“দুদিন আগে আমাদের ড্রোন ক্যামেরায় বনের ভিতর ৩৪ সদস্যের একটি হাতির দলে আট থেকে ১০টি বাচ্চা দেখা গেছে।”
Published : 25 Nov 2024, 08:50 AM
শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকায় বন্যহাতি আর মানুষের দ্বন্দ্ব চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এই দ্বন্দ্বের জেরে এশিয়ান প্রজাতির এই হাতি শিগগিরই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন বন্যপ্রাণী গবেষকরা।
তবে এমন শঙ্কার মধ্যেই চমকপ্রদ এবং আশা জাগানিয়া খবর দিয়েছে শেরপুর বনবিভাগ।
তারা বলছে, শেরপুরের গারো পাহাড় এলাকায় প্রজননের মাধ্যমে ক্রমেই বন্যহাতির বংশ বিস্তার ঘটছে। গত এক বছরে এ এলাকায় প্রায় অর্ধশত হাতি শাবকের জন্ম হয়েছে। ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে বন্যহাতির সংখ্যা।
বনবিভাগের শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুরি রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমন মিয়া বলেন, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুরি রেঞ্জ অফিসের পেছনের জঙ্গলে একটি হাতি শাবকের জন্ম হয়। জন্ম নেওয়া শাবকটি সুস্থ আছে এবং দলবদ্ধ হয়ে মা হাতির সঙ্গে বনের ভেতরে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে।
শেরপুরের সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার গারো পাহাড়ি এলাকায় বন্যহাতির তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষকের ক্ষেতের ফসল, তছনছ হচ্ছে ঘরবাড়ি ও গাছপালা- এমন খবর পাওয়া যায় প্রায়ই।
আবার স্থানীয় কৃষকরা ফসল বাঁচাতে তাদের জমির চারপাশে বিদ্যুতের তার দিয়ে রাখেন যেন হাতি এসে ফসলের ক্ষতি করতে না পারে। কিন্তু এতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা পড়ছে বন্যহাতি।
এভাবে মানুষের হাতে হাতির মৃত্যুর ঘটনার পাশাপাশি হাতির আক্রমণে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
ময়মনসিংহ অঞ্চলের বন্যহাতি সংরক্ষণ বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও জামালপুর জেলার গারো পাহাড় এলাকায় হাতির আক্রমণে মানুষ মারা পড়েছে ৪৩ জন।
শেরপুর বিভাগীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের সদর রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আলম বলেন, গত এক দশকে হাতির হামলায় ময়মনসিংহ জেলায় ১০ জন, জামালপুর জেলায় তিনজন, নেত্রকোনা জেলায় পাঁচজন এবং শেরপুর জেলায় সর্বোচ্চ ২৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
অপরদিকে মানুষের হাতে নানাভাবে মারা পড়েছে জামালপুর জেলায় তিনটি, নেত্রকোনা জেলায় দুটি এবং সর্বোচ্চ শেরপুর জেলায় ২৭টি হাতি।
এদিকে মানুষ মারা গেলে সরকার থেকে বনবিভাগের মাধ্যমে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। কিন্তু হাতি মারা গেলে বা হত্যা করা হলে এতদিন কোনো আইনি ব্যবস্থাপনা করা হয়নি।
তবে সর্বশেষ ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর শ্রীবরদী উপজেলায় এবং চলতি বছরের ১ নভেম্বর নালিতাবাড়ী উপজেলায় মাত্র দুটি হাতি হত্যার অভিযোগে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী দুটি মামলা হয়েছে বলে জানান বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আলম।
এসব খবরের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে এশিয়ান প্রজাতির বন্যহাতির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং বিলুপ্তের পথে চলে আসছে বলে উদ্বেগজনক খবরও দিয়েছেন হাতি গবেষকরা। এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারও (আইইউসিএন)।
মানুষ ও বন্যপ্রাণীর এমন সংকটের মধ্যে শেরপুরের বনবিভাগ এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ জানিয়েছে, দুই-তিন মাস আগেও এই জঙ্গলে আরও কয়েকটি হাতি শাবকের জন্ম হয়েছে।
বালিজুরি রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমন মিয়া বলেন, বালিজুরি রেঞ্জে বেশ কিছু এলাকায় গভীর বন থাকায় এখানে তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে হাতি বিচরণ করতে দেখা গেছে। এই দলগুলোয় ৩০ থেকে ৩৫টি করে হাতি রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিটি দলে সাত থেকে আটটি হাতি শাবক দেখা যায়।
বন্য হাতির বংশবৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা বন্যহাতি রক্ষা এবং মানুষের জানমালের ক্ষতি কমাতে স্থানীয় মানুষ এবং বনবিভাগ যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছি। কিছুদিন ধরে এই অঞ্চলে হাতি মানুষের অনেকটাই সহঅবস্থান ফিরে এসেছে।”
এই কর্মকর্তা বলেন, “সম্প্রতি আমাদের বনবিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের যৌথসভায় হাতি রক্ষায় এবং জানমালের ক্ষতি এড়াতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের কারণে হাতির উপর আক্রমণ থেকে বিরত থাকছেন সাধারণ মানুষ।
“একইসঙ্গে নিজেদের ক্ষেতের ফসল বাঁচাতেও হামলা না চালিয়ে বিভিন্ন কৌশলে হাতি তাড়ানোর জন্য বনবিভাগের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে স্থানীয়রা।”
এ বিষয়ে শেরপুর বিভাগীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের সদর রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আলম বলেন, “শেরপুর সীমান্তে বিচরণ করা বন্যহাতির সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে কয়েক বছর ধরেই ১০০ থেকে ১২০টি হাতি শেরপুরের গারো পাহাড়ে বিচরণ করছিল।
“তবে বর্তমানে এ অঞ্চলে চারটি দলে বিভক্ত হয়ে প্রতিটি দলে ৩০-৪০টির মতো হাতি বিচরণ অব্যাহত রয়েছে। এতে করে বর্তমানে শেরপুর সীমান্তের গারো পাহাড় এলাকায় কমপক্ষে ১৭০টি মতো বন্যহাতি বিচরণ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।”
তিনি জানান, হাতির জরিপ চালানোটা খুবই জটিল কাজ। লোকবল থাকলেও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের অভাব রয়েছে আর বন্যহাতির সংখ্যা জরিপ করতে হলে একই সময়ে দীর্ঘ এলাকা জুড়ে জরিপ চলাতে হবে বলেও তিনি মনে করেন।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের এই কর্মকর্তা বলেন, “শেরপুরে হাতির সংখ্যা বাড়ছে এটা নিঃসন্দেহে সঠিক তথ্য। চার বছর অন্তর হাতি শাবক প্রসব করে। এখানের প্রতিটি দলেই বিভিন্ন বয়সের পাঁচ-ছয়টি করে হাতির বিচরণ করতে দেখা যাচ্ছে।
“দুদিন আগে আমাদের ড্রোন ক্যামেরায় বনের ভিতর ৩৪ সদস্যের একটি হাতির দলে আট থেকে ১০টি বাচ্চা দেখা গেছে। অর্থাৎ ২৪টি হাতির সঙ্গে ১০টি হাতির বাচ্চা। এটি খুবই আশার কথা।”
তিনি বলেন, “হাতি রক্ষায় আমরা ২০১৪ সাল থেকেই শেরপুরের তিনটি রেঞ্জ এলাকায় ৫০০ হেক্টর জমিতে হাতির খাদ্য উপযোগী গাছ রোপণ করেছি। আমাদের এই অঞ্চলে হাতির আবাসস্থল এবং খাদ্যের সংকট কমে আসার কারণেই দিন দিন হাতির সংখ্যা বাড়ছে বলে আমরা মনে করি।”
তবে পরিবেশবাদী যুব সংগঠন গ্রিন ভয়েস এর শেরপুর জেলা শাখার সভাপতি কবি ও সাংবাদিক রফিক মজিদ বলেন, “বিলুপ্তপ্রায় এই এশিয়ান প্রজাতির হাতির সংখ্যা বাড়ছে এটি খুবই আশার কথা। তবে আগামী দিনগুলোতে জানমালের রক্ষার পাশাপাশি হাতি রক্ষা করতে স্থানীয় জনগণ এবং প্রশাসনের আরো সুদৃষ্টি রাখা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।”