পাহাড়ি ঢালু পথ ধরে নামছি। যেতে যেতে জাহাজটি কাছ থেকে দেখতে পারব তো? কাছে না গেলে এটি কী জাহাজ, কতো তলা জাহাজ- তা বোঝা যাবে না।
মিনিটি দশেক হাঁটলেই আমাদের সেইন্ট লরেন্স নদীর পাড়ে পৌঁছে যাওয়ার কথা। সেইন্ট লরেন্সের মাঝ দিয়েই ছুটে চলেছে জাহাজটি। কিন্তু কাছাকাছি যেতে যেতে এত এত মোহনীয় সুর কানে আসছিল যে, হাঁটার গতি আর বাড়াতে পারছিলাম না।
এখানে রাস্তায় রাস্তায় এত সঙ্গীতের আয়োজন! নিজের মতো গাইছে, কারো ইচ্ছে হলে পয়সা দিচ্ছে। কেউবা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। আমরাও পাশ কাটিয়ে চলে আসলেও ওই সুরের যাদু আমাদের মোহাবিষ্ট করে ফেলেছিল।
অবশ্য জাহাজ দেখা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। মন্ট্রিয়লে আসার পর থেকেই ভাবছিলাম- কবে পুরনো বন্দরে যাব। আসলে বন্দর নয়, সেইন্ট লরেন্স নদী দেখাই লক্ষ্য।
সবাই বলছিল, “শীত আসার আগেই ঘুরে আস।” আমার মনটাও খচ্ খচ্ করছিল। একটি শহরে আছি আর সেই শহরের নদী দেখব না? তাছাড়া আমাদের নদীপাগল বন্ধু শেখ রোকন বলে দিয়েছে, “মন্ট্রিয়লে গিয়ে নদীর কাছে যাবেন।”
অনেকদিন ধরেই সাজ্জাদকে বলছিলাম- “চলেন একদিন ঘুরে আসি।” সাজ্জাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। এখানে ম্যাকগিলের এপিডিমিওলজি বিভাগে পি এইচ ডি করতে এসেছে। সাথে ওর স্ত্রী তানজিলা ভাবীকেও নিয়ে এসেছে।
সাজ্জাদের জন্য হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। সে বললো, তানজিলার সাথে আলাপ করে আমাকে জানাবে। এরপর অনেকদিন খবর নেই। তানজিলা ভাবী এর মধ্যে একদিন দাওয়াত দিলেন। জুকিনি আর চিংড়ির চচ্চরি খেতে খেতে সাজ্জাদকে আবার মনে করিয়ে দিলাম। আমাদের পরবর্তী সপ্তাহের সাপ্তাহিক বন্ধের দিনের গন্তব্য ঠিক হলো- সেইন্ট লরেন্স নদী।
এরপর কতো কতো ঘটনা ঘটে গেছে। ইংরেজরা এসেছে। এখানকার আদিবাসীদের কোণঠাসা করে ইউরোপিয়ানরা গড়ে তুলেছে আধুনিক মন্ট্রিয়ল। এই নদীর পাড়েই উঠেছিল মন্ট্রিয়লের সবচেয়ে বড় বন্দর। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে এটি পুননির্মাণ করা হয়। এখনকার বন্দরটি তাই পর্যটকদের জন্যও একটি আকর্ষণীয় জায়গা।
আমরা নদীর পাড় ধরেই হাঁটছিলাম। প্রখর রোদে ভালোভাবে তাকাতে পারছিলাম না। রোদচশমা আনা হয়নি। তবে তানজিলা ভাবী আমাদের পথ দেখালেন। আমাদের অদূরে অবস্থিত ভ্রাম্যমাণ একটি চশমার দোকান তিনিই আবিষ্কার করলেন। এই চোখ ধাঁধানো রোদে এই আবিষ্কার আমাদের কাছে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হল না।
কাছে গিয়ে চশমার দাম শুনে আমাদের সবার খুশিতে আগডুম অবস্থা। প্রতিটি রোদ চশমা মাত্র পাঁচ ডলার! সবাই মিলে হামলে পড়লাম। সবাই বলতে আমি, সাজ্জাদ, তানজিলা ভাবী আর রাজিব। রাজিবও ম্যাকগিলে পি এইচ ডি করছে।
চশমা কেনার পর আমাদের হাঁটার গতি আবার কমে গেল। এখানে দাঁড়াই, ওখানে দাঁড়াই। ছবি তুলতে তুলতে শহরের সবচেয়ে বড় নাগরদোলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। এটাতে উঠে পুরো মন্ট্রিয়ল শহর দেখা যায়। কিন্তু ওই নাগরদোলায় ওঠার জন্য টিকিট নিতে হবে। টিকিটের দাম শুনে আমার উচ্চতা ভীতি বেড়ে গেল।
আমরা তখনও পাড় ধরে হেঁটেই চলেছি। মূল নদীতে পৌঁছাইনি। ওখানে পৌঁছাতে আরও মিনিট পাঁচেক লাগবে। এমন সময় দড়ি বাহন চোখে পড়লো। দড়ির একমাথা থেকে আরেক মাথায় আমাদের মাথার উপর দিয়ে ছুটে চলেছে সাহসী পর্যটকেরা। আমরা দেখছি আর বলছি- এটা অনেক সাহসের কাজ বটে!
অবশেষে সেইন্ট লরেন্সের কাছে পৌঁছালাম। পরিষ্কার সবুজাভ পানি টলটল করছে। আমার মনে পড়লো বুড়িগঙ্গার কথা। বেচারি বুড়িগঙ্গা নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারলে নিশ্চিত কানাডায় আসার জন্য আবেদন করতো।
তবে আমি বাংলাদেশেও যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের টলটলে পানি দেখেছি। সেটা অবশ্য শহরের বাইরে বহুদূরে।সিরাজগঞ্জের নাটুয়ারপাড়া চরে যাওয়ার পথে, আর কুড়িগ্রামের চিলমাড়ি বন্দরে।
বন্দর নির্মাণ ও এর রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনে সেইন্ট লরেন্সকেও শাসন করতে হয়েছে। এই শাসনে নদীর আকৃতি প্রকৃতিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে একটা পানির বোতলও ভেসে থাকতে দেখলাম না। নদীর পানিতে ময়লা ফেলা নিষেধ।
তাছাড়া রয়েছে নিয়মিত পানি শোধনের ব্যবস্থা। নদীর মাঝখানে একটা ছোট্ট দ্বীপ, দুই পাশে শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দুটি সেতু এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে নদীর সৌন্দর্য কোনোভাবে কমেনি। মাঝখানের দ্বীপে যাওয়ার জন্য রয়েছে মেট্রোপথের ব্যবস্থা।
সন্ধ্যা নামার পরপর আমরা ফিরে চললাম পুরাতন বন্দর থেকে, মূল মন্ট্রিয়লে। সন্ধ্যার বিষন্নতা আমাদের মনে করিয়ে দিলো- এখানে আধুনিকতার বিকাশ ঘটেছে নদীকে মেরে নয়, বাঁচিয়ে রেখেই।
লেখক: পি এইচ ডি গবেষক, ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন, ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়, মন্ট্রিয়ল, কানাডা।
ইমেইল: helaldhali@gmail.com
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |