এরশাদের অনুসারী সবাইকে এক ছাতার নিচে ডাকলেন রওশন

“আমার গড়া প্রাণপ্রিয় সংগঠন জাতীয় পার্টি এই রকম একটি ঐতিহাসিক সম্মেলন আয়োজন করতে পেরেছে দেখে আমার হৃদয় কানায় কানায় ভরে গেছে,” বলেন এরশাদের স্ত্রী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2024, 09:54 AM
Updated : 9 March 2024, 09:54 AM

জাতীয় পার্টির বিভেদের মধ্যে এক পক্ষের সম্মেলনে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করা রওশন এরশাদ।

শনিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে জাতীয় পার্টির রওশনপন্থিদের এই জাতীয় কাউন্সিল হয়।

পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের স্ত্রী রওশন বলেন, “আমার রাজনৈতিক জীবনের এক ঐতিহাসিক দিন। আমার গড়া প্রাণপ্রিয় সংগঠন জাতীয় পার্টি এই রকম একটি ঐতিহাসিক সম্মেলন আয়োজন করতে পেরেছে দেখে আমার হৃদয় কানায় কানায় ভরে গেছে। এই সম্মেলন আয়োজনের জন্য জাতীয় পার্টির সকল স্তরের নেতা-কর্মীদের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।”

নব্বইয়ের দশকের ‘ফার্স্ট লেডি’ এবং গত সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন বলেন, “এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে একদা যে সব নেতা-কর্মী পল্লীবন্ধু এরশাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তাদের সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই, আসুন আমরা সবাই জাতীয় পার্টির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হই। দেশের রাজনীতিতে একটা সুষ্ঠু রা বজায় রাখার জন্য জাতীয় পার্টির আর কোনো বিকল্প নাই।”

৭ জানুয়ারির ওই নির্বাচনের আগে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে জাতীয় পার্টিতে নতুন করে বিভক্তি দেখা দেয়। দেবর জিএম কাদেরের সঙ্গে মতবিরোধে গত সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন নিজে এবার নির্বাচনে অংশ নেননি। তার অনুসারীদের কাউকেই মনোনয়ন দেয়নি জাতীয় পার্টি।   

নির্বাচনের পর পার্টি থেকে প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ কয়েকজনকে অব্যাহতি দেয়া হয়, যারা রওশনপন্থি হিসেবে পরিচিত। এরপর গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ অভিযোগ এনে ৬৭১ জন নেতাকর্মী পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

সেই প্রেক্ষাপটে গত ২৮ জানুয়ারি এক মতবিনিময় সভায় রওশন নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করে বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে ‘অব্যাহতি’ দেন। তবে রওশনের ওই দাবি ‘আমলে নেননি’ জিএম কাদের বা চুন্নু।

এরমধ্যে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে জিএম কাদেরকে এবং উপনেতা হিসেবে কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে স্বীকৃতি দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।

এরপর গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে ৯ মার্চ দলের জাতীয় সম্মেলন করার ঘোষণা দেন রওশন।

ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে আয়োজিত এ সম্মেলনে জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত দলের সাবেক কো চেয়ারম্যান কাজি ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস‌্য সুনীল শুভ রায়, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ইয়াহিয়া চৌধুরী, ফখরুল আহসান শাহজাদাসহ রওশনপন্থি নেতাকর্মীরা উপস্থিত রয়েছেন।

সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে রওশন এরশাদ বলেন, “যদি এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হত, তাহলে জাতীয় পার্টি হারিয়ে যেত। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে আমরা হারিয়ে ফেলতাম। দেশের মানুষ জাতীয় পার্টির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই তার প্রতিফলন ঘটেছে।”

১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টির এগিয়ে চলার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এখনো টিকে আছি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর যখন একটু ঘুরে দাঁড়ালাম- তখন আমাদের দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিজেদের আয়ত্তে রাখার জন্য আদালতে দাঁড়াতে হয়েছিল।

“মহামান্য আদালতের সুবিচারে পল্লীবন্ধু এরশাদ এবং আমি রওশন এরশাদ লাঙ্গল প্রতীক জাতীয় পার্টির জন্য বরাদ্দ পেয়েছিলাম। সেই লাঙ্গল প্রতীক এখনো আমাদের জাতীয় পার্টির অনুকূলে আছে এবং আগামীতেও থাকবে ইনশা আল্লাহ।”

প্রয়াত স্বামীর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “পল্লীবন্ধু এরশাদ এদেশে যে নতুন ধারার ইতিবাচক রাজনীতির প্রবর্তন করে ছিলেন, সেই রাজনীতি হারিয়ে যেতে বসেছিল। আজ এই দশম সম্মেলনের মাধ্যমে পল্লীবন্ধু এরশাদের নীতি-আদর্শ এবং উন্নয়ন-সমৃদ্ধি ও সংস্কারের রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের মনে আবার আমরা বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি এই সম্মেলনের মাধ্যমে।”

কাউন্সিলে উপস্থিত পার্টির সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ, উপস্থিত কাউন্সিলর ও ডেলিগেট এবং অতিথিদের ধন্যবাদ জানান তিনি।

কাউন্সিলর ও ডেলিগেটদের উদ্দেশে রওশন বলেন, “পল্লীবন্ধু এরশাদের জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভেদ নাই। আমরা এক আছি- ঐক্যবদ্ধ আছি এবং থাকব। অতীতে যারা পার্টি ছেড়ে গেছে- তারা কেউ পল্লীবন্ধু এরশাদের নীতি আদর্শ নিয়ে যায়নি। এমনকি তারা পল্লীবন্ধুর ছবিও সাথে নেয়নি। তাই জাতীয় পার্টি কখনো ভেঙেছে- তা আমি মনে করি না।

তিনি বলেন, “দেশবাসী একটি শক্তিশালী- সুসংগঠিত জাতীয় পার্টি দেখতে চায়। আসুন আমরা সবাই একত্রিত হয়ে জাতীয় পার্টির সর্বস্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থক এবং আপামর জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করি। নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্ব আয়ত্তে রাখার লোভে কেউ আলাদা থাকবেন না।”

পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে পার্টির ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না রেখে বিকেন্দ্রীকরণ করার প্রস্তাব দেওয়ার কথা জানিয়ে রওশন বলেন, “জাতীয় পার্টিতে গণতন্ত্র চর্চার একটা নিদর্শন আমরা সৃষ্টি করতে চাই। সেই লক্ষ্যে- আমাদের সম্মেলনের বাস্তবায়ন কমিটি কর্তৃক গঠিত গঠনতন্ত্র সংশোধন উপ-কমিটি গঠনতন্ত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর প্রস্তাব আনবে। আপনারা পাস করে দিলে তা জাতীয় পার্টির আইনে পরিণত হবে।”

সম্মেলন শুরুতে দায়িত্ব ‘ছেড়ে দিয়ে’ তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে আমি জাতীয় পার্টির সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটি কর্তৃক গঠিত নির্বাচন কমিশনের কাছে কাউন্সিলের দায়িত্ব অর্পণ করে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালাম। এখন সম্মেলনের অবশিষ্ট আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। অনুমোদনের জন্য গঠনতন্ত্রের সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। এরপর পার্টির নেতৃত্ব নির্বাচন হবে। সেই নেতৃত্ব সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরবর্তী তিন বছর জাতীয় পার্টি পরিচালনা করবে।”

এরশাদের ছেলে সাবেক এমপি রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ কাউন্সিল সভায় বলেন, “আজকের এই দিনটি আমার জীবনে একটি স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। আজ এমন একটি সম্মেলনে আপনাদের সামনে দুটো কথা বলার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি।

“আজ আমার অনেক বেশি ভালো লাগছে, আমার আব্বুর রেখে যাওয়া তার প্রিয় সংগঠন জাতীয় পার্টিকে আবার সুসংগঠিত করার অঙ্গীকার নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে পেরেছি।”

তিনি বলেন, “রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে শিশু বয়সেই মায়ের হাত ধরে আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল। আজ আবার রাজনীতির জন্যে মায়ের হাত ধরে আপনাদের সামনে এসেছি। আপনারা যদি আমাকে আপনাদের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন, তাহলে আমিও অঙ্গীকার করছি, আব্বুর দেখানো পথ ধরে আমি সব সময় আপনাদের সাথে নিয়ে দেশ ও জনগণের সেবা করে যাব।

“আব্বুর মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টি থেকে পল্লীবন্ধুর নাম নিশানা প্রায় মুছে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু আজ আপনাদের দেখে মনে হল- পল্লীবন্ধু এরশাদকে মুছে ফেলার শক্তি কারো নেই। আমরা সবাই এক সাথে এগিয়ে যাব পল্লীবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে।”

এরশাদের ভাই জি এম কাদেরপন্থিদের কয়েকজন শীর্ষ নেতা এই কাউন্সিলে যোগ দেবেন– এমন কথা বলে আসছিলেন রওশনপন্থিরা। তবে কাদেরপন্থি হিসেবে পরিচিত খুলনা বিভাগের অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান টেপা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো নেতা এ সম্মেলনে যোগ দেননি।

কাউন্সিলে নেই রওশন এরশাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সহচর সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ, এসএমএম আলম, ইকবাল হোসেন রাজুসহ বড় একটি অংশ। যারা জিএম কাদের দলের চেয়ারম‌্যান হওয়ার আগে-পরে, সুখে-দুঃখে সবসময় রওশন এরশাদের সঙ্গে ছিলেন।

রওশনপন্থি  জাতীয় পার্টির সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে পুরো ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটসহ মৎস্যভবন এবং শাহবাগ এলাকা। রঙ-বেরঙের পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারে ছেয়ে গেছে সম্মেলনস্থল। সড়কদ্বীপগুলোতে লাগানো হয়েছে এরশাদ শাসনামলের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ছবি সম্বলিত ফেস্টুন। নির্মাণ করা হয়েছে দ্বিতল মঞ্চ। ১২ হাজার কাউন্সিলর এবং ডেলিগেটের জন্য করা হয়েছে সকল আয়োজন।

রওশন এরশাদের উপস্থিতিতে কাউন্সিলে সভাপতিত্ব করছেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজি ফিরোজ রশীদ।

জাতীয় সংগীত ও জাতীয় এবং দলীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দুপুর ১২টায় আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলনের কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান জিয়াউল হক মৃধা। আর কাজী মামুনুর রশীদ সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন।