শুরুতেই এ ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ পাচ্ছে ৫০ জন ছাত্র ও ২০ জন ছাত্রী।
Published : 19 Jan 2025, 11:42 PM
পাহাড়ের সুবিধাবঞ্চিত ম্রো শিশু শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা এবং মাতৃভাষায় শিক্ষার জন্য চালু করা হয়েছে একটি ছাত্রাবাস; যেটির নাম রাখা হয়েছে ‘আরুং আনেই’, অর্থ ‘উজ্জ্বল আলো’।
ছাত্রাবাসটি স্থাপন করা হয়েছে বান্দরবান সদর উপজেলার টংকবতি ইউনিয়নের টংকাবতি বাজার এলাকায়। জেলা শহর থেকে ওই এলাকার দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। তার চারপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি ম্রো গ্রাম। আরেক পাশে ম্রো অধ্যুষিত চিম্বুক পাহাড়।
তবে ছাত্রাবাসটিতে এখন থাকার সুযোগ পাচ্ছে দুর্গম এলাকার শিশুরা। শুরুতেই সেখানে থাকছে ৫০ জন ছাত্র ও ২০ জন ছাত্রী।
এটির উদ্যোক্তারা বলছেন, এখনও অনেক দুর্গম এলাকায় কোনো স্কুল নেই। অনেক শিক্ষার্থীর শহরে এসে লেখাপড়ার করার সামর্থ্যও নেই। আর যেসব এলাকায় স্কুল আছে সেখানে পড়াশোনার মান ভালো না। সেখানে পড়ে পরে অন্য কোনো ভাল প্রতিষ্ঠানে পড়ার মত মানসম্মত শিক্ষার্থী হিসেবে তারা তৈরি হয় না। কোনো প্রতিযোগিতায়ও তারা টিকতে পারে না। যে কারণে শুধু দুর্গম এলাকার শিশুরা ছাত্রাবাসে থেকে লেখপাপড়া করার সুযোগ পাবে। পাশাপাশি তাদেরকে শেখানো হবে ম্রো ভাষা।
রোববার ছাত্রাবাসটি উদ্বোধন করেন টংকাবতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাংয়ং ম্রো।
এ উপলক্ষে লেখাপড়া নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ছাত্রাবাসের প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয় একটি আলোচনা সভা। এতে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও টংকাবতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
ইউপি চেয়ারম্যান মাংয়ং ম্রো বলেন, “ছাত্রাবাসটি সবার উদ্যোগে গড়ে উঠেছে। বান্দরবানে ম্রোরা পাহাড়িদের মধ্যে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এরকম ছাত্রাবাস আরও হওয়া দরকার আছে। এখন আপাতত বেড়া দিয়ে কাঠের ঘর হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। ভবিষ্যতে জেলা পরিষদ অথবা উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ভবন তৈরি করার চেষ্টা করব।
“পাশেই একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রয়েছে। সব শিশুরা সেখানেই পড়বে। ছাত্রাবাসে ১০০ জন থাকার মত হলেও আপাতত ৭০ জনকে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া পাশে আরেকটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। ভবিষ্যতে ছাত্রাবাসে আরও শিক্ষার্থী নিয়ে আসা হবে। নিজের ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে সব শিশুদের জন্য কম্বল ও সোলার প্যানেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে সবকিছুর মূলে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে।”
মাংয়ং ম্রো বলেন, আগে ম্রো শিক্ষার্থী কম ছিল। এখন সাত উপজেলায় দিন দিন শিক্ষার্থী বাড়ছে। তারা যদি ঠিকমত পড়াশুনা করতে পারে এবং শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে। তাহলে ভবিষ্যতে তারাও সমাজকে ভাল কিছু দিতে পারবে। সমাজ একদিন তাদের থেকে উপকৃত হবে। যার কারণে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করানোর জন্য অভিভাবকদের কষ্টসহ্য স্বীকার করতে হবে।
ছাত্রাবাস ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও ছাত্রাবাসের উদ্যোক্তা সিংলক ম্রো বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে সবার উদ্যোগে একটি ছাত্রাবাস করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে এতদিন হয়ে উঠেনি। অবশেষে সবার চেষ্টায় শিশুদের থাকার জন্য ও ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটি ছাত্রাবাস করতে পেরেছি। কেউ বাঁশ দিয়েছে, কেউ কাঠ দিয়েছে। কেউ কেউ অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। তবে শুধু ছাত্রাবাস তৈরি করলেও হবে না। এটাকে ভালভাবে পরিচালনা করার জন্য সবার মধ্যে ঐক্য, সংহতি ও সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে।
দক্ষিণ হাঙ্গর মৌজা হেডম্যান পারিং ম্রো বলেন, এতদিন জায়গার অভাবে ছাত্রাবাসটি করা যায়নি। পরে এলাকাবাসী অনুরোধ করেছে কিছু জমি দেওয়ার জন্য। শিশুদের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে ছাত্রাবাসাসের জন্য ৪০ শতক জায়গা দেওয়া হয়েছে। শিশুরা স্কুলে লেখাপাড়ার পাশাপাশি নিজেদের মাতৃভাষা শিক্ষার সুযোগও পাবে।
টংকাবতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ত্বন্বী দাশ বলেন, ছাত্রাবাসে থাকার সুবাদে শিক্ষার্থীরা ভাল পড়াশুনা করার সুযোগ পাবে। এ ছাড়া স্কুলও একেবারে কাছে হওয়ায় নিয়মিত উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পাবে তারা।
“একজন শিক্ষক ও অভিভাবক হিসেবে যতটুকু দেখার দায়িত্ব আমরাও দেখব। এখন প্রতিযোগিতার যুগ। ছেলেমেয়েদের নিয়মিত স্কুলে যাওয়ার উৎসাহ দিয়ে রাখতে হবে। কোনোভাবেই পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই।”
ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াঙান ম্রো বলেন, এর আগে ২০০৯ সালে থানচি ও আলীকদমের মাঝখানে ডিম পাহাড় এলাকায় ‘রুংলেং থার্বা’ নামে সম্পূর্ণ প্রথম ম্রো ভাষার স্কুল ছাত্রাবাস করা হয়েছিল। পরে সেখানে জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হয়।
দেখা গেছে, এই ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা ও পরীক্ষার ফলাফল ভাল করছে। তার কারণ হল, শিক্ষার্থীরা ম্রো ভাষার মাধ্যমে বাংলা ভাষা রপ্ত করছে। ভাষাগত সীমাবদ্ধতা তারা কাটিয়ে উঠছে। কোমলমতি শিশুরা ভাষা না বুঝার কারণে অনেক সময় ঝরে যায়।
ইয়াঙান ম্রো বলেন, এখন ১০৮ জন ম্রো শিশু ছাত্রাবাসে থেকে লেখাপড়া করছে। সে কারণে স্কুলে পড়া যেমন পড়বে, মাতৃভাষাও শিখবে এমন উপলব্ধি থেকে এই ছাত্রাবাসটি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
‘আরুং আনৈ’ ছাত্রাবাসের উদ্যোক্তাদের মতে, সেখানে প্রত্যেকদিন ভোর ৫টা থেকে ৭টা এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত ম্রো ভাষা শিক্ষা পড়ানো হবে। তার জন্য দুজন ম্রো ভাষা শিক্ষক রাখা হবে। স্কুলের পড়া এবং বাড়ির কাজ দেখভাল করার জন্য আলাদাভাবে আরও দুজন শিক্ষক রাখা হবে। তাদের জন্য ছাত্রাবাস কমিটির পক্ষ থেকে দেওয়া হবে বেতন। থাকা-খাওয়া ও খাতা-কলম খরচ বাবদ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর থেকে মাসে নেওয়া হবে ১২০০ টাকা করে। তারপরও অনেকেই দিতে পারবে না।
ছাত্রাবাস পরিচালনা কমিটির সদস্যরা আরও জানান, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকায় ছাত্রাবাস পরিচালনা করা যাবে নাা। কমিটির পক্ষ থেকে অনেক ভর্তুকি দিতে হবে। ম্রোদের মধ্যে পাড়ায় পাড়ায় মাটির ব্যাংকে টাকা জমানোর চল আছে। ১০ বছর আগে এটা চালু হয়েছে। যার যতটুক সাম্যর্থ অনুযায়ী ওই মাটির ব্যাংকে টাকা জমা রাখে। এই ছাত্রাবাসে ভর্তুকির টাকা সেখান থেকে নেওয়া হবে।
বান্দরবানে ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে মারমাদের পরেই ম্রোরা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। জেলার সাতটি উপজেলায় তাদের বসবাস রয়েছে। পাহাড়ে জুমচাষ করে আসা এই ম্রো জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ লোকজন এক সময় ছিলেন প্রকৃতির পূজারী। এর বাইরে এখনও কিছু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রয়েছে।
২০২১ সালে করা গৃহগণনা ও জনশুমারী তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ম্রো জনসংখ্যা ৫১ হাজার ৪৪৮ জন। কিন্তু তাদের সামাজিক সংগঠন ম্রো সোস্যাল কাউন্সিলের মতে, ২০০৫ সালে নিজেদের করা জরিপে তাদের জনসংখ্যা ৬৭ হাজার ৩৭৬ জন পাওয়া গেছে।