ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের প্রশ্ন নিয়ে খন্দকার মোশতাক আপত্তি উত্থাপন করলে শামসুদ্দীন মোল্লা বিনীত অথচ দৃঢ়ভাবে তার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ না থাকলে বাংলাদেশ সৃষ্টির অস্তিত্ব থাকে না।’
Published : 31 Jan 2024, 07:40 PM
সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সব সদস্য যে সমানভাবে অংশ নিয়েছেন বা মতামত দিয়েছেন, তা নয়; বরং এই কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেনও লিখেছেন, অনেকে ওই কমিটিতে প্রতীকীভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। শুধু আসতেন-যেতেন। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা ছিলেন ব্যতিক্রম; যারা সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন, শামসুদ্দীন মোল্লা ছিলেন তাদের অন্যতম।
কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদও লিখেছেন, খসড়া সংবিধান রচনার জন্য বৈঠকে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের প্রশ্ন নিয়ে খন্দকার মোশতাক আপত্তি উত্থাপন করলেন, তখন শামসুদ্দীন মোল্লা বিনীত অথচ দৃঢ়ভাবে তার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ না থাকলে বাংলাদেশ সৃষ্টির অস্তিত্ব থাকে না।’
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সখ্য ছিল শামসুদ্দীর মোল্লার। বঙ্গবন্ধু তাকে ‘ওলডেস্ট কলিগ অ্যান্ড ক্লোজেস্ট ফ্রেন্ড’ বলে অভিহিত করতেন। অগাস্ট ট্র্যাজেডির পরে আওয়ামী লীগ যখন দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়, তখন শামসুদ্দীন মোল্লা ওই দুটি গ্রুপকে এক করায় এবং বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার বিচার দাবিতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আড়াই মাস পরে ৪ নভেম্বর রাজধানীতে শামসুদ্দীন মোল্লার উদ্যোগে প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। তবে ৭ নভেম্বরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে তিনি ভারতে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবিতে তিনি বিরুদ্ধ সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেসব সাহসী পদক্ষেপ নেন, সেখানে শুধু বন্ধুর ঋণ শোধ করার তাড়নাই নয়, বরং রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তার যে নিরন্তর সংগ্রাম—যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে, এটি তারই ধারাবাহিকতা। ১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে তিনি উপলব্ধি করেন, আওয়ামী লীগ ত্রিধাবিভক্ত হয়ে থাকলে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না। তাই তিনি বিদেশ থেকে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে আনার ব্যাপারে সচেষ্ট হন।
শামসুদ্দীন মোল্লা একসময় দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেছেন। যদিও পরে পুরোপুরি আইন পেশায় মনোনিবেশ করেন এবং ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপরে দেশ গঠনের কাজে শামিল হন। গণপরিষদ সদস্য হিসেবে তিনি নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
১৯৭৫ সালে জাতীয় সংসদ থেকে প্রকাশিত সংসদ সদস্যদের জীবনবৃত্তান্তে লেখা হয়েছে, শামসুদ্দীন মোল্লা ১৯২৩ সনের কার্তিক মাসে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার চুমুরদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তবে ২০১০ সালে শামসুদ্দীন মোল্লা স্মৃতি সংসদ থেকে প্রকাশিত ‘শামসুদ্দীন মোল্লা ব্যতিক্রমী এক মহৎ প্রাণ’ নামে স্মারকগ্রন্থে লেখা হয়েছে, তিনি ১৯২১ সালের ২০ এপ্রিল ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার পূর্ব সদরদি গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন।
শিক্ষা, পেশা ও রাজনৈতিক জীবন
শামসুদ্দীন মোল্লা ১৯৪১ সালে ভাঙ্গা পাইলট হাইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। পরের বছর ১৯৪২ সালে রাজেন্দ্র কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন এবং এক বছর পড়ার পরে কলকাতা সুরেন্দ্র মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৪৪ সালে।
১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণায় তিনি নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের সান্নিধ্যে আসেন।
মূলত ভাঙ্গা পাইলট হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩৯ সালের ঘটনা। স্কুলের পণ্ডিত মশাই সাধারণ জ্ঞানের বই ‘জেনে রাখা ভাল’ পড়াচ্ছিলেন। বইতে লেখা ছিল ‘শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হকের জন্য বরিশালের চাখার গ্রাম প্রসিদ্ধ।’ পণ্ডিত মশাই অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে একদিন বইটি ছুড়ে মারলেন এবং ওইদিন আর ক্লাসে পড়ালেন না। এ. কে ফজলুল হক তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। এই ঘটনায় শামসুদ্দীন মোল্লাসহ কয়েকজন মুসলিম ছাত্র ক্ষুব্ধ হন এবং হেড মৌলভী আবদুল হামিদকে ঘটনাটি জানান। এই ঘটনায় ভাঙ্গা স্কুলের ছাত্র ও অভিভাবকদের মধ্যেও উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং সরকারি মহল ঘটনার সত্যতা যাচাই করে ভাঙ্গা স্কুলের সহায়তা বন্ধ করে দেয়। তখন গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির প্রতিবাদী ছাত্র শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে ভাঙ্গায় আসার আমন্ত্রণ জানান শামসুদ্দীন মোল্লা। শেখ মুজিব ভাঙ্গায় আসেন এবং নোমানী হলে একটা ছাত্রসভায় মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আহ্বান জানান। শামসুদ্দীর মোল্লা ওই ঘটনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ভাঙ্গায় নিয়ে আসেন মূলত শিক্ষকের ভুল ধরিয়ে দেয়ার জন্য। শিক্ষক নিজের ভুল স্বীকার করে নিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। ওই ঘটনার পর থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শামসুদ্দীন মোল্লার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
শামসুদ্দীন মোল্লার স্ত্রী যোবায়দা শামসুদ্দীন জানাচ্ছেন, বেকার হোস্টেলে থাকাকালীন শেখ মুজিব ও শামসুদ্দীন মোল্লার মধ্য বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়। তারপর ওখান থেকে বি.এ পাস করে দুজনই চলে আসেন ঢাকায়। শামসুদ্দীন মোল্লা আইন পড়তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখন রাজনীতিও চলছে পুরোদমে। ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থাকেন। একদিন সন্ধ্যার পর পড়তে বসে মাথায় হাত দিয়ে কী যেন ভাবছিলেন। এমন সময় কোথা থেকে শেখ মুজিব এসে পিঠে একটা থাপ্পড় মেরে বলেন, ‘কিরে মোল্লা, কী ভাবছিস।’ তিনি বললেন, ‘না, কিছু না।’ শেখ মুজিব বললেন, ‘কিছু না বললেই হলো। আমি বলতে পারি তুই কী ভাবছিস। তোর একটা চাকরির খুবই দরকার। শোন, বোর্ডে একটা পোস্ট খালি আছে, আমি তোর নাম বলে এসেছি। কালই তুই বোর্ড অফিসে যাবি এবং আমার কথা বলবি। কোনো অসুবিধা হবে না। চাকরিতে জয়েন করে পড়াশোনা ঠিকমতো করবি, দেশের যা অবস্থা। আমাদের রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে নতুবা দেশ বাঁচাতে পারব না।’ পরদিন বোর্ড অফিসে গিয়ে শামসুদ্দীন মোল্লা চাকরিতে যোগ দিলেন। তখন তার একটা চাকরির বিশেষ দরকার ছিল। না হলে পড়াশোনা চালিয়ে নেয়া কঠিন হতো। (ব্যতিক্রমী এক মহৎ প্রাণ, পৃষ্ঠা ১২২)।
শামসুদ্দীন মোল্লা ১৯৪৮ সাল থেকেই ভাষার লড়াইয়ে যুক্ত হন। তিনি আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকে এর সদস্য। তিনি ১৯৫৪-৫৮ সময়ে তিনি ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, ১৯৬০ ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৬৬–৬৯ ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কার্যকরী সংসদের সদস্য ছিলেন।
শামসুদ্দীন মোল্লা ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করার পর ফরিদপুরে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। তিনি অবশ্য চেয়েছিলেন ঢাকায় প্র্যাকটিস করতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাকে বললেন, ‘ফরিদপুরে যাও, দল সংগঠিত করতে হবে।’ শামসুদ্দীন মোল্লা বিনাবাক্য ব্যয়ে তা মেনে নেন। ফরিদপুর গিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে শুরু করেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। একদিকে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য বাংলার মুক্তি সনদ ৬ দফা দাবির ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা দিয়ে জনগণকে বোঝাতেন, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য জোর দাবি তুলতেন।
শামসুদ্দীন মোল্লার সাংবাদিক জীবন
ষাটের দশকে শামসুদ্দীন মোল্লার আরেকটি পরিচয় ছিল। ১৯৬৫ সাল থেকে তিনি ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের ফরিদপুর সংবাদদাতা। তখন ইত্তেফাক ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা। ফরিদপুর বিষয়ক সংবাদ তিনিই বেশির ভাগ পাঠাতেন। ইতিহাসবিদ আহমেদ কামাল লিখেছেন, ‘ইত্তেফাকের ওইসব সংবাদ পড়ে আমরা মোল্লা চাচাকে একটু অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছিলাম। আমার নিজের ধারণা, এ পেশায় যদি তিনি আরও একটু মনোযোগী হতেন, তাহলে সাংবাদিক হিসেবে তিনি একটি অবস্থান তৈরি করতে পারতেন। যেহেতু রাজনীতিই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান, সে কারণেই আইনজীবী বা সাংবাদিক হিসেবে সামনের সারিতে জায়গা করে নিতে পারেননি। যদিও তাঁর ভগ্নিপতি ইত্তেফাকের শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন তাকে সাংবাদিকতায় আসার জন্য প্রলুব্ধ করতেন বলে শুনেছি।’ (ব্যতিক্রমী এক মহৎ প্রাণ, পৃষ্ঠা ৪৩)
শামসুদ্দীন মোল্লা ১৯৬৬ থেকে ৬৯ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৬-৬৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর পঞ্চম ছেলে কামরুজ্জামান কাফী জানাচ্ছেন, শামসুদ্দীন মোল্লা ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দীন মোল্লা
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শামসুদ্দীন মোল্লা মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে থাকেন। তিনি সেই বিরল ব্যক্তিত্বদের একজন, যিনি দুই ছেলেসহ মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। বড় ছেলে এম এম শাহরিয়ার রুমী ছিলেন মুজিব বাহিনীতে। আর মেজ ছেলে এম এ যাকারিয়া জামী ছিলেন মুক্তিবাহিনীতে।
শামসুদ্দীন মোল্লার স্ত্রী স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ‘বড় ছেলে রুমী মুজিব বাহিনীতে, মেজ ছেলে জামী মুক্তিবাহিনীতে চলে গেছে, স্বামী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছেন। পাকিস্তানি বর্বরদের কাছে আমার চেয়ে বড় অপরাধী আর কে? রাত হলেই নেমে আসে আতঙ্ক আর ভয় । দুই মাসের বাচ্চা নিয়ে, সাথে অন্যান্য বাচ্চা নিয়ে দৌড়াতে থাকি এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। মাঝে গুলির আওয়াজ আর কান্নায় চমকে ওঠে প্রাণ। কখনো পাটের ক্ষেতে, কখনো আখের ক্ষেতে, কখনো বা বাঁশঝাড়ের নিচে রাত কাটাই। একদিন দেখি, রুমীর দুই বন্ধু (আলী ও শহীদ) ছোট বাচ্চা মামণির জন্য কিছু দুধ, সুজি, চিনি নিয়ে এসেছে। তাদের বাড়ি ঢুকতে দিচ্ছে না অপরিচিত লোক বলে। তারা বলছে আমরা রুমীর বন্ধু। ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ও না থাকলে ওর আম্মাকে ডাকুন, আমরা তার সঙ্গে একটু দেখা করেই চলে যাব। ওদের কথা শুনতে পাই। আমি চিনে ফেলি ওদের। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ওদের ভিতরে এনে দরজা বন্ধ করে দিই। প্যাকেটটা আমার হাতে দিয়ে ওরা কান্নায় ভেঙে পড়ে।’
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে দেশ শত্রুমুক্ত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এক বিবৃতিতে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর জামায়াতে ইসলামীর কুখ্যাত আল বদর, আল-শামস ও রাজাকারদের দ্বারা পরিচালিত গণহত্যার বিচারের জন্য স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানান শামসুদ্দীন মোল্লা।
গণপরিষদে শামসুদ্দীন মোল্লা
১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শামসুদ্দীন মোল্লা ফরিদপুর-৪ (জাতীয় পরিষদ ৯৭) আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ওই আসনে মোট ভোটার ছিলেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬২ জন। এর মধ্যে শামসুদ্দীন মোল্লা পান ৯৫ হাজার ৭১৪ ভোট, যা প্রাপ্ত ভোটরে ৯৫ শতাংশ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়নে যে ৩৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়, শামসুদ্দীন মোল্লা ছিলেন তাদের একজন। শুধু বঙ্গবন্ধুর বাল্যবন্ধু হিসেবে নয়, বরং শামসুদ্দীন মোল্লাকে এই কমিটির সদস্য করা হয়েছিল আইনজীবী হিসেবে তার পাণ্ডিত্য এবং সেইসঙ্গে মাটি ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে। সাংবাদিকতা করার কারণে তৃণমূল মানুষের সমস্যা ও দুঃখ-দুর্দশাও তিনি অনেকের চেয়ে ভালো জানতেন, বুঝতেন।
গণপরিষদে তার ভূমিকা সম্পর্কে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘কমিটিতে তিনি খুবই বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি অনেক সময় দিয়ে খসড়ার ওপর যে মন্তব্যগুলো করেছেন, তা সবাই গ্রহণ করেছেন এবং তার যুক্তিগুলোর ওপর ভিত্তি করে অনেক অর্থপূর্ণ আলোচনা হয়েছে।’
ড. কামাল লিখেছেন, ‘অনেকে ওই কমিটিতে প্রতীকীভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। শুধু আসতেন-যেতেন। কিন্তু শামসুদ্দীন মোল্লার অংশগ্রহণ, প্রত্যেকটি অনুচ্ছেদে তার আলোচনা, বক্তব্য, যেগুলো স্মরণ করে বলতে পারি তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। কমিটির একজন সদস্য হিসেবে সংবিধানের খসড়ার সময় বিভিন্ন ধারা, উপধারা এবং খুব নির্ভুল হওয়ার জন্য যে কথাগুলো তিনি বলেছেন, সেগুলা তার রাজনৈতিক জীবনের প্রজ্ঞা থেকে, তার অভিজ্ঞতা থেকেই।’ (ব্যতিক্রমী এক মহৎ প্রাণ, পৃষ্ঠা ১৫৪)
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ লিখেছেন: ‘খসড়া সংবিধান রচনার জন্য বৈঠকে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের প্রশ্ন নিয়ে খন্দকার মোশতাক আপত্তি উত্থাপন করলেন, তখন শামসুদ্দীন মোল্লা বিনীত অথচ দৃঢ়ভাবে তার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষ না থাকলে বাংলাদেশ সৃষ্টির অস্তিত্ব থাকে না। তেমনি সমাজতন্ত্র না থাকলে পাকিস্তানি ২২ পরিবারের শোষণ-নির্যাতনের কথা বলে আমরা যে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তা ব্যর্থ হয়ে যাবে।’ আবু সাইয়িদের ভাষায়: ‘পার্লামেন্টে তাকে আমি দেখেছি কাউকে ছেড়ে কথা বলেননি । সেটা ব্যক্তি আক্রোশে নয়, দেশের স্বার্থে, জনগণের কল্যাণে।’ (ব্যতিক্রমী এক মহৎ প্রাণ, পৃষ্ঠা ৩৫)
আসনবিন্যাস নিয়ে ক্ষুব্ধ
গণপরিষদে সদস্যদের বসার ব্যবস্থা, অর্থাৎ আসনবিন্যাস করা হয়েছিল সদস্যদের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী বা বর্ণানুক্রমে। কিন্তু এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন শামসুদ্দীন মোল্লা।
১৯৭২ সালের ২৪ অক্টোবরের বৈঠকে তিনি বলেন, ‘১২ তারিখে আমরা এখানে অধিবেশনে মিলিত হয়েছি। এখানে বর্ণানুক্রমে বসার ব্যবস্থা করার জন্য আমরা ব্যাক বেঞ্চার হয়ে গিয়েছি। আমাদের স্ব স্ব এলাকার লোক দর্শক হিসাবে এখানে এলে তারা মনে করতে পারেন যে, আমরা এখানে এসে এ্যাসেম্বলির কাজে যোগদান না করে শুধু ব্যাক বেঞ্চার হিসাবেই বসে থাকি। এতে তাদের মনে আমাদের সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা হতে পারে। তাই আপনার কাছে আমার নিবেদন যে, আগামীকাল থেকে যাতে ব্যাক বেঞ্চাররা সামনের আসনে বসতে পারেন এবং পরিষদের কাজে ভালভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করবেন।’
এ সময় স্পিকার তাকে উদ্দেশ করেন বলেন: Please resume your seat.
পরদিন ২৫ অক্টোবরও তিনি একই বিষয়ে ডেপুটি স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আপনি ব্যাক বেঞ্চারদের জন্য কোনো সুবিধা দেননি। এই বিষয়েই আমি বৈষম্যের অবসান এবং ঠিক বিচার চাই। আপনি...।’
তার কথা শেষ না হতে ডেপুটি স্পিকার তাকে থামিয়ে দিয়ে বসতে বলেন।
এসব ঘটনায় বোঝা যায়, গণপরিষদে বর্ণানুক্রমে বসার যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল তাতে শামসুদ্দীন মোল্লার নামের আদ্যাক্ষর শেষ দিকে (শ) হওয়ায় তার জন্য নির্ধারিত আসন হয় শেষের দিকে—যা নিয়ে তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন। কেননা তিনি মনে করতেন, পেছনের দিকে বসে ঠিকমতো স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় না এবং কথা বলা যায় না। তাছাড়া তার মূল শঙ্কা ছিল এলাকার মানুষকে নিয়ে যে, তারা যদি গণপরিষদে এসে দেখেন যে, তার মতো একজন জাদরেল নেতা, যিনি বঙ্গবন্ধুর বাল্যবন্ধু, তিনি পেছনের দিকে বসেন আছেন—তাতে করে তার সম্মান কিছুটা ক্ষুণ্ন হতে পারে বলে তিনি হয়তো মনে করতেন।
তিনি স্পিকারকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘আমরা যারা পিছনে বসেছি, তারা অবহেলিত। এখানে যে কথা আমরা বলতে চাই, ওখানে থেকে সেটার প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি না। আমরা কয়েক দিন যাবৎ দুঃখের সঙ্গে সেটা লক্ষ্য করছি। তাই কথা হলো, আমার বক্তব্য আজকে বৈধতার প্রশ্নে শুনতে হবে।’
এ সময় তিনি চিফ হুইপের কাছেও প্রশ্ন করেন যে, নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে আসন বণ্টন করায় ‘শ’ আদ্যক্ষরের সদস্যের বেঞ্চ পেছনের দিকে, অথচ তাঁর (চিফ হুইপ) নামের আদ্যাক্ষরও ‘শ’, অথচ তিনি বসেছেন একেবারে সামনের দিকে। শামসুদ্দীন মোল্লা প্রশ্ন করেন, ‘আমি এত দূরে কেন? এর বিচার আপনার কাছেও চেয়েছি জনাব স্পিকার। এখানে একটা বৈষম্য চলছে। আমরা ইনসাফ চাই। আমরা…।’
এদিনও তাঁর কথা শেষ না হতেই স্পিকার তাঁকে বসার অনুরোধ করেন।
সুরঞ্জিতের সমালোচনা
২৪ অক্টোবরের বৈঠকে সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্তর একটি বক্তব্যের বিষয়ে পয়েন্ট অব অর্ডারে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে শামসুদ্দীন মোল্লা বলেন, ‘৩০ অনুচ্ছেদ বিশ্লেষণ করে সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত যে public order-এর কথা বলেছেন, সেটি সংবিধান কমিটিতে আলোচনা করে কমিটির সকল সদস্য সাব্যস্ত করেছেন এবং সেটি তিনিও মেনে নিয়েছেন। Public order-এর বিষয়ে যে অনুচ্ছেদ তিনি পড়েছেন, আমরা সর্বসম্মতভাবে তা গ্রহণ করেছি এবং বাবু সুরঞ্জিৎ সেনও সেই কমিটির একজন সদস্য। এখানে তার উপর কোনো বক্তব্য দেওয়ার অধিকার এই হাউসে নাই বলে আমি মনে করি। যে পয়েন্টে তিনি আমাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন, তিনি তার দ্বিমত পোষণকারী রিপোর্টের মধ্যে সেটা লিপিবদ্ধ করেছেন এবং তাই শুধু তিনি আলোচনার জন্য উত্থাপন করতে পারেন।’ এ সময় স্পিকার তাকে (শামসুদ্দীন মোল্লা) তার বক্তব্যের সময় এ সমস্ত বিষয় উল্লেখের পরামর্শ দেন।
৩-৪ নভেম্বরের বৈঠকে সংবিধানের দফাওয়ারি সংশোধন প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় তিনি ৭২ অনুচ্ছেদের (২) দফার ২য় পঙক্তিতে অবস্থিত ‘নির্বাচনে ভোট গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট তারিখ হইতে’ শব্দাবলির পরিবর্তে ‘নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হইবার’ শব্দাবলি সন্নিবেশ করার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক মতে যাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় এবং নির্বাচিত হওয়ার পরে সংসদ-সদস্যরা যাতে সংসদের সভায় এসে অংশগ্রহণ করতে পারেন, এইজন্য এই দফা গ্রহণ করা হয়েছে।
আরেক দিনের বৈঠকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার বক্তৃতার সময় একজন সদস্য দাঁড়িয়ে পয়েন্ট অব অর্ডারে কথা বলা শুরু করলে এর প্রতিবাদ করেন শামসুদ্দীন মোল্লা। বলেন, একজন সদস্য যখন বক্তৃতা করেন, তখন আরেকজন পয়েন্ট অব অর্ডারে কথা বলতে পারেন ন। এ বিষয়ে তিনি স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডেপুটি স্পিকার বলেন, ‘মিস্টার লারমার সমর্থনে আপনাকে কিছুই বলতে বলা হয়নি। দয়া করে আপনি বসুন।’
সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখার দাবি
৩-৪ নভেম্বরের বৈঠকে তার একটি সংশোধনীর ওপর আলোচনা চলাকালে একজন সদস্য তাকে বাধা দিলে শামসুদ্দীন মোল্লা স্পিকারকে উদ্দেশ করে বলেন, আমি পরিষদের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাই না। কারণ, আমাদের স্বল্প সময়ের মধ্যে এই বিল পাস করতে হবে। এখন আমরা আমাদের কার্য সমাধা করতে যাব। আজ আমরা যে এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি, এটা সবচেয়ে গৌরবের বিষয়।
এ সময় তিনি স্বাধিকারের জন্য আওয়ামী লীগের ২৫ বছরের সংগ্রামের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেন: ‘গণতন্ত্র আমার জীবনের একমাত্র ব্রত, গণতন্ত্রই আমার জীবনের একমাত্র পাথেয়।’
শামসুদ্দীন মোল্লা বলেন, ‘আমি আপনার মাধ্যমে এই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে জানিয়ে দিতে চাই, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বৃদ্ধ বয়সে বৈরুতে একটি হোটেলে আত্মীয়-পরিজনহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। আমাদের ধারণা রয়েছে, বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে যে, তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয় নাই। বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমরা দাবি করি তার সেই মৃত্যু সম্পর্কে সুষ্ঠু তদারকির ব্যবস্থা যেন করা হয়।’
প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি করাচিতে সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সরকার। কারাগারে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে তিনি জেনেভায় যান। সেখান থেকে বৈরুতে। ওই সময় পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর লোক ছদ্মনামে বৈরুতে পাঠানো হয়। ওই সময় বৈরুতের এক হোটেলে কামরায় একাকী শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে সারা দেশের শোকের ছায়া নেমে আসে। মরদেহ দেশে আনার পরে ঢাকায় যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দোয়েল চত্বরের উত্তর দিকে তিন নেতার সমাধির একটি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। বাকি দুটি কবরে শায়িত শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং খাজা নাজিমউদ্দীন। এই তিন নেতাই কাছাকাছি সময়ে মৃত্যুবরণ করেন।
সোহরাওয়ার্দীর সাবেক সহকর্মী, এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী লিখেছেন: ‘সেই আমলেও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কোনো একটি মামলা পরিচালনা করলে লাখ টাকা ফি পেতেন। সোনার চামচ মুখে নিয়ে যিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, মৃত্যুকালে দেখা যায় তার সারা জীবনের সঞ্চয় বলতে কিছু নেই। ছিলো ১৩ হাজার টাকার একটি ওভার ড্রাফট। এমনকি গুলশান রেসিডেনশিয়াল এলাকায় তার নামে যে প্লটটি বরাদ্দ করা হয়েছিল, বকেয়া কিস্তির দায়ে তাও নিলামে ওঠে। নিলামটিও করা হয় অতি সঙ্গোপনে। (মিজানুর রহমান চৌধুরী, রাজনীতির তিনকাল, অনন্যা/২০০৩, পৃষ্ঠা ৬২)
শামসুদ্দীন মোল্লা ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) এবং ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক শহীদ সিরাজউদ্দীন হোসেনকেও স্মরণ করেন। বলেন, ‘তারা কলমের মাধ্যমে এই দেশে জনমত গঠন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। এতেই প্রমাণ হয় যে, Pen is mightier than sword, কলম তরবারির চেয়ে বেশি শক্তিশালী।’
তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গে বলেন, ‘২৫ বছর ধরে তার নির্ভুল এবং সুপরিচালিত নেতৃত্বের ফলে আমরা আজ এই অবস্থায় উপনীত হতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই আমরা এই পরিষদে এসেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা গৌরবান্বিত যে, আমরা জাতিকে স্বাধীন করেছি এবং জাতিকে একটি শাসনতন্ত্র দিতে যাচ্ছি। এটা শুধু আওয়ামী লীগের কথা নয়। দেশের ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে বিশ্বের ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এটা সংযোজিত হবে। আমি বলতে চাই, দুনিয়ায় আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। বাংলায় আমরা শাসনতন্ত্র দিয়েছি। ১৯৫২ সালে যে সমস্ত ভাই রক্ত দিয়েছিলেন এই মাতৃভাষার জন্য, মাতৃভাষায় সম্মানের জন্য, তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সেই মাতৃভাষায় আমরা শাসনতন্ত্র দিয়েছি। গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র একসঙ্গে পাশাপাশি চলতে পারে, এটা আমরা দেখিয়ে দিয়েছি। এটাই বিশ্বের বিস্ময়।’
বাহাত্তর-পরবর্তী জীবন
শামসুদ্দীন মোল্লা ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-৮ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন। ওই আসনে মোট ভোটার ছিল ৯৪ হাজার ৪৫১। শামসুদ্দীন মোল্লা পান ৫৫ হাজার ১৭১ ভোট, যা প্রাপ্ত ভোটের ৯৪.৪২ শতাংশ। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও তিনি ৯৫ শতাংশ ভোট পান। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায় তিনি তার এলাকায় কতটা জনপ্রিয় ছিলেন।
শামসুদ্দীন মোল্লা ১৯৭৪-৭৫ সালে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করলে তিনি এই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং জেলা গভর্নর নির্বাচিত হন। জিয়াউর রহমান তাকে মন্ত্রিসভার সদস্য করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে তিনি বাকশালে সক্রিয় হন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সাত দল জোটবদ্ধভাবে প্রার্থী দিয়েছিল। সেখানে প্রাথমিকভাবে বাকশালের যে কয়জনকে প্রার্থীর জন্য আসন ছেড়ে দেয়া হয়েছিল, তার মধ্যে শামসুদ্দীন মোল্লাও ছিলেন। কিন্তু পরে তাকে বাদ দেয়া হয়। ফলে ১৯৭৩ সালের পরে তিনি আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেননি। তবে পুরোপুরি আইন পেশায় মনোযোগ দেন। ইতিহাসবিদ আহমেদ কামাল অবশ্য মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হওয়া সত্ত্বেও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে শামসুদ্দীন মোল্লা আওয়ামী লীগের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে তিনি সংগঠনের প্রথম সারির নেতার স্থান আর পাননি। (ব্যতিক্রমী মহৎ প্রাণ, পৃষ্ঠা ৪৪)
শামসুদ্দীন মোল্লা ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর বারের সভাপতি ছিলেন। তিনি ওই সময়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলেরও ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ফরিদপুর ল-কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং শেরেবাংলা পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ১৯৭২-৭৮ সালে তিনি ফরিদপুর রেড ক্রিসেন্টের সভাপতি, মূক, বধির ও এতিমখানা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা, সারদা সুন্দরী কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। খাবাসপুর ক্লাব ও আবাহনী ক্রীড়াচক্রেরও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর ওলডেস্ট কলিগ, ক্লোজেস্ট ফ্রেন্ড
শামসুদ্দীন মোল্লা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁরা উভয়েই কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়েছেন এবং বেকার হোস্টেলে থেকেছেন। উভয়ের বাড়িই ছিল বৃহত্তর ফরিদপুরে। নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পেছনে হয়তো এই আঞ্চলিকতাও কিছুটা ভূমিকা রেখেছেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও পারিবারিক পরিবেশে তাঁরা পুরস্পরকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করলেও রাজনীতির অঙ্গনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন শামসুদ্দীনের নেতা। নেতার প্রতি শ্রদ্ধা ও মর্যাদা প্রদর্শনের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন।
নিজের অসমাপ্ত ডায়েরিতে শামসুদ্দীন মোল্লা লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী। তার সম্বন্ধে বহু অজানা ও অকথিত বর্ণনা আমার মনের মধ্যে ভিড় জমায়—যখনই কিছু বলতে বা লিখতে যাই। তার কারণ হলো এমন কতক ঘটনা আছে যা আমি এবং তিনিই জানতেন এবং তার একমাত্র সাক্ষী আমিই। একবার যারা তার সান্নিধ্যে এসেছেন এবং তার কর্মতৎপরতা দেখেছেন, চুম্বকের মতো তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থেকেছেন। ১৯৩৯ সন হতে ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট কালরাত্রি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত আমি ছিলাম তার সবচেয়ে পুরনো সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠতম বন্ধু (তিনি বলতেন Mollah is my oldest colleague & closest friend)। ছাত্রজীবন হতে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার ছিল নাড়ীর যোগ এবং কোনোদিন আমরা উভয়ে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন মনে করতে পারি নাই এবং এখনও মনে করি না। তার কারণ হল আমরা এদেশের অত্যাচারিত, নিপীড়িত গরীব কৃষক শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের কল্যাণে নিজেদেরই নিয়োজিত ও উৎসর্গ করেছিলাম।’
ড. কামালের ভাষায়: বঙ্গবন্ধুর সাথে শামসুদ্দীন মোল্লার সম্পর্কের কথা এলে বলতে হয় যে, তাদের মধ্যে স্নেহ ও শ্রদ্ধাবোধ দুটোই ছিল । কিন্তু সাংসদ হিসেবে দেখতাম, কোনোখানে বঙ্গবন্ধু গেলে তার সাথে যে মোল্লা সাহেবের ঘনিষ্ঠতা, সেটা বোঝাই যেত এবং তার কথাকে তিনি মূল্য দিতেন। আমি সব সময়ই মনে করেছি যে জাতীয় চার নেতা বাদে আমাদের মধ্যে থেকে যদি পাঁচজনের নাম নিতে হয়, তাদের মধ্যে শামসুদ্দীন মোল্লার নাম অবশ্যই বলতে হবে। (ব্যতিক্রমী মহৎ প্রাণ, পৃষ্ঠা ১৫৭)
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশে এবং বিদেশে নেতৃত্ব দেন শামসুদ্দীন মোল্লা। ওই নৃশংস হতাকাণ্ডের পরে অনেকেই নানা দিকে চলে গেলেও নিজের আদর্শ থেকে সরেননি বঙ্গবন্ধুর এই ক্লোজেস্ট ফ্রেন্ড। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকা শহরে প্রথম প্রতিবাদ মিছিলে তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের দ্বিতীয় দফা সেনা অভ্যুত্থানের পরের দিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়েছিল ওই মিছিল।
শামসুদ্দীন মোল্লার ভগ্নিপতি শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের বাসায় গোপন বৈঠক হয় ওই মিছিল আয়োজনের। সব বৈঠকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইসমত কাদির গামাসহ ছাত্রনেতারা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ৭ নভেম্বরের তৃতীয় দফা সেনা অভ্যুত্থানের পর জিয়া সরকার শামসুদ্দীন মোল্লাকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিলে তিনি ভারতে গিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। যতদিন জীবন ছিলেন, শামসুদ্দীন মোল্লা বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার আদর্শের প্রতি অনুগত ছিলেন। (লায়েকুজ্জামান, কালের কণ্ঠ, ১০ জুলাই ২০২১)
নিষ্ঠাবান আদর্শ রাজনীতিকের প্রতীক
শামসুদ্দীন মোল্লা ছিলেন নিষ্ঠাবান আদর্শ রাজনীতিকের প্রতীক। ‘শামসুদ্দীন মোল্লা: ব্যতিক্রমী এক মহৎ প্রাণ’ নামে একটি স্মারকগ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘উনসত্তুরের গণ-আন্দোলন থেকে শুরু করে যে কোনো সংকটের মুহূর্তে শামসুদ্দীন মোল্লা বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন। যখন বঙ্গবন্ধু জেলে গেলেন, তখন শামসুদ্দীন মোল্লা যে ভূমিকা পালন করলেন, তা আমরা কেউই ভুলব না। এমন একজন প্রজ্ঞাবান মানুষ আমাদের কাছে আদর্শ হয়েই আছেন।’ প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক তার বক্তব্যে বলেন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি একজন নিঃস্বার্থ মানুষ শামসুদ্দীনকে। এমন মানুষ সচরাচর দেখা যায় না।’ আলোচনায় অন্য বক্তারা শামসুদ্দীন মোল্লাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেওয়ার দাবি জানান। (প্রথম আলো, ২৪ জানুয়ারি ২০১০)
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলছেন, ‘সরকার গঠনে আমরা স্বাভাবিকভাবেই আশা করেছিলাম যে, শামসুদ্দীন মোল্লা সাহেব মন্ত্রী হবেন, কিন্তু তৎকালীন সময়ে নানা রাজনৈতিক সংকটের কারণে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন, শামসুদ্দীন মোল্লা, তোমাকে পরবর্তী সময়ে যা করার করব। মন্ত্রী না হলেও তুমি ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে আমার সঙ্গে থাকবে, দরকার হলে যে কোনো প্রকার সরকার পরিচালনায় সাহায্য-সহযোগিতা করবে, মন্ত্রিসভায় তোমাকে না নিলেও আমার কাছে তোমার গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়।’
স্মৃতিকথায় আবু সাইয়িদ লিখেছেন, ‘জননেতা শামসুদ্দীন মোল্লার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। পরিচিত হলাম ১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে। তিনি যেমন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন, আমিও পাবনা থেকে তখন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য। খাপখোলা তলোয়ারের মতো সুঠাম দেহ, ব্যাকব্রাশ করা চুল, গায়ে মুজিব কোট, ঘন মোচ, ভারী কণ্ঠ বঙ্গবন্ধুর অনুচ্ছায়া যেন! সুদর্শন চেহারা; চলনে, বলনে, হাসিতে এক পলকেই যে কোনো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো ব্যক্তিত্ব।’
পরিবার
১৯৫০ সালে শামসুদ্দীন মোল্লা এবং যোবায়দা শামসুদ্দীন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির ৬ জন ছেলে ও ৬ জন মেয়ে। তাদের বড় ছেলে এম এম শাহরিয়ার রুমী বীর মুক্তিযোদ্ধা। এক সময় ছাত্রলীগের প্রচার ও অর্থ সম্পাদক ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটির সদস্য হন। ২০২১ সালের ২৪ মার্চ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। শামসুদ্দীন মোল্লার মেজ ছেলে এম এ যাকারিয়া জামীও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আরেক ছেলে কামরুজ্জামান কাফী যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বাকি সন্তানরা দেশ-বিদেশের নানা জায়গায় বসবাস করেন।
অসুস্থতা ও মৃত্যু
ফরিদপুরে থাকাকালীন স্ট্রোক করেন শামসুদ্দীন মোল্লা। ডাক্তার আসেন। অনেক চেষ্টার পর জ্ঞান ফেরে। কিন্তু পরে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাকে ফরিদপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় নেয়া হয় রাজধানীর শাহবাগে পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)। প্রায় তিন মাস সেখানে ভর্তি ছিলেন। তার পঞ্চম সন্তান কামরুজ্জামান কাফী সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে বলছেন, ১৯৯১ সালের ১০ জুলাই বাবা পেটের পীড়ায় অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। মা আর আমি শুশ্রূষার মাধ্যমে তাকে কিছুটা সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছিলাম। সকালটা পার করে আমি কাঁটাবনের দিকে চলে গেলাম। অঝোর ধারায় অবিরাম বৃষ্টি, অচল ঢাকা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু বৃষ্টি। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, বৃষ্টি কিছুটা কমলে মুহসীন হল হয়ে শাহবাগের মোড়ে এলাম। আজীবন ফুলবিদ্বেষী আমি ফুলের তোড়া কিনলাম। হাসপাতালের ওষুধের গন্ধ যদি কিছুটা ম্যানেজ করা যায়, এই দুরাশায়। পিজি হাসপাতালে যখন পৌঁছালাম তখন বাবার দুপুরের খাবারের সময় পার হয়ে গেছে। করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, তখন দেখি অগণিত মানুষের ভিড়। দুই-তিন মাসেও যাদের দেখিনি তারাও শামিল। বুঝতে বাকি থাকল না, কী হয়েছে।’ শামসুদ্দীন মোল্লাকে ফরিদপুর শহরের আলী কবরস্থানে দাফন করা হয়।