মন্ট্রিয়লের গালগল্প: ‘থম্পসন হাউজ’ যেন আরেক মধুর ক্যান্টিন

পরিচয়ের চতুর্থ দিনে দুপুরের খাবারের সময় শাউলী আমার কাছে ২০ ডলার ধার চেয়ে বসলো। ভাগ্যিস আজই কিছু ডলার তুলে রেখেছিলাম। তাই চাওয়া মাত্রই বাহক না হওয়া সত্ত্বেও শাউলীকে ২০ ডলার দিতে পারলাম।

হেলাল হোসেন ঢালী, কানাডার মন্ট্রিয়ল থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Nov 2017, 12:02 PM
Updated : 28 Nov 2017, 12:02 PM

তবে আমার চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল কী না কে জানে? ফিসফিস করে শাউলী ডলার ধার চাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করা শুরু করলো। ব্যাখ্যাটা পরে বলছি।

ম্যাকগিলের প্রথম দিনই আমার তত্ত্বাবধায়ক ‘থম্পসন হাউজে’ আমাদের দুপুরের খাবার খাওয়ালেন। আমি মন্ট্রিয়লে পৌঁছানোর আগেই আমার তত্ত্বাবধায়ক ইমেইলে আমাকে দাওয়াত দিয়ে রেখেছিলেন। আমি ছাড়াও ম্যাকগিলের প্রথমবারের মতো মধ্যাহ্নভোজে নতুন আসা শাউলী, তৃতীয় বর্ষের দিলমুরাত এবং শেষবর্ষের এলিসও ছিল।

আমরা সবাই একই তত্ত্বাবধায়কের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি করছি। ওইদিনই আমাদের তত্ত্বাবধায়ক এলিসকে বললেন - “তোমাদের শুক্রবারের দলীয় মধ্যাহ্নভোজ শুরু করো।”

সেদিনই আমরা এলিসের ইমেইল পেলাম। আগামী শুক্রবার ‘থম্পসন হাউজে’ দুপুরে খাবারের দাওয়াত দিয়েছে এলিস। মেইল লিস্টে আর কে কে ছিল, দেখা হয়ে ওঠেনি। আরেকটা খাওয়ার দাওয়াত পেয়ে আর কোনও কিছু মাথায় আনলাম না।

শাউলীর টাকা ধার চাওয়ার কারণ সেই ইমেইলটাই। সেখানে এলিস লিখেছিলো- “আই উড লাইক টু ইনভাইট ইউ অল ফর আওয়ার ফ্রাইডে লাঞ্চ এট থম্পসন হাউজ।”

শাউলী ভেবেছিল যেহেতেু দাওয়াত, সাথে টাকাপয়সা না থাকলেও সমস্যা নেই। দাওয়াত বলে কথা। শাউলী মূলত চীনা। আমার ধারণা ছিলো, আমরা বাংলাদেশিরাই শুধু খাবারের দাওয়াত বলতে ‘ফ্রি’ খাওয়া-দাওয়া বুঝি। এখন দেখছি পুরো এশিয়ার লোকদেরই একই রকম ধারণা।

এলিস মূলত অনেক আগে থেকেই প্রতি শুক্রবারে সবাইকে নিয়ে একসাথে থমসন হাউজে একই সাথে দুপুরের খাবার খাওয়ার আয়োজন করে আসছে। ওইদিন বিভিন্ন ব্যাচের পিএইচডি শিক্ষার্থীরা যার যার সময়সুযোগ মতো দুপুর বেলা চলে আসে। কেউ সাথে করে খাবার নিয়ে আসে, কেউ ওখানেই ‘অর্ডার’ করে খেয়ে নেয়। এই মধ্যাহ্নভোজের উদ্দেশ্য ‘জম্পেশ’ আড্ডা। শুধু আড্ডা বললেই চলে না।

এই আড্ডায় উপস্থিতজনরা বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে আসা। যেমন সৌদি আরব থেকে নাজ ও মোহাম্মদ, আফগানিস্তান থেকে মুস্তাফা, চীন থেকে মাইক ও শাউলী, মিশর থেকে ইহাব, ইরান থেকে মেহেদী, মেক্সিকো থেকে অ্যাড্রিয়ানা, টরন্টো থেকে এলিস, গ্রীস থেকে কোস্তাস ও এরি। এরকম আরো অনেকেই।

‘থম্পসন হাউজ’ মূলত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েটদের একটা ক্লাব বা আড্ডাখানা। এখানে কেবল মাত্র মাস্টার্স এবং পিএইচডি শিক্ষার্থীরাই অনুমোদিত। অন্যরা আসতে পারেনা। প্রবেশকালে তাই আমাদের পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। এখানে অবশ্য বিভিন্ন রকম স্ন্যাকস ও পানীয় পাওয়া যায়। এর উল্টোদিকেই রয়েছে নয়নাভিরাম খেলার মাঠ। আড্ডার মাঝে মাঝে বাইরে এসে আমরা এই মাঠ ঘেঁষে প্রায়ই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখি।

এখানে ফ্যাকাল্টিদের জন্যও আলাদা একটা ক্লাব রয়েছে। নাম ফ্যাকাল্টি ক্লাব। সেখানে একদিন যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বিখ্যাত গবেষক প্রফেসর এমিরিটাস লিন ডেভিস যেদিন মন্ট্রিয়লে আসলেন, ওইদিন আমাদের তত্ত্বাবধায়ক আমাদের সবাইকে ফ্যাকাল্টি ক্লাবে দাওয়াত দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও আমাদের জন্য শিক্ষক ক্লাব আছে। তবে ব্যবস্থাপনা, প্রবেশাধিকার, ভবনের গঠন প্রভৃতিতে রয়েছে ভিন্নতা। এখানকার ফ্যাকাল্টি ক্লাবে শিক্ষকরা ছাড়া আর কারো প্রবেশ নিষেধ। আমরা অবশ্য এখানকার কোনও শিক্ষক না থাকলে ফ্যাকাল্টি ক্লাবে যেতেও চাইনা। থম্পসন হাউজই আমাদের কাছে প্রাণখোলা আড্ডার জন্য বেশ মনে হয়।

আমাদের থম্পসন হাউজের দুপুরের আড্ডাটা ইতোমধ্যে বেশ জমে উঠেছে। আমরা মিশরের পিরামিড নিয়ে যেমন কথা বলি, তেমনি গ্রিক দেবদেবীর বর্তমান অবস্থা এবং এখনো দেশটির বিভিন্ন এলাকা বা অঞ্চলের নাম ওই সকল দেবদেবীর নামে কেন, সেই আলোচনাও বাদ যায় না।

একদিনের আড্ডায় কথা প্রসঙ্গে এরি জানালো যে, ওর বাংলাদেশ তথা পুরো ভারত উপমহাদেশ সম্পর্কে আগ্রহ আছে। ভারতের স্বাধীনতাকালীন প্রেক্ষাপট নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ভাইসরয়’স হাউজ’ ও ইতোমধ্যে দেখেছে।

ওই আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো -‘লুই কান সম্পর্কে কতোটুকু জানো?’ অনেকটা লজ্জা পেলাম। লুই কান আমাদের সংসদ ভবনের নকশাকার। এর বাইরে আর কিছু জানা ছিল না আমার।

এরি বললো - লোকটা তার পরিবার, সন্তানাদি ছেড়ে সারা জীবন অন্যদের জন্য কাজ করেছে।  মার্কিন স্থপতি হলেও তার সবচেয়ে বড় প্রকল্প ছিল বাংলাদেশের সংসদ ভবন। কান অবশ্য সংসদভবনের পূর্ণ নির্মাণ দেখে যেতে পারেন নি। এরি পরে এ সংক্রান্ত লুই কানের ছেলে নাথানিয়েল কান নির্মিত একটি ছোট চলচ্চিত্রের ভিডিও লিঙ্ক পাঠিয়ে ছিল।

নাজ একদিন বলছিলো সৌদি নারীর গাড়ি চালানোর অনুমতি পাওয়ার কথা। এই সেপ্টেম্বরে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, আগামী জুন থেকে সৌদী নারীরা গাড়ী চালাতে পারবেন। অথচ ২০১১ সালে শেরিফ নামে একটি মেয়ে গাড়ি চালিয়ে সেই ভিডিও ইউটিউবে দেওয়ার পর তার জেল হয়েছিল।

এভাবে প্রতি শুক্রবার ম্যাকগিলের ‘থম্পসন হাউজ’ হয়ে ওঠে ছায়া জাতিসংঘের কনফারেন্স কক্ষ। ঠিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের মত। যাকে বাংলাদেশের মিনি সংসদ বলা হয়। আমাদের মধুর ক্যান্টিন যেখানে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বড় একটা অংশ পার করেছি!

আর হ্যা, শাউলী আমার ২০ ডলার ফেরত দিয়েছিলো। শুধু ফেরতই দেয় নি, সেই যাত্রায় ওকে উদ্ধার করার জন্য আমাকে কান্তাপিয়া নামক একটি কোরিয়ান ম্যাজিকাল রেস্তোরাঁয় খাইয়েছিল। সেই গল্প আরেকদিন।

লেখক: পি এইচ ডি গবেষক, ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন, ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়, মন্ট্রিয়ল, কানাডা।

ইমেইল: helaldhali@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!