Published : 16 May 2024, 01:43 AM
প্রয়াত হলেন ২০১৩ সালের সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী কানাডীয় কথাসাহিত্যিক অ্যালিস মুনরো (১০ জুলাই ১৯৩১ - ১৩ মে ২০২৪)। তিনি ৯২ বছরের এক গৌরবময় জীবন যাপন করেছেন। পরিণত বয়সেই তার মৃত্যু হয়েছে এবং তিনি সাহিত্যজগতে অবদান রাখার মতো পর্যাপ্ত সময় পেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের চেয়েও এক দশক অধিক, যদিও জীবনের শেষের বছরগুলোতে তিনি ডেমেনশিয়ায় ভুগেছেন, যা তাকে লেখা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো। তিনি পৃথিবীকে যা দিয়েছেন, তা অলোকসামান্য। চিরস্মরণীয় তার সৃষ্টিসম্ভার। তিনি যে ছোটগল্পগুলো লিখেছেন বিষয়, আঙ্গিক ও ভাষায় তা অনন্য। তিনি নিছক সাহিত্যিক নন, তিনি শিল্পী। কাহিনীবিন্যাস, চরিত্রায়ন ও বর্ণনাকৌশলে শৈল্পিকতা পরিস্ফূট। সামান্য পারিবারিক ও সামাজিক ঘটনাকে তিনি তার অসামান্য বুননে ও বয়ানে অপরূপ শিল্পমহিমায় উদ্ভাসিত করে তোলেন। মুনরোর কাজ তার সুনির্দিষ্ট চিত্রকল্প, বিবরণশৈলী, আবেদনময়তা, ঋজুতা, মিতব্যয়িতা, অনুভবতীব্রতা, অর্থগভীরতা এবং মনোজটিলতার জন্য বিশিষ্ট। নিঃসন্দেহে তিনি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রতিভাবান ও প্রভাবশালী সাহিত্যিকদের একজন।
মূলত ২০১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার পর থেকে অ্যালিস মুনরোর প্রতি বিশ্বব্যাপি আগ্রহ তৈরি হয়। বাংলাদেশেও শুরু হয় তার পাঠ ও অনুবাদ। অনেকে তার গল্পাবলি আলোচনা করেছেন ও অনুবাদ করেছেন। আমিও এ পর্যন্ত তার আটটি গল্প অনুবাদ করেছি। এগুলো হলো— কণ্ঠস্বর (Voices), নুড়িপাথর (Gravel), ছেলেমেয়ে (Boys and Girls), পাহাড়ে ভালুক এসেছিলো (The Bear Came Over the Mountain), কাউবয় ওয়াকার ব্রাদার্স (Walker Brothers Cowboy), সুখি ছায়ার নৃত্য (Dance of the Happy Shades), পোস্টকার্ড (Postcard) এবং ছবি (Images)। গল্পগুলো অনুবাদ করতে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি তার লেখনির ধার ও শক্তিমত্তা। গল্পের গাঁথুনি ও উপস্থাপনার মুন্সিয়ানা এক কথায় তুলনারহিত। আর প্রকাশভঙ্গি গভীর শিল্পময় হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে তা অনুবাদ করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
অ্যালিস মুনরো ছোটগল্প লিখে এতোটাই সুনাম অর্জন করেছেন যে সমালোচকগণ তাকে “কানাডার চেখভ” অভিধায় অভিহিত করেছেন। তাঁর গল্পে পাওয়া যায় সমকালীন জীবনসমস্যার বাস্তব চিত্র। বিস্তৃত ক্যানভাসে ধরা পড়ে নগর ও মফস্বলে মানুষের জীবনযাপন ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা। জেনারেশন গ্যাপ ও নরনারীর বহুস্তরিক সম্পর্ক তাঁর নিরীক্ষার বিষয়। পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন অনেক গল্পের ফোকাস। কাহিনীতে তাঁর নিজের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার ছায়াপাত ঘটেছে। বেশির ভাগ গল্পেই স্থান-সেটিং বা পটভূমি হিসেবে পাওয়া যায় তাঁর আজন্ম পরিচিত ওন্টারিয়োর হুরন কাউন্টি। বর্ণনায় স্পষ্ট কিন্তু জ্যামিতিক বিন্যাসে জটিল গল্পের প্লট পাঠকের চিন্তার গভীরতলকে স্পর্শ করে। আন্তন চেখভের মতোই মুনরো নিঃসন্দেহে এক কালজয়ী গল্পকার। চেখভের মতোই তিনি চলমান সময় কিংবা সময়ের অচলায়তনে মোহাবিষ্ট। নোবেল সাইটেশনে তাঁকে যথার্থই বলা হয়েছে ‘সমকালীন ছোটগল্পের গুরু’ (master of the contemporary short story)। ‘চেরি অরচার্ড’, ‘আঙ্কেল ভানিয়া’, ‘থ্রি সিসটার্স’ ও ‘সিগাল’—খ্যাত চেখভের মতো তিনি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবেন পাঠকহৃদয়ে।
মুনরোর কথাসাহিত্য বলতে বোঝায় মূলত ছোটগল্প। নামে ছোটগল্প মাত্র, আদতে একেকটা প্রায় উপন্যাসের সমান (নিদেনপক্ষে উপন্যাসিকা)। আমার বিবেচনায় এগুলোকে বড়গল্প বলাই বেশি সঙ্গত। তাঁর বিশালবপু গল্পগুলোকে অনেকে উপন্যাস বলে দাবি করেন। সমালোচক এলেক্স কিগানের মতে, তাঁর অধিকাংশ গল্পেই উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। কাহিনীতে থাকে নানা ঘাতপ্রতিঘাত, শাখাপ্রশাখার সর্পিল বিস্তার। এক সাক্ষাৎকারে মুনরো নিজেই বলেছেন, তিনি উপন্যাস লিখতে চেয়েছেন, উপন্যাস লিখতে বসেছেন, কিন্তু লেখা শেষ করার পর যা দাঁড়িয়েছে তা হলো গল্প। গল্পে ঘটনাঘূর্ণির মধ্যে দীপ্যমান থাকে এক অবশ্যম্ভাবী ভরকেন্দ্র, যা কাহিনীকে দান করে নিটোল সংহতি ও ঐক্য। ঘটনার জলছাপে প্রায়শ প্রকট হয়ে ওঠে অস্তিত্বের সংগ্রামে লিপ্ত পাত্রপাত্রীদের নৈতিক টানাপড়েন। টুকরো টুকরো দৃশ্যাবলি অভিন্ন সুতায় বাঁধা থাকে এবং একটি অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। পাঠক পেয়ে যান একটি কমপ্যাক্ট স্টোরি, আর আস্বাদন করেন এর অনাস্বাদিত তাৎপর্য। বহু ক্ষেত্রে ঘটনার চেয়ে উপলব্ধির আকস্মিক উন্মোচনই মুখ্য হয়ে ওঠে। মুনরোর কথাসাহিত্যের প্রকরণকে অনেক সমালোচক ‘সাউদার্ন ওন্টারিও গথিক’ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
অ্যালিস মুনরোর জন্ম কানাডার ওন্টারিও প্রদেশের উইংহামে। বাবা রবার্ট এরিক লেইডলো ছিলেন পশুপালক, মা অ্যানি ক্লার্ক স্কুলশিক্ষক। প্রকৃতির সন্নিধানেই তাঁর শৈশব কেটেছে। পড়াশোনা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন ওস্টারিওতে, সাংবাদিকতা ও ইংরেজি সাহিত্যে। ছোটবেলা থেকেই পড়া ও লেখার নেশা ছিলো। তাঁর প্রথম গল্প ‘ডায়মেনশন্স অব অ্যা শ্যাডো’ প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। ১৯৬৩ সালে নিজ নামে খোলেন বইয়ের দোকান ‘মুনরো'জ বুকস’। ১৯৬৮ সালে এখান থেকেই বের হয় তাঁর প্রথম গল্পের বই ‘ড্যান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস’ যা তাঁকে সারা কানাডায় পরিচিত করে তোলে।
এর পরের প্রকাশনাগুলো তাঁর লেখক পরিচয়কে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করায় এবং তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে দেয় দূরদূরান্তে। তিনি একে একে লিখেন (গড়ে প্রায় চার বৎসর অন্তর অন্তর) : লাইভস অব গার্লস অ্যান্ড উইমেন (১৯৭১), সামথিং আই হ্যাভ বিন মিনিং টু ইউ (১৯৭৪), হু ডু ইউ থিঙ্ক ইউ আর (১৯৭৮), দ্য মুনস অব জুপিটার (১৯৮২), ফ্রেন্ড অব মাই ইয়ুথ (১৯৯০), ওপেন সিক্রেটস (১৯৯৪), দ্য লাভ অব অ্যা গুড ওম্যান (১৯৯৮), হেটশিপ, ফ্রেন্ডশিপ, কোর্টশিপ, লাভশিপ, ম্যারিজ (২০০১), নো লাভ লস্ট (২০০৩), রানঅ্যাওয়ে (২০০৪), দ্য ভিউ ফ্রম ক্যাসল রক (২০০৬), টু মাচ হ্যাপিনেস (২০০৯) এবং ডিয়ার লাইফ (২০১২)।
মুনরোর শুরুর দিকের গল্পগুলোতে (যেমন ‘ড্যান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস’, ‘লাইভস অব গার্লস অ্যান্ড উইমেন’) কিশোরী জীবনের সমস্যা চিত্রিত। পরের দিকের গল্পগুলোতে (যেমন ‘হেটশিপ, ফ্রেন্ডশিপ, কোর্টশিপ, লাভশিপ, ম্যারিজ’, ‘রানঅ্যাওয়ে’) তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে মধ্যবয়সী নারীর সমস্যার ওপর। সেই নারীরা কেউ একা, বিষণ্ণ, নস্টালজিক, জীবনের অর্থ অনুসন্ধানে মাতোয়ারা—দিশেহারা। তাঁর গল্পে থাকে জীবনের দ্ব্যর্থকতাপ্রসূত আয়রনি, জ্ঞান-অজ্ঞতার দ্বৈরথ, শুভ-অশুভের বিক্ষেপ, আনন্দ-বেদনার নির্যাস। অধিকল্পনার আঁচে সাধারণ ঘটনা পায় অসাধারণ দীপ্তি। রবার্ট থ্যাকার বলেন: “মুনরোর লেখা পাঠকদের মধ্যে এক সমানুভূতিক ঐক্য তৈরি করে। আমরা তাঁর লেখার প্রতি আকৃষ্ট হই প্রতীতির কারণে, বাস্তবিক প্রতিকৃতির জন্য নয়।”
মুনরোর নারীচরিত্রগুলো জীবন্ত, বিচিত্র, তবে সকলেই সমস্যাজর্জরিত বাস্তব পৃথিবীর বাসিন্দা। এদের মধ্যে আছে যক্ষ্মাআক্রান্ত শহরের স্কুলটিচার (‘আমুন্ডসেন’), ভ্যাঙ্কুভারের মেয়ে যে তার চাচাচাচির সঙ্গে বসবাস করতে চলে যায় (‘হ্যাভেন’), মুভি থিয়েটারে কাজ করা তরুণী (‘লিভিং ম্যাভারলি’), দুই কন্যার জননী যে তার স্বামীকে ত্যাগ করে অভিনেতা বয়ফ্রেন্ডের দিকে ধাবিত হয় (‘গ্র্যাভেল’), দুই পুরুষের মুখোমুখি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই বান্ধবী (‘অ্যাক্সিস’), বিবাহিত স্থপতির প্রেমাসক্ত এক ধনী মহিলা (‘কোরি’), কিশোরী বয়সে এক অসুস্থ বৃদ্ধের পরিচর্যার স্মৃতি রোমন্থনকারী এক কৌতুকপ্রিয় মহিলা (‘সাম ওমেন’), মা ও সৎকন্যা (‘হু ডু ইউ থিঙ্ক ইউ আর’) ইত্যাদি। মুনরোর নারীরা সংবেদনশীল, স্বাধীনচেতা, জীবনের অস্তিত্বে কখনো সন্দিহান, কখনো আস্থাবান। মুনরোর গল্পমালা ইউরোপীয় নারীবাদী সাহিত্যের ধারাকেই সুহংহত করেছে। কথাসাহিত্যে তিনি কারসন ম্যাককালারস, ফ্ল্যানারি ও’কোনার, ইউডোরা ওয়েটলি, ভার্জিনিয়া উলফ এবং ক্যাথারিন ম্যানসফিল্ডের যোগ্য উত্তরসূরি।
‘লাইভস অব গার্লস অ্যান্ড উইমেন’—এ দেখা যায় ডেল জর্ডান মায়ের বোর্ডারের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে। এখানে প্রেমাসক্তির দৈহিক ও মানসিক বর্ণনা কিছুটা হাস্যরস সহযোগে উপস্থাপিত। ‘দ্য মুনস অব জুপিটার’ রূপকাত্মক, পারিবারিক-মনস্তাত্ত্বিক কক্ষপথে ঘূর্ণমান। গল্পের ন্যারেটর প্ল্যানেটরিয়াম দেখতে যান যখন তার পিতা হাসপাতালে এবং কন্যা বাসায় অনুপস্থিত। গ্রহনক্ষত্র পরিক্রমণের মধ্যে, তাদের পারস্পরিক দূরত্বের মধ্যে, তিনি অনুধাবন করেন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিদ্যমান দূরত্ব। ‘লাভ অব অ্যা গুড ওম্যান’ যৌনতা, প্রেম ও মৃত্যু নিয়ে সাসপেন্সের আখ্যান। ‘হেটশিপ, ফ্রেন্ডশিপ, কোর্টশিপ, লাভশিপ, ম্যারিজ’-এর অন্তর্ভুক্ত ‘ফ্যামিলি ফারনিশিং’ গল্পে এক উদীয়মান লেখক পারিবারিক বন্ধুকে ঘৃণা করতে শুরু করে যাকে সে শৈশবে পছন্দ করতো। গল্পের শেষে আত্ম-উপলব্ধিতে সে জেগে ওঠে, তার নিজের অচেনা অংশ চেনা হয়ে ওঠে। ‘ডিয়ার লাইফ’ মা-মেয়ের সম্পর্কের গল্প। এখানে ন্যারেটর স্মৃতিচারণ করেন- মা তাকে ছোটবেলায় টেনেহেঁচড়ে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে যখন এক প্রতিবেশী এগিয়ে আসেন। এই স্মৃতির স্ফুলিঙ্গ তাকে উত্তপ্ত করে, জাগ্রত করে, এবং তার মধ্যে নানারকম মনস্তাত্ত্বিক ঘাত-প্রতিঘাত তৈরি করে।
মুনরোর অনেক গল্পেই একটি বিষণ্ণতার আবহ বিদ্যমান। দুর্ঘটনা, বিচ্ছেদ, মৃত্যু ইত্যাদি তাঁর গল্পে সহজলভ্য। ‘ফিটস’, ‘ডায়মেনশন’, ‘ফ্রি র্যাডিক্যালস’ ইত্যাদি গল্পে আছে খুনোখুনি। দুর্ঘটনার কাহিনী আছে ‘মাইলস সিটি, মন্টানা’, ‘চেঞ্জেস অ্যান্ড সেরেমনিজ’, ‘ওয়াকিং অন ওয়াটার’, ‘পিকচারস অব দ্য ইও’, ‘চাইল্ডস প্লে’ ইত্যাদি গল্পে। ‘দ্য টার্কি সিজন’ গল্পে বিমর্ষতার ঠাণ্ডা আবেশ তৈরি হয় শোঁ-শোঁ তুষারঝড়ে। তাঁর সবচে বেদনাবিধুর গল্প হলো ‘ডালস’, যেখানে দেখা যায় বিচ্ছিন্নতার পর এক নারী নিউ বার্নসউইকে বিষাদগ্রস্ত অবস্থায় দিনের পর দিন কাটাতে থাকে।
‘প্যাশন’ গল্পটি ফ্ল্যাশব্যাকে বর্ণিত এক নারীর ট্রাজিক জীবনের কাহিনী। গল্পের প্রোটাগনিস্ট গ্রেস চল্লিশ বছর পর ওটাওয়া ভ্যালিতে আসেন। বিশ বছর আগের ঘটনা বিধৃত। পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি চাচার সঙ্গে বেতের চেয়ার তৈরির কারখানায় কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু গ্রীষ্মে বেইলি ফলসে বেড়াতে গিয়ে ধনী ট্র্যাভার্স পরিবারের ছোট ছেলে মরির সঙ্গে তার প্রণয় ঘটে। এনগেজমেন্ট হয়। পরিচয় হয় মরির সৎভাই বিবাহিত মদ্যপ্রিয় চিকিৎসক নীলের সঙ্গে। গ্রেস ছোট একটি দুর্ঘটনায় আহত হলে নীল তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সুস্থ হলে তারা দুজনে বেরিয়ে পড়ে দূরের যাত্রায়। গ্রেস বুঝতে পারে তার আর মরির কাছে ফেরা হবে না। কিন্তু পরদিন নীল এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। মরি ও নীলের পিতা অসহায় গ্রেসকে দেখতে আসেন এবং তার হাতে এক হাজার ডলারের একটি চেক গুঁজে দেন। প্রত্যাখ্যাত করুণাভাজন গ্রেস সেই টাকা নিয়ে নতুন জীবনের সন্ধানে নিজের পথে চলে যান।
‘দ্য বেয়ার কেইম ওভার দ্য মাউনটেইন’ গ্র্যান্ট ও ফিয়োনা দম্পতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। গ্র্যান্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ফিয়োনা হাসপাতালের প্রশাসক। বার্ধক্যে ফিয়োনার স্মৃতিভ্রম দেখা দেয় এবং গ্র্যান্ট তাকে একটি নার্সিং হোমে ভর্তি করান। গ্র্যান্ট বহুগামী। তিনি নিয়মিতভাবে তার স্ত্রীকে দেখতে যান কিন্তু অন্য নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে বিরতি ঘটে না। ফিয়োনা অল্পবিস্তর টের পান কিন্তু কোনোরকমে হজম করেন। একসময় হাসপাতালে অব্রে নামক এক ভদ্রলোকের আবির্ভাব ঘটে। ফিয়োনা তার প্রতি প্রেমাসক্ত হন। গ্র্যান্ট এতে বাধা দেন না, ফিয়োনা ভালো থাকবে হয়তো এই প্রত্যাশায়। কিন্তু অব্রে নার্সিং হোমে চিকিৎসা শেষে তার পরিবারে ফিরে গেলে ফিয়োনা মনমরা হয়ে পড়েন। গ্র্যান্ট অব্রের স্ত্রীর কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন যাতে অব্রে মাঝে মাঝে ফিয়োনাকে দেখতে যান এবং তিনি সেই ব্যবস্থা করে দেন। অব্রের স্ত্রী রাজি হন না। কিছুদিন পর অবশ্য অব্রের স্ত্রী গ্র্যান্টকে প্রস্তাব দেন শহরের এক ডান্স পার্টিতে যাওয়ার জন্য। গ্র্যান্ট রাজি হন দুই কারণে— প্রথমত, তার নিজের স্বভাবজাত মনোরঞ্জনের জন্য এবং দ্বিতীয়ত, এতে অব্রের ফিয়োনার কাছে আসার সুযোগ তৈরি হবে এবং তার বিষণ্ণতা কাটবে। চতুর্ভূজ প্রেমের জটিল এক গল্প: পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্কের, শারীরিক-মানসিক দ্বন্দ্বের, ভালোবাসা-লিপ্সার বিকারগ্রস্ততার, বৈধতা-অবৈধতার সীমারেখায় ধূসর, বাস্তবঘেঁষা, অপ্রিয় সত্য উন্মোচনে দ্বিধাহীন।
মুনরোর বেশির ভাগ গল্পই সহজ সাবলীলভাবে লেখা। ভাষা স্বচ্ছন্দ ও গতিময়। কিন্তু তার কিছু কিছু গল্প অতিশয় জটিল, কাহিনী ও ভাষা উভয়বিধ বিবেচনায়। এরকম দুটি গল্প হলো— ‘ওপেন সিক্রেটস’ এবং ‘ট্রেইন’। বারবার পাঠ করার পরও এগুলোর মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যায় না। এগুলোতে তিনি জেমস জয়েসের মতো দুর্বোধ্য ও প্রহেলিকাময়। কিছু কিছু গল্পে আছে অচিন্ত্যনীয় বাঁক বা টুইস্ট। যেমন, ‘ট্রিকস’। এ গল্পের নায়িকা এক ভদ্রলোকের প্রেমে পড়েন। বিচ্ছিন্নতা আসে। আবার সাক্ষাৎ ঘটে। এবার তাকে অতিশয় শীতল লাগে। পরে দেখা যায়, এই শীতল লোকটি আসলে আগের উষ্ণ ভদ্রলোকের যমজ ভাই।
অ্যালিস মুনরো জীবনে পেয়েছেন বহুবিধ সম্মান। তিনি তিন-তিনবার লাভ করেছেন কানাডার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার গভর্নর জেনারেল অ্যাওয়ার্ড। এছাড়া পেয়েছেন ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ, কানাডিয়ান বুকসেলারস অ্যাওয়ার্ড, মারিয়ান এঙ্গেল অ্যাওয়ার্ড, ট্রিলিয়াম বুক অ্যাওয়ার্ড, ডব্লু এইচ স্মিথ লিটারারি অ্যাওয়ার্ড, পেন/মালামুড অ্যাওয়ার্ড, ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ড, গিলার প্রাইজ, রি অ্যাওয়ার্ড ফর দ্য শর্ট স্টোরি, লিবরিস অ্যাওয়ার্ড, ও হেনরি অ্যাওয়ার্ড, কানাডা-অস্ট্রেলিয়া লিটারারি প্রাইজ এবং কমনওয়েলথ রাইটার্স প্রাইজ।
প্রয়াণ ঘটেছে মুনরোর। পৃথিবী এক মহান সাহিত্যিককে হারিয়েছে। কেউ পৃথিবীতে চিরকাল বাঁচে না, কিন্তু কেউ কেউ অমর হন তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে। অ্যালিস মুনরো অমর হয়ে থাকবেন তার অবিস্মরণীয় কথাসাহিত্যের কল্যাণে।