রওশনের নেতৃত্বে আলাদা কমিটি হওয়ায় সাবেক সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দল হল ছয় টুকরো।
Published : 09 Mar 2024, 06:44 PM
রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান করে জাতীয় পার্টির নামেই কমিটি ঘোষণাকে পাত্তা দিচ্ছেন না জি এম কাদেরের নেতৃত্বে কমিটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেছেন, “জি এম কাদেরের জাতীয় পার্টিই মূল জাতীয় পার্টি।”
জাতীয় পার্টির নামে দেশে পাঁচটি দলের কার্যক্রম চলমান থাকা অবস্থায় শনিবার রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সম্মেলন করে রওশনের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটির গঠন চূড়ান্ত হয়, যার ঘোষণা আসে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি।
এর প্রতিক্রিয়ায় চুন্নু সাংবাদিকদেরকে বলেন, ‘‘জাতীয় পার্টির নামে সম্মেলন যেটা হয়েছে এটা গঠনতন্ত্রবিরোধী। তারা ব্র্যাকেট বন্দি দল করতে পারে। তবে জিএম কাদেরের নেতৃত্বে আমরাই মূল জাতীয় পার্টি।
‘‘ওরা কী করল আমরা একে গুরুত্ব দিচ্ছি না। এই বিষয় নিয়ে কোনো কথাই আমরা বলতে চাই না। এটা ওদের ব্যাপার।”
রওশনের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি যে আবার ভাঙতে যাচ্ছে, সেই ইঙ্গিত পাওয়া যায় গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আগে।
২০১৫ সালে এরশাদের মৃত্যুর পরই দলের নেতৃত্ব নিয়ে রওশন ও জি এম কাদেরের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এবারের জাতীয় নির্বাচনের আগে রওশনের কোনো অনুসারীকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়নি এমনকি তার ছেলেও দলের প্রতীক পাননি। এই ক্ষোভে ভোটেই আসেননি তিনি।
রওশনই সংসদে বিরোধীদলীয় প্রথম নেতা, যার দল ভোটে এলেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি।
ভোটে শেষে রওশনপন্থিদের দল থেকে একে একে বরখাস্ত করতে থাকেন জি এম কাদের। আর রওশন নিজেকে চেয়ারম্যান করে দেন সম্মেলনের ঘোষণা।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রওশন ঘোষিত মহাসচিব কাজী মো. মামুনুর রশিদ নির্বাচন কমিশনে একটি চিঠিও দেন তিনি যাতে বলায় হয় জি এম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে কমিশন তার এই চিঠিকে আমলে নেয়নি। জিএম কাদের সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হয়ে যান।
রওশনের নেতৃত্বে সম্মেলনের পর জাতীয় পার্টি ফের ব্র্যাকেটবন্দি হওয়ার পর চুন্নু বলেন, ‘‘আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির সারাদেশের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ আছে। এইচ এম এরশাদের গড়ার এই দল। এর নেতা-কর্মীরাও সেভাবে এই পার্টির প্রতি এক রয়েছে।”
সকালে রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে জাতীয় সম্মেলনে মহাসচিব হয়েছেন কাজী মো. মামুনুর রশিদ, নির্বাহী চেয়ারম্যান হয়েছেন কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা হয়েছেন সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান। কো-চেয়ারম্যান হয়েছেন সাইদুর রহমান, শফিকুল ইসলাম, সাদ এরশাদ, গোলাম সারোয়ার ও সুনীল শুভ রায়।
জাতীয় পার্টির কত ভাগ
সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় ক্ষমতা দখল করে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতীয় পার্টি গঠন করেন আগের সেনা শাসক জিয়াউর রহমানের অনুকরণে।
জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর তার দলে ভাঙন না ধরলেও ১৯৯০ সালে এরশাদ রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়ার পর তিনি দল ধরে রাখতে পারেননি। তার দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকেই চলে যান আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে। পরে পাঁচ জন নেতার নেতৃত্বে গঠন হয়েছে আলাদা কমিটি।
১৯৯৬ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে একটি মন্ত্রীর পদও পায় জাতীয় পার্টি। তবে ১৯৯৯ সালে এরশাদ বিএনপি, জামায়াত ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে জোটে যান এরশাদ। সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এই সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন। দলের নাম হয় জাতীয় পার্টি (জেপি)
এরশাদ সেই জোট থেকে পরে বের হেয় আসেন ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে। সেই সিদ্ধান্ত না মেনে জাতীয় পার্টির নাজিউর রহমান মঞ্জুর ও এম এ মতিন মিলে গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি। তারা চারদলীয় জোটের অংশ হয়ে ভোটে অংশ নেয়।
পরে বিজেপিতেও ভাঙন ধরে। নাজিউরের নেতৃত্ব থেকে বের হয়ে এম এ মতিন গঠন করেন আলাদা বিজেপি।
নাজিউরের মৃত্যু হলে তার অংশের চেয়ারম্যান হন ছেলে আন্দালিভ রহমান পার্থ। এম এ মতিনের মৃত্যুর পর তার নেতৃত্বাধীন বিজেপির চেয়ারম্যান প্রথমে হন মেয়ে তাসমিনা মতিন। বর্তমানে দলের চেয়ারম্যান এম এ মুকিত।
বিএনপির বর্জনে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে জাতীয় পার্টিতে আবার বিভেদ দেখা দেয়। এরশাদের নেতৃত্বে নেতারা মনোনয়নপত্র জমা দিলেও পরে তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার নির্দেশ আসে। তবে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একাংশ ঘোষণা দেন তারা ভোটে থাকবেন।
এরশাদের মনোনয়নপত্র একটি আসন থেকে প্রত্যাহার হলেও সময়মতো আবেদন করা হয়নি জানিয়ে থেকে যায় দুটি। এই দুটি আসনের মধ্যে লালমনিরহাটে তিনি হারলেও জেতেন রংপুর সদরে।
ভোট শেষে এরশাদ শুরুতে বলেন, তিনি শপথ নেবেন না। তবে রওশনের নেতৃত্বে অন্য সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়ে নেন। শেষ পর্যন্ত সময় শেষ হওয়ার শেষ দিন এরশাদ একা শপথ নেন। তখন তাকে মন্ত্রী মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করা হয়।
এই ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদের নেতৃত্বে গঠন হয় জাতীয় পার্টির আলাদা কমিটি। তারা বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে ২০ দলীয় জোটে যোগ দেয়।
কাজী জাফরের মৃত্যুর পর দলের এই অংশের চেয়ারম্যান হয়েছেন মোস্তফা জামাল হায়দার।
জাতীয় পার্টির নামে সবগুলো অংশই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত।
কাউন্সিল করে রওশনকে চেয়ারম্যান বানাল অনুসারীরা, মহাসচিব কাজী মামুন
এরশাদের অনুসারী সবাইকে এক ছাতার নিচে ডাকলেন রওশন
সংবিধান প্রণেতাগণ-১২: মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে আপসহীন শামসুদ্দীন মোল্লা