Published : 06 May 2025, 06:44 PM
মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের আলম মীরের কান্দি গ্রামের শতবর্ষী একটি বটগাছকে ঘিরে ‘পূজা-মানতের মত শিরক কাজ হচ্ছে’ এমন অভিযোগ তুলে সেটি কেটে ফেলেছেন স্থানীয় আলেমরা।
সোমবার সকাল ৯টার দিকে তারা সেখানে গিয়ে গাছ কাটা শুরু করেন। এরপর একে একে ডালপালা থেকে শুরু করে দণ্ডায়মান কাণ্ডগুলো কেটে ফেলা হয়।
বটবৃক্ষ কাটার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেক স্থানীয় বাসিন্দা বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিরখাড়া ইউনিয়নের কুমার নদের আলম মীরের কান্দি গ্রামের খেয়াঘাটে প্রকৃতির নিয়মে জন্ম নেওয়া বটবৃক্ষটির ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ রয়েছে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। সেই বিশ্বাস থেকে নদীর পাড়ের এই বটবৃক্ষে লাল শাড়ি ও কাপড় বেঁধে এবং মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালিয়ে অনেকেই মানত করেন। এই মানত করা ধর্মীয় দৃষ্টিতে ‘শিরক ও বিদআত’ (ইসলামি শাস্ত্রবিরুদ্ধ কাজ) বলে আখ্যা দিয়ে এই গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তি সোমবার সকালে করাত দিয়ে গাছ কেটে ফেলেন।
শিরখাড়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বাবুল হোসেন বলছিলেন, “স্থানীয় কয়েকজন বটগাছটি কেটে ফেলেন। তারা গাছ কাটার বিষয়ে আমাদের কিছু জানায়নি। তবে লোকমুখে শুনেছি, যারা গাছ কেটেছে, তারা দাবি করেছেন- এই বটগাছে এসে মানুষ পূজা করে; মানত করে। অনেকে মনে করত, গাছটির অলৌকিক ক্ষমতা আছে।
“এই বিষয়টিই এক শ্রেণির লোকজন মনে করেছে যে, বিদআত ও শিরক। এই অভিযোগ তুলে তারা গাছটি কেটে ফেলেছে। তাদের হাত থেকে এখন গাছও বাঁচতে পারতেছে না। এই হলো অবস্থা। এখন প্রশাসনের কাছে দাবি করছি, এই ঘটনার একটি সুষ্ঠু বিচার তারা করুক।”
গাছটি কেটে ফেলার বিষয়ে স্থানীয় পরিবেশ কর্মীরা মনে করছেন, ওই বটবৃক্ষ থেকে এই এলাকার প্রচুর মানুষ অক্সিজেন গ্রহণ করতেন। তাছাড়া বট গাছের ফল খেয়ে প্রচুর পাখি বেঁচে থাকত। বটবৃক্ষটি কেটে ফেলার সঙ্গে যারা জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও করেন তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা সোহেল আহমেদ বলেন, “এই গাছটি তো মানুষের কোনো ক্ষতি করেনি। তবুও এক শ্রেণির লোক এখানে মানত করে তা মেনে নিতে না পেরে পুরো গাছটিকে হত্যা করলো। যা অত্যন্ত খারাপ একটি উদাহরণ হয়ে রইল। এই ঘটনা যাতে আবারো না ঘটে তার জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।”
এদিকে বট গাছ কাটা নিয়ে তোলপাড়া সৃষ্টি হলে মঙ্গলবার সকালে মাদারীপুর সদর উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও বনবিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে যান।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মাদারীপুর বন নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের বন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “আমি সকালেই আলম মীরের কান্দি গিয়ে বট গাছটি দেখে এসেছি। গাছটির ৯০ শতাংশই কেটে ফেলা হয়েছে। মাটির সঙ্গে ১০ ফুট উচ্চতার দুটো মূলকাণ্ড ডালাপালা বিহীন দাঁড়িয়ে আছে। বাকি সব মূলকাণ্ড ও ডালাপাল কেটে ফেলা হয়েছে।
“আমি গাছটির মালিক হান্নান হাওলাদারের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, মাত্র ১৫০০ টাকায় গাছটি বিক্রি করেছেন। অথচ গাছটির আর্থিক মূল্য এর চেয়ে অনেক বেশি হওয়ার কথা। আমরা তদন্ত করছি। তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করব। পরে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।”
মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, “এই বট গাছটি তো কারো কোনো ক্ষতি করেনি। এই গাছ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন দেয়। গাছে পাখিরা বাসা বাঁধে, ফল খায়।
কিন্তু এই পুরনো বটগাছে বিভিন্ন ধরনের মানুষ নানা রকমের মানত করে, এটা কিছু লোকজন ভালো চোখে দেখে না। তাই তারা পুরো গাছটিকে নির্মমভাবে হত্যা করল।
“গাছের উপরের ডালপালাসহ নিজের গোড়ার অংশগুলোও কেটে ফেলা হয়েছে। এই ঘটনার যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করছি।”
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, “শিরখাড়ায় যে বট গাছটি স্থানীয়রা কেটে ফেলেছে। আমরা সেখানে প্রশাসনের লোক পাঠিয়েছি। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা এখন গা ঢাকা দিয়েছে। আমরা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”
গাছ কাটার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা গা ঢাকা দিয়েছেন, ফলে চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য সংগ্রহ করা যায়নি।