লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন জাহাঙ্গীর, এবার হাই কোর্টে আবেদন

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর ২০১৮ সালে বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে এবার তার দল আওয়ামী লীগ বেছে নিয়েছে আজমত উল্লা খানকে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 May 2023, 10:34 AM
Updated : 7 May 2023, 10:34 AM

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জমা দেওয়া মনোনয়নপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে গেলেন পাঁচ বছর আগে আওয়ামী লীগের প্রতীকে নির্বাচিত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।

রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে আপিল ব্যর্থ হওয়ার পর রোববার এই পদক্ষেপ নিলেন ক্ষমতাসীন দলের ‘বিদ্রোহী’ এই নেতা।

দ্বিতীয়বারের মত দলের পক্ষ থেকে শাস্তিমূলক পদক্ষেপের হুঁশিয়াররির মধ্যেই তার পক্ষে আইনজীবী নকিব শরিফুল ইসলাম হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদনটি জমা দিয়েছেন।

এই আইনজীবী বলেন, “রিটে আবেদনকারীর (জাহাঙ্গীর আলম) প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। এতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, গাজীপুরের রিটার্নিং অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।”

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর ২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। জেলার রাজনীতিতে তার প্রভাব বেড়েই চলেছিল। কিন্তু ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও একাত্তরে শহীদদের নিয়ে মন্তব্যের অডিও প্রকাশের পর বেকায়দায় পড়েন তিনি।

ওই বছরের নভেম্বরে জাহাঙ্গীরের দলের সদস্য পদ কেড়ে নেওয়া হয়। পাশাপাশি তাকে মেয়র পদ থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে গেলেও লাভ হয়নি তার। কারণ, সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এরই মধ্যে।

দলের শৃঙ্খলা মেনে চলার শর্তে গত ১ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরকে দলে ফেরায় আওয়ামী লীগ। তবে চার মাস যেতে তা যেতেই ফের বিদ্রোহ করেছেন তিনি।

এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছে আজমত উল্লা খানকে। তবে জাহাঙ্গীর নিজের পাশাপাশি মা জায়েদা খাতুনের নামেও মনোনয়নপত্র জমা দেন।

তার এই পদক্ষেপে ফের ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ। দলের ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম জানিয়েছেন, জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আবার ব্যবস্থা নেবেন তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেই এ বিষয়ে আসবে সিদ্ধান্ত।

তবে জাহাঙ্গীর এসব পাত্তা দিচ্ছেন না। মনোনয়নপত্র যাচাইবাছাইয়ে টিকে যাওয়া জায়েদা খাতুনকে শনিবার নিয়ে আসেন সাংবাদিকদের সামনে।

জায়েদার অভিযোগ, তার ছেলের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ হয়েছে এবং তার প্রতিকারের জন্যই ভোটে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

স্বতন্ত্র এই প্রার্থী বলেন, “নগরের ৫৭টা ওয়ার্ডের মানুষ আমাকে কতটা ভালোবাসে, তা আমি ভোটের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চাই। আমি ছেলের জন্য শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব।”

জয়ের জন্য আত্মবিশ্বাসের কথা তুলে ধরে জায়েদা বলেন, “যদি সুষ্ঠু ভোট হয়, কারচুপি ও দুর্নীতি না হয়, তাহলে আমি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। ৫৭টি ওয়ার্ডের মানুষ আমার সঙ্গে আছে, থাকবে ইনশাল্লাহ।”

জায়েদা সাংবাদিকদের সামনে আসার সময় সেখানে জাহাঙ্গীর ও তার অগুনতি সমর্থকও ছিল। যদি সাবেক মেয়র প্রার্থী হতে না পারেন, তবে তার কর্মী সমর্থকরা জায়েদার পাশে থাকবেন, সেই ইঙ্গিতও মিলেছে।

যে কারণে জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন বাতিল

করোনাভাইরাস মহামারীর আগে ২০১৯ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মধ্যে কোনাবাড়িতে কোরিয়ান মালিকানাধীন নিউটাউন নিটওয়্যার কম্পোজিট কারখানায় বেতন ভাতা পরিশোধ নিয়ে ঝামেলা হচ্ছিল। সে সময় কারখানার শ্রুমিকরা বিক্ষোভ করতে থাকে। ২০২০ সালে তখন কর্তৃপক্ষ অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকা ওয়াসা শাখা থেকে ঋণ নেয়। সেই ঋণের জিম্মাদার হন জাহাঙ্গীর, যিনি সে সময় মেয়রের চেয়ারে ছিলেন।

রিটার্নিং কর্মকর্তা মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণার পর জাহাঙ্গীর বলেন, “ওই কোম্পানির মধ্যে আমার কোনো শেয়ার নেই, কোনো লভ্যাংশও নিই না। তবুও হাজার হাজার শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ, তথা তাদের বাঁচানোর জন্য মানবিক কারণে আমার নিজের সম্পদ তাদের দিয়েছি। ওই সম্পত্তি ব্যাংকে মর্টগেজ দিয়ে সেই কোরিয়ান মালিক লোন নিয়ে কারখানাটি চলমান রেখেছেন। সেই ঋণে আমাকে জামিনদার করা হয়। করোনা মহামারীর কারণে ইতোপূর্বে কোরিয়ান মালিক ব্যাংকে যথাসময়ে ওই পেমেন্ট দিতে পারেনি।”

তিনি বলেন, “আমি প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর গত ১১ ও ১৮ এপ্রিল কোরিয়ানরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের যে পাওনা ছিল, তা পরিশোধ করেছে। কোরিয়ান কোম্পনি অগ্রণী ব্যাংকের পাওনা টাকা পরিশোধ করেছে। সেই সমস্ত কাগজপত্র আইনজীবী এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জমা দেওয়া হয়েছে।”

৪ মে নির্বাচন কমিশনে আপিলের দিন নথিপত্রে দেখা যায় ঋণটি ছিল ৮৫ কোটি টাকার, বকেয়া মিলিয়ে এখন ছাড়িয়েছে ১০১ কোটি টাকা।

২৭ এপ্রিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার আগে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকার একটি কিস্তি জমা দেয় নিউটাউন নিটওয়্যার। তবে ঋণটি এখনও ‍পুনর্গঠন করেনি অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবিতে জাহাঙ্গীরকে ঋণখেলাপি হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর ঋণ ও বিল খেলাপিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আছে।

নির্বাচন কমিশনে আপিল কর্তৃপক্ষ বলেছে, রিটার্নিং কর্মকর্তা যে যুক্তিতে জাহাঙ্গীরের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিলেন, একই কারণ দেখিয়েছে আপিল কর্তৃপক্ষও। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া সিআইবি প্রতিবেদনের সূত্র ধরে আদেশে বলা হয়, আপিলকারী যে খেলাপি ঋণের জামিনদার, তা গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পুনঃতফসিল হয়নি এবং রিপোর্টে তার নাম থাকায় মনোনয়নপত্রটি বাতিল করা হয়েছিল।

শুনানিকালে উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিনিধি বলেন, আপিল আবেদনকারী সিআইবির হালনাগাদকৃত তালিকা অনুযায়ী অদ্যাবধি ঋণের জামিনদাতা হিসেবে ঋণ খেলাপি মর্মে চিহ্নিত রয়েছেন। (জাহাঙ্গীরের) দাখিলকৃত কাগজপত্র পর্যালোচনায় বর্ণিত ঋণটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃক নিয়মিতকরণের কোনো প্রমাণক পাওয়া যায়নি। সেই বিবেচনায় রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক মনোনয়নপত্র বাতিলের আদেশ বৈধ মর্মেই প্রতীয়মান হয়।