আমরা পা টিপে টিপে হাঁটছি। যে কোনো সময় পিছলে পড়ার সম্ভাবনা। একবার পড়লেই ঢালুর শেষ মাথায় না যাওয়া পর্যন্ত থামার সুযোগ নেই, থামাবারও কেউ নেই।
Published : 18 Dec 2017, 12:04 PM
এডুকেশন বিল্ডিং থেকে বের হয়েই তুষারপাত দেখে আমরা ভড়কে গেলাম। আবহাওয়া বার্তায় আজ তুষারপাতের কোনো সঙ্কেত ছিলনা। আমরা প্রত্যেকেই তাই সাধারণ জুতা পরে এসেছি। এই জুতা দিয়ে মাইনাস সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ঠাণ্ডা মোকাবেলা করা যায়। এর কম তাপমাত্রার জন্য দরকার ‘উইন্টার বুট’।
‘উইন্টার বুট’ না বলে বলা ভালো ‘পায়ের জাহাজ’। বিশাল আকৃতির জুতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারীও বটে। উইন্টার বুট কিছুটা তুষারবান্ধব। ওই জুতাগুলো পরলে তবু তুষারপাতের ফলে সৃষ্ট পিচ্ছিল রাস্তায় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
আজকে আমি যে জুতাটি পরে এসেছি, তা শীত মোকাবেলার জন্য যথেষ্ঠ হলেও পাহাড়ি পথ বেয়ে নামার জন্য যথোপযুক্ত নয়। তাই আজকে হেঁটে না নেমে গড়িয়েই নামতে হয় কিনা, তাই ভাবছি।
ক্লাস শেষ করে আমার সুপারভাইজারসহ আমরা বাসার দিকে হাঁটছিলাম। সুপারভাইজার আমাকে কালো বরফ থেকে সাবধান থাকতে বললেন। কালো বরফ আরও পিচ্ছিল। যদিও তাপমাত্রা মাইনাস ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে না নামলে সাধারণত কালো বরফ জমেনা। কিন্তু একেবারেই যে জমে না, তাও বলা যায় না।
তুষার গলে ঠাণ্ডায় এক ধরনের বরফ তৈরি হয়। এগুলো খুব স্বচ্ছ হওয়ায় এবং সাদা তুষারের নীচে থাকায় সহজে চোখে পড়ে না। তবে এর নাম কেনো কালো বরফ, তা স্পষ্ট নয়। সম্ভবত স্বচ্ছতার কারণে কালো রঙের রাস্তার সাথে মিশে কালো বর্ণ ধারণ করে। ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিকেরা অবশ্য এর মধ্যে বর্ণবাদী কোনো কারণ খুঁজে পেলেও পেতে পারেন।
এই কালো বরফগুলো সত্যিই বিপদজনক। সবচেয়ে বিপদজনক চালকদের জন্য। রাস্তায় চলতে থাকা গাড়ির নিয়ন্ত্রণ রাখা এ সময় খুবই কষ্টসাধ্য। নির্দিষ্ট গতিসীমার মধ্যে না চালালে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। লোকজন তবুও বরফবান্ধব জুতা পরে হাঁটতে পারে।
এই তুষার, বরফ এবং শীত থেকে বাঁচার জন্য শুধু যথাযথ জুতা ব্যবহারই যথেষ্ঠ নয়। এর সাথে জামা, প্যান্ট, জ্যাকেট ও টুপির বিষয়ও রয়েছে। তাই কোনো এক তুষারপাতের দিনে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে বের হতে গেলে নিজের আসল অবয়ব খুঁজে পাওয়া ভার। যদিও খুব হালকা ধরনের কিছু শীতের পোশাক পাওয়া যায়। এগুলো আবার এত দামী যে সবার পক্ষে বহন করা কঠিন।
শীত ও তুষারপাত সম্পর্কে আগে থেকেই ধারনা ছিল। শীত জয় করার সাথে যে বীরত্বের সম্পর্ক আছে তাও জেনেছিলাম ছোটবেলাতেই। বড় ভাইয়া রুশ রূপকথা বা উপকথা সমগ্র টাইপের একটি বই এনে দিয়েছিলেন। সে বইয়ের গল্পে গল্পে ছিলো ভয়াবহ শীত আর সেই শীত জয় করার গল্প।
পশুপাখি থেকে মানুষ, সবারই শীত থেকে বাঁচার জন্য নানা প্রস্তুতির গল্প। সেখান থেকে শীতের তীব্রতা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। বুঝেছি- শীতে কাহিল হওয়া মানেই জীবনে পরাজিত হওয়া।
হল্যান্ডে যখন ছিলাম, তখনও মাইনাস তাপমাত্রা পার করে এসেছি। খারাপ লাগেনি। শীত আমার পছন্দই। পরিচিতজনদের কাছ থেকে কানাডার সম্পর্কেও একটা ধারণা পেয়েছিলাম। ছোটভাই নাজমুল আমাকে ‘মোহময় কানাডা’ নামে একটি বইও উপহার দিয়েছিল। সেখান থেকেও কানাডা ও কানাডার শীত সম্পর্কে কিছুটা ধারণা হয়েছিল।
কিন্তু এই শীত যে এতো ভয়াবহ, তা এবার উপলব্ধি করলাম। আরও ভয়াবহ বিষয় হলো মাত্র মাইনাস ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অভিজ্ঞতা পেয়েছি। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে এটা নাকি মাইনাস ৪০-৪৫ ডিগ্রিতে নামতে পারে!
স্বস্তির কথা হলো- এখানকার রাস্তা ও তুষার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দায়িত্বশীল বিভাগ হাঁটার পথ ও রাস্তা থেকে যতো দ্রুত সম্ভব তুষার সরিয়ে ফেলতে সর্বদা তৎপর থাকে। মাঝে মাঝে তাই রাস্তার পাশে বা মোড়ে মোড়ে তুষারের পাহাড়ও দেখা যায়।
তুষার ব্যবস্থাপনা এবং বাসা, বাড়ি, অফিস-আদালতের তাপ ব্যবস্থাপনা এরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যার কারণে দূর্ভোগ চরমে পৌঁছানোর আগেই তা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। এই দক্ষতা একদিনে তৈরি হয়নি। শীত, তুষার এবং বরফে নাকাল হতে হতে একসময় দক্ষ হয়ে উঠেছে।
যে কোন দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। দুর্যোগ যখন ভালোভাবে মোকাবেলা করা হয়, তখন আর তাকে দুর্যোগ বলা হয় না। এখানে তাই অতি শীত কিংবা তুষার ঝড় আর দুর্যোগের মধ্যে পড়ে না। বাংলাদেশের দুর্যোগের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য।
তবে মন্ট্রিয়লের কর্তৃপক্ষের হাজারও সচেতনতা সত্ত্বেও কর্দমাক্ত তুষারের মধ্যে যখন পা টিপে টিপে হাঁটতে হয়, সাদা তুষারের আড়ালের কালো বরফই তখন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
লেখক:
পি এইচ ডি গবেষক, ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন, ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়, মন্ট্রিয়ল, কানাডা।
ইমেইল: [email protected]
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |