তাপমাত্রা।
অধ্যাপক সাইফুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছাদ বাগান, গ্রিন শহর এসব ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে। বাংলাদেশে খুবই অপরিকল্পিতভাবে শহরগুলো ডেভেলপ হচ্ছে। এরকম অবস্থা কোনো দেশে নাই। খাল রক্ষা করে, গাছ লাগানো, গাছ লাগিয়ে তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়।
“অন্যান্য শহরকেও গুরুত্ব দিয়ে রক্ষা করতে হবে, নাহলে ঢাকা শহরের মতোই হবে। ঘর-বাড়ি তৈরি করার সময় তাপমাত্রার কথা বিবেচনা করে করতে হবে।”
আরো পড়ুন