দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে জাতীয় পার্টি নেতা কাজী জাফর আহমদ বলেছেন, ‘নীতির প্রশ্নে’ তিনি কোনো ছাড় দেবেন না।
Published : 27 Nov 2013, 08:02 PM
আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে এরশাদের সঙ্গে মতানৈক্যের পর সংবাদ মাধ্যমে তার পাঠানো বিবৃতি নিয়ে কাজী জাফরের সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পার্টির সর্বোচ্চ ফোরাম প্রেসিডিয়ামের সদস্য হিসেবে তার (এরশাদ) এই অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা ছিল আমার দায়িত্ব। আমি তা করেছি।”
প্রেসিডিয়ামের অধিকাংশ সদস্যকে অবহিত না করেই সর্বদলীয় সরকারে মন্ত্রী প্রেরণ ও নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এই জন্যই বিবৃতিটি এসেছে।
“প্রতিটি মানুষের কিছু মৌলিক নীতি থাকে, যেগুলোর সঙ্গে আপস করা যায় না। আমি যখন বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম, আমার পিতা সেটা মেনে নেননি। তখন আমি আমার পিতার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করেছিলাম। নীতির প্রশ্নে আমি কখনো আপস করিনি, করব না। আমি আমার অবস্থানে অনড় থাকব।”
দল থেকে বের হয়ে যাবেন কি না কিংবা দল পরিবর্তন করবেন কি না - এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, “আমি এখনো পুরোপুরি সেরে উঠিনি। খুব শিগগিরই সুস্থ হয়ে আমার হাজার হাজার শুভাকাঙ্ক্ষী নেতাকর্মীর সঙ্গে আলোচনা করে খুব দ্রুততম সময়ই পরবর্তী পদক্ষেপ তোমাদের (গণমাধ্যমকর্মী) জানাব।”
বুধবার রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ‘চিকিৎসাধীন’ অবস্থায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেন প্রবীণ এই রাজনীতিক।
“আমার নিউমোনিয়া হয়েছে।”
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদ নির্বাচনে অংশগ্রহনের ঘোষণা দেয়ার একদিন আগেই হাসপাতালে ভর্তি হন কাজী জাফর।
বুধবার হাসপাতালে তার কক্ষের সামনে অপেক্ষমান জাতীয় পার্টির মাঝারি পর্যায়ের কয়েকজন নেতাকে দেখা যায়।
১৯৩৯ সালে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে জন্মগ্রহণকারী জাফর পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে।
ছাত্রজীবনে পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির পর ১৯৬৬ সালে তিনি চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন।
টঙ্গীর শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক রাজনীতিতে জড়িয়ে শ্রমিকনেতা হিসেবে পরিচয় গড়ে ওঠে তার।
স্বাধীনতার পর তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং পরে পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন।
১৯৭৪ সালে তিনি ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন চীনপন্থী কমিউনিস্টদের সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস পার্টিতে (ইউপিপি) যোগ দেন।
১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকারে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন বামপন্থী শ্রমিক নেতা ও ইউপিপি’র সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর।
কাজী জাফরের আগে জিয়ার মন্ত্রিসভায় যোগ দেন ইউপিপি সভাপতি হালিম চৌধুরী।
কাজী জাফরের পর এই দল থেকেই বিএনপিতে যান দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া। এই দল থেকে আরো যারা বিএনপিতে যোগ দেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত আকবর হোসেন, সাদেক হোসেন খোকা, আব্দুল্লাহ আল নোমান প্রমুখ।
ন্যাপ থেকে যোগ দেন তরিকুল ইসলাম। কার্যত সে সময় ইউপিপির বিলোপ ঘটে।
জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর আরেক সামরিক অভ্যুত্থানে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সরকারকে হটিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক ফরমান জারি করে ক্ষমতা নেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদ।
এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর ইউপিপি থেকে বিএনপি ঘুরে আসা কাজী জাফর আবার ইউপিপি পুনর্গঠন করেন।
ইউপিপি বিলুপ্ত করে তিনি যোগ দেন এরশাদের সরকারে।
১৯৮৯ সাল থেকে ’৯০ পর্যন্ত দেশের প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন বাম থেকে ডানদিকে চলে যাওয়া এই রাজনীতিক।
কাজী জাফর বলতে থাকেন, “আমি এই দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলাম। দীর্ঘ ৫৮ বছর রাজনীতি করেছি। এটা তো অস্বীকার করার কোন উপায় নেই, যে বিএনপি দেশের প্রধান বিরোধী দল। আমি বলছি, তথাকথিত নির্বাচনকালীন সরকার এবং দেশের প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে সরকার যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে যাচ্ছে তা জনগণ মেনে নেবে না।”
বিএনপির সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিরোধী দল হিসাবে বিএনপির সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে। পার্টির চেয়ারম্যান নিজে আমাকে এই দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন।
“আজ থেকে এক বছর আগে চেয়ারম্যান সাহেব নিজে আমার বাসায় এসে বলেছিলেন, ‘বিএনপির সাথে জাতীয় পার্টির একটি রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার দায়িত্ব তুমি নাও।’ আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি।
“এক বছর ধরে তিনি (চেয়ারম্যান) আমার মাধ্যমে বিএনপির সাথে সম্পর্ক রেখে গেছেন, আমি নিজে তার সাক্ষী। আর এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন-এটা মেনে নেয়া সম্ভব নয়।”
এদিকে কাজী জাফরের প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার জবাব দিতে উৎসাহী নন এরশাদ।
মঙ্গলবার সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে দৃশ্যত বিরক্ত এরশাদ বলেন, “এ প্রসঙ্গে আমি কোন কথা বলতে চাই না। জাফর ইজ নট দ্য ম্যাটার। আই অ্যাম দ্য ফাদার অব জাতীয় পার্টি।”
বিষয়টি কাজী জাফরের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “তিনি যা সঠিক মনে করেছেন, বলেছেন। আমি শিষ্টাচারবহির্ভূত কোন কথা বলব না। তাই তার এই কথার প্রেক্ষিতে আমি কোন মন্তব্যও করব না।”