মন্ট্রিয়লের গালগল্প: সেলুন কাহন

ভেতরে ঢুকেই বুঝলাম, ঘণ্টা খানেকের আগে আমার পালা আসছে না। অন্তত দশ-বারোজন তো হবেই।

হেলাল হোসেন ঢালী, কানাডার মন্ট্রিয়ল থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Dec 2017, 07:33 AM
Updated : 5 Dec 2017, 07:33 AM

আপাতত একটা চেয়ার খুঁজছি। গায়ের ভারী কাপড়গুলো নামিয়ে রেখে ঘণ্টা খানেক বসে থাকার প্রস্তুতি নিলাম।

আজ যেখানে এসেছি, সেটা একটা ভিয়েতনামিজ সেলুন। নাম ‘কইফুরি ইউনিসেক্স’। সম্ভবত স্বামী-স্ত্রী মিলে চালায়। কম খরচে চুল কাটাসহ চুলের যাবতীয় যত্নআত্তি করা যায়। তাই এখানে একটু ভিড় বেশি থাকে।

তাছাড়া শনি-রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ভিড়টা একটু বেশি থাকে। এখানে অবশ্য আরও কয়েকটা সেলুন আছে। আমি যেটাতে আছি, এটা বুশেট স্ট্রিটে। ভিক্টোরিয়াতেই আরেকটা আছে। তবে এটার একটু সুনাম বেশি।

ভেতরে বসার জায়গা পেলাম। সময়টা খারাপ কাটবে না। আমার পাশের চেয়ারে এক ভদ্রমহিলা পাঁচ-সাত বছরের দু’টো ফুটফুটে মেয়ে নিয়ে অপেক্ষা করছেন। দেখে মনে হলো, বাংলাদেশি হতে পারে। কিন্তু মেয়ে দু’টো এতো সুন্দর করে ইংরেজিতে কথা বলছিলো যে বোঝা যাচ্ছিল না- তারা বাংলাদেশি কিনা।

একটু পর মেয়ে দুটোর মা কথা বলে উঠলো বাংলাতেই। মা বাংলায় বলছেন, ওরা ইংরেজিতে জবাব দিচ্ছে। ছোটটার কতো রকম যে বায়না। তাকে বহুদিন বাইরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয় না। বাবা একবার বহুদিন আগে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলো। তাদের মাম্মি তো এখন তাদেরকে নিয়ে বেড়াতে যেতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি।

ওদের সাথে কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। কিন্তু যেই না ফিরে হাসি দিয়েছি, ছোট্ট মেয়েটা লজ্জায় আর মুখ তুলছে না। মাঝে মাঝে আবার উঁকি দিচ্ছে। অবশেষে ওদের পালা এলে ওরা চুল কাটিয়ে চলে গেল।

বাংলাদেশি পরিবারটার পাশে আরও দু’জন বসে আছে। পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশের হবে। সম্ভবত থাইলান্ডের। ওরাও স্বামী-স্ত্রী। হিসাব কষে বুঝলাম, ওদের পর আমার পালা।

এর মধ্যে এক বয়স্ক ভদ্রলোক এসে পড়ায় ওনাকে আমার আগেই যেতে দিতে হলো। এখানে বয়স্ক নাগরিকদের আলাদা একটা মর্যাদা দেওয়া হয়। বিশেষ করে বয়স্ক, সন্তানসম্ভবা নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে সব জায়গাতেই আলাদা করে মূল্যায়ন করা হয়। আমাদের দেশে আমাদের ছোটবেলায় এটা ছিলো। এখন এই প্রবণতা কমে এসেছে।

 আমার মনে হয়, দেশের বয়স্ক নাগরিকদের এই সুবিধাটা পাওয়া অধিকার। তারা তাদের পুরো জীবন একটা দেশ গঠনে কাজ করে। শেষ বয়সে অন্যান্য নাগরিকদের কাছ থেকে এই ছাড়টা পাওয়া তাদের প্রাপ্য।

অবশেষে আমার পালা এলো। মুশকিলে পড়ে গেলাম- কাকে দিয়ে কাটাবো? ভদ্র মহিলা নাকি ওই ভদ্রলোক? জামান ভাই বলে দিয়েছেন, ভদ্রলোক ভালো কাটেন। সুমন ভাই বলে দিয়েছেন, ভদ্রমহিলা ভালো কাটেন। দ্বিধা-দ্বন্দ্বের এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, যে আগে খালি হয়েছে, তার কাছ থেকেই কাটাই।

ভদ্রলোক চিরুনি, ট্রিমার ও কাচি হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ছোট নাকি মাঝারি আকৃতির করে কাটবো? বুক ধক করে উঠলো। ও ছোট বলতে কতো ছোট বোঝাচ্ছে- কে জানে!

হল্যান্ডে একবার ছোট বলাতে চুলের যে অবস্থা করেছিলো, তাতে কয়েকদিন ক্লাসে টুপি পরে আসতে হয়েছিল। সেটা হয়েছিল ওই সস্তার তিন অবস্থার সূত্র মেনেই। সাগর ভাই তখন হল্যান্ডে। বিভাগীয় বড় ভাই হিসেবে তার কাছে পরামর্শ চাইলাম- কম খরচে কোথায় চুল কাটাতে পারবো? তিনি মরক্কোর একটি সেলুনের সন্ধান দিয়েছিলেন।

মসজিদের ভেতরে একপাশে মরক্কোর একজন কারিগর কাটাতো। আমি আর মোহন সেখানে মাসে একবার যেতাম। মোহন আমার বন্ধু, আমরা একই বিভাগে পড়েছি। ওই সেলুনটি ছিলো আমাদের ওপেন মার্কেটে যাওয়ার পথে। মাসিক বাজার করতে আসা-যাওয়ার পথে আমরা যেতাম।

এখানে এসে এতো ছোট করে চুল কাটাতে ইচ্ছে হলো না। তাই বললাম- মাঝারি। ভদ্রলোক চুল কাটছেন, আর আমি চোখ বন্ধ করে ভাবছি, না জানি কোন চেহারা নিয়ে বের হই! এসব ভাবছি। এর মধ্যে দেখি কারিগর ভদ্রলোক উধাও। আমাকে মাঝপথে রেখে কোথায় যেন চলে গেছে।

সেলুনে ঢুকেই এক ভদ্রমহিলাকে দেখেছিলাম মাথায় কিছু একটা মেখে চোখ বন্ধ করে আছে। সম্ভবত তার চুল ধোয়াতে নিয়ে গেছে। কতোক্ষণ লাগে, কে জানে। আমি নিশ্চিত, আসার পর তাড়াহুড়া করে আমার চুলের বারোটা বাজাবে।

চুলের বারোটা অবশ্য প্রতিদিন এমনিতেই বাজে। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে মাঙ্কি টুপি পরে বের হতে হয়। তখন চুল আর চুল থাকে না। সটান দাঁড়িয়ে থাকে অথবা পেছনে ঝুঁকে যায়। মাঝে মাঝে ভাবি, ব্যাক ব্রাশই শুরু করবো কিনা।

দেশের সেলুনগুলোতে তো ইচ্ছে মতো বলা যায়, “এদিকটা ছোট”, “এভাবে না, এভাবে”। এখানে তো এতকিছু বুঝবেও না। কী বলবো, আর কী করবে- তার তো ঠিক নেই। তাই ‘মাঝারি’ বলেই চুপচাপ আছি।

পাশের টেলিভিশনে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফি’ বা ‘ডিসকভারি’ ধরনের একটা চ্যানেল চালু আছে। আইস স্কেটিং দেখাচ্ছে। পুরো কানাডাতেই আইস স্কেটিংটা খুবই জনপ্রিয়। আরেকটি খেলা হচ্ছে ‘আইস হকি’। খুব খেলার ইচ্ছা। কিন্তু এই বয়সে আইস স্কেটিং কিংবা হকি খেলতে গেলে হাত-পা ভাঙবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আমাদের দেশে একসময় হকি খেলা ছিলো। ফিল্ড হকি। কিন্তু হকিস্টিকের যে ব্যবহার আমাদের ছাত্ররা দেখিয়েছে, এ কারণেই বোধ হয় খেলাটা আর জমেনি। হকির চেয়ে হাডুডু খেলা বরং নিরাপদ। কিন্তু হাডুডুও তো আজকাল উঠে যাচ্ছে। আমি অবশ্য হাডুডু খেলতেও পারতাম না।

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে চুল কাটা শেষ। ভালোই কেটেছে মনে হচ্ছে। একটু বেশিই টিপস দিলাম। ভদ্রলোকের হাসি আর গদগদ কণ্ঠের ধন্যবাদে বুঝলাম, পারিশ্রমিকের চেয়ে টিপসেই আনন্দ বেশি। এই টিপস অবশ্য ঘুষ নয়।

আচ্ছা, টিপসের আনন্দ বেশি নাকি ঘুষের? তবে যারা টিপসের নামে ঘুষ খায়, তাদেরকে একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে।

লেখক: পি এইচ ডি গবেষক, ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন, ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়, মন্ট্রিয়ল, কানাডা।

ইমেইল: helaldhali@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!