মন্ট্রিয়লের গালগল্প: মাউন্ট রয়ালে এক বিকাল

ব্রাউন বিল্ডিং থেকে বের হয়ে এডুকেশন বিল্ডিং যাওয়ার পথেই পরিবর্তনটা খেয়াল করলাম। স্বাভাবিকভাবেই মন বিদ্রোহ করে বসলো।

হেলাল হোসেন ঢালী, কানাডার মন্ট্রিয়ল থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2017, 05:23 AM
Updated : 20 Nov 2017, 12:42 PM

কিছুতেই আর রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না। অথচ বেশ কয়েকটা কাজ এখনো বাকি। ব্রাউন বিল্ডিং থেকে এডুকেশন বিল্ডিং-এ যেতে লাগে মাত্র পাঁচ মিনিট। এখানে এসেছিলাম ‘উইন্টার ১০১’ শীর্ষক একটি কর্মশালায় অংশ নিতে। মন্ট্রিয়লে কোন সময়টাতে বেশি ঠাণ্ডা পড়ে, কীভাবে এই ঠাণ্ডা মোকাবেলা করতে হয়, কোথায় শীতের কাপড় পাওয়া যায়, কোথায় শীতের জুতা পাওয়া যায় ইত্যাদি ইত্যাদি।

কর্মশালার মডারেটর ভদ্রমহিলা মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না যে পোশাক কেনার ক্ষেত্রে সবাই যেন স্টাইলের চেয়ে প্রয়োজনটাকেই মাথায় রাখি। কেননা, তার ভাষায়- “ইফ ইউ আর আন্ডারড্রেস্‌ড্‌, ইউ আর লেস স্মার্ট। অলদো দোজ আর স্টাইলিশ।” সুতরাং দেশ থেকে আনা ওভারকোটটি আগামী সামার ছাড়া পরা যাবে না, সেটা ততক্ষণে বুঝে গেছি।

পাশে বসা শাউলীও দেখি মিটি মিটি হাসছে। আমি অবশ্য ওর হাসার কারণটা জানি। কর্মশালায় আসার আগেই ও আমাকে বলছিল যে কর্মশালার পর ও একটু নিকটবর্তী কুরিয়ার সার্ভিসে খবর নেবে। ওর বর কুরিয়ারে ওর জন্য একগাঁদা কাপড় পাঠিয়েছে, ও সেগুলো আনতে যাবে।

আসার সময় তিন স্যুটকেস কাপড় নিয়ে আসলেও ওর আরও কাপড় দরকার বলে সে তার বরকে জানিয়েছিল। তাই বর ওকে খুশি করার জন্য এই ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু কর্মশালার ভদ্রমহিলার কথা শুনে বেচারা হাসছে আর মন্ট্রিয়লের শীতের কাপড়ের দোকানের ঠিকানা খুঁজছে। এতক্ষণে বুঝে গেছে, ওর আনা তিন স্যুটকেস আর ওর বরের পাঠানো সব কাপড় আগামী সামারের জন্যই রেখে দিতে হবে।

ব্রাউন বিল্ডিং-এর কর্মশালায় আসায় একটা লাভ হয়েছে। শীতের রঙ এখানে ব্রাউন নয়, তুষারে ঢাকা সাদা মন্ট্রিয়ল তখন কীভাবে কোথায় রঙিন হয়ে ওঠে, তা মূলত এই কর্মশালায় এসেই জানতে পারলাম। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, জানুয়ারির ভরা শীতে আর কোথাও না গেলেও ইগলু ফেস্টে যাবই।

কিন্তু মুশকিল হলো- খালি বেড়ালে তো হবে না। পড়তে হবে, গবেষণা করতে হবে, ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। তাই ব্রাউন বিল্ডিং-এর কর্মশালা শেষ করেই একটু কাজ ও পড়াশোনা করার পরিকল্পনা ছিলো।

মধ্যাহ্ন ভোজনের আগ পর্যন্ত ছিলাম ম্যাকলেনান লাইব্রেরিতে। না, পড়াশোনার জন্য নয়। সেখানেও আরেকটা কর্মশালা ছিলো। ফ্যাসিলিটেশন ও লিডারশিপ ডেভলপমেন্ট। ম্যাকগিলের সমস্ত শিক্ষার্থীদের যথাযোগ্য কর্মশালার মডারেটরের ভাষায় ‘পারফেক্ট’ বানাতে চায়। তাই সারাদিন যেহেতু কোনো কাজের কাজ হয়নি, বিকাল ও সন্ধ্যাটা কাজে লাগানোর প্রত্যয় নিয়ে শাউলীকে ‘বাই বাই’ বলে যেই আমার রুমের দিকে রওনা দিয়েছি, তখনই পরিবর্তনটা খেয়াল করলাম।

অসাধারণ আবহাওয়া। রৌদ্র ঝলমলে দিন, পরিষ্কার আকাশ। আর আমি যেদিকে মুখ করে আমার রুমে যাচ্ছি, সেদিকেই মাউন্ট রয়াল। বুঝলাম- “রুমে যেতে মন নাহি চাইছে”।

কী আর করা, ফোন দিলাম জামান ভাইকে। ফোনে পাচ্ছি না। ভয়েজ মেইলে চলে যাচ্ছে আর শুনতে পাচ্ছি মো.নুরুজ্জামান খান। জামান ভাই ম্যাকগিলে সেশনাল লেকচারার হিসেবে পড়াচ্ছেন। সোমবার তার একটা ক্লাস আছে। সে ক্লাসের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা। তবুও ফোন দিয়েছিলাম, যদি কোনোভাবে রাজি করানো যায়।

আমি জানি তাকে রাজি করাতে পারবো। একটু বকাঝকা করবে, পরে রাগ ঝাড়বে। কিন্তু ‘না’ বলতে পারবে না। ভদ্রলোক অসম্ভব আনন্দপ্রিয়। তবে তার দুই-একটি পছন্দের বিষয় বাদে বেশিরভাগ সময় নিজে কোনো উদ্যোগ নেন না। অবশ্য উদ্যোগ নিয়ে তাকে ডাকলে ‘না’ বলেন না।

জামান ভাই অবশেষে কল ব্যাক করলেন। যথারীতি একটু গাইগুই করলেও শেষ পর্যন্ত আমার সাথে মাউন্ট রয়াল অভিযানে রাজি হলেন।

কিছুদূর গিয়ে দুই ধাপ সিঁড়ি পার হতে না হতেই হাঁপিয়ে গেলাম। জামান ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম- “ভাই, কতো দূর?”

“মাত্র তো মিয়া পাঁচ ভাগের এক ভাগ উঠছো”- উত্তর জামান ভাইয়ের। বলে কী লোকটা! আমি এতদিন ভেবেছি, আমি আমার রুমে আসতে অর্ধেকটা পাহাড় ভাঙি।

সিঁড়িগুলো কাঠের। তুষার পড়ে কিছুটা পিচ্ছিল হয়ে আছে। পা ফেলতে হচ্ছে সাবধানে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকদের অনেকেই তাদের পাহাড়চূড়া অভিযান শেষ করে নিচের দিকে নামছিলেন। নানারকম ভাষা শুনতে পাচ্ছিলাম, যদিও বুঝছিলাম না কিছুই।

অবশেষে উঠলাম মাউন্ট রয়ালের চূড়ায়। চূড়ার ঠিক মাঝখানে একটি ‘শ্যালে’। শ্যালে হলো পাহাড়ে অবকাশ যাপনের জন্য নির্মিত বাড়ি। শ্যালের পেছনে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। মাঠের চারপাশটা ন্যাড়া গাছে ভর্তি। শীতের শুরুতেই সব পাতা ঝরে গেছে। তবে এত বন যে ন্যাড়া গাছগুলোও এক ধরনের গভীর জঙ্গলের আবহ তৈরি করেছে। মাঠের সবুজ ঘাসগুলো দেখা যাচ্ছে না। তুষারে ঢেকে আছে।

শ্যালের সামনের দিকটা অনেকটা আলোকিত। আমরা সামনের দিক দিয়েই উঠেছি। তাই এদিকটা দিয়ে পাহাড় নেমে গেছে। বরাবর তাকালে তাই পাহাড়ি গাছগুলো চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে মন্ট্রিয়লের সুউচ্চ ভবনগুলোর ছাদ। শহরের সীমানা ঘেঁষে সেইন্ট লরেন্স নদীটা দেখা যায়। আমার দেশের নদীগুলোর কথা মনে পড়ে। সব নদী দেখতে প্রায় একই মনে হয়।

কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বুঝতে পারিনি। নামতে হবে। মাউন্ট রয়ালে ওঠার আরেক দিকের রাস্তায় একটি কৃত্রিম হ্রদ আছে। আজ  আর সেটা দেখার সময় পাওয়া গেল না।

লেখক: পি এইচ ডি গবেষক, ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন, ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়, মন্ট্রিয়ল, কানাডা

ইমেইল: helaldhali@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!