এবার ‘আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি’, জনগণও: ফরিদপুরে ফখরুল

“আপনারা রিজার্ভের টাকা চিবিয়ে খাননি, গিলে খেয়ে ফেলেছেন,” অভিযোগ তার।

শেখ মফিজুর রহমান শিপন. ফরিদপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2022, 04:00 PM
Updated : 12 Nov 2022, 04:00 PM

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে কোনোভাবেই নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে আবারও হুঁশিয়ারি দিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, ক্ষমতাসীনদের এখনই পদত্যাগ করতে হবে।

শনিবার ফরিদপুরে দলীয় সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমি ক্ষমতা ছাড়ব না। তোমরা যে যাই বলো ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই-এটা আর হবে না। এটা আর হবে না।”

বিএনপির আগের কয়েকটি বিভাগীয় সমাবেশের মত এটিও বাসসহ দূরপাল্লার যান বন্ধের কারণে আলোচনায় ছিল।

সমাবেশের আগের দিন থেকেই ফরিদপুর শহরের অদূরে কোমরপুর আবদুল আজিজ ইনস্টিটিউশন মাঠে দূর দূরান্ত থেকে আসতে দেখা যায় নেতাকর্মীদের। শুক্রবার রাতেই ভিড় বেড়ে মাঠ পূর্ণ হয়ে যায়, খাওয়া দাওয়াসহ গল্পে পুরো এলাকায় ছিল উৎসবের আমেজ।

শনিবার বেলা আড়াইটায় সমাবেশের প্রধান অতিথি ও অন্যান্য অতিথি মঞ্চে আসলেও নেতাদের বক্তব্য দেওয়া শুরু হয় সকাল ১১টা থেকেই। এর আগেই সমাবেশের মাঠ কানায় কানায় ভরে ওঠে।

ফরিদপুর ও আশপাশের জেলার নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে জড়ো হন। এ সময় নেতাকর্মীরা রঙ-বেরঙের টি-শার্ট, ক্যাপ পরে নেতাদের ছবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন বহন করে।

সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার এদেশের মানুষের মনের দাবি। কারণ বিগত দুইটা নির্বাচনে আপনারা মানুষকে প্রবঞ্চনা করে, মিথ্যা কথা বলে, আপনারা ভুল বুঝিয়ে নির্বাচন- নির্বাচন খেলা করে ক্ষমতায় চলে গেছেন। কিন্তু এবার আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি, মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।”

দলের দাবি তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা চাই, এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার পদত্যাগ। পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা দিতে হবে।“

জাতীয় সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে সেই সরকারের মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রের মেরামতের কাজ’ করার কথা বলেন তিনি।

“আমরা নতুন করে বিচার বিভাগকে সাজাতে চাই ন্যায় বিচারের স্বার্থে; আমরা নতুন করে প্রশাসনকে সাজাতে চাই সুশাসনের স্বার্থে, আমরা দুর্নীতি বন্ধ করতে চাই।”

বক্তব্যের শুরুতে মির্জা ফখরুল বৃহত্তর ফরিদপুরের প্রয়াত রাজনীতিক হাজী শরীয়তুল্লাহ, মুহাম্মদ মুহসীনউদ্দীন দুদু মিয়া, শেখ মুজিবুর রহমান, কে এম ওবায়দুর রহমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের নাম উল্লেখ করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

‘ঘোড়াও হাসবে’

ফখরুল বলেন, “গতকাল (শুক্রবার) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব ওই যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা মহাসমাবেশ করছে না যুবলীগের নামে…ওইখানে উনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ নাকি সংগ্রাম করছে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য।

“এই কথা শুনলে ঘোড়াও হাসবে। আর বলবে ভূতের মুখে রাম রাম। যারা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিল, যারা গণতন্ত্রকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলল, যাদের গণতন্ত্রের মানে হচ্ছে যে- কোনো মানুষ ভোট দিতে পারবে না, জোর করে ভোট দেবে; তাদের গণতন্ত্রের মানে হচ্ছে গুম করা, খুন করা, হত্যা করা, বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া। তারা বলে তারা নাকি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে!”

তিনি আওয়ামী লীগ সম্পাদকের কাছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাও জানতে চান।

বিএনপি মহাসচিবের অভিযোগ, “আজকে ফরিদপুরের এ জনসমাবেশকে পণ্ড করার জন্য, নস্যাৎ করার জন্য তিন দিন আগে থেকে তাদের আজ্ঞাবহ পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, মালিক ইউনিয়ন দিয়ে পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে।পথে পথে সিকিউরিটি চেক বসিয়েছে। আমাদের পুলিশ ভাইয়েরা আটকায়। জিজ্ঞাসা করে কোথায় যাবেন। বলে, ‘যাওয়া যাবে না, রাস্তা বন্ধ আছে’।

“বরিশালে আরও খারাপ কাজ করেছে। বরিশালে ট্রলারে করে মানুষজন যখন আসছিল, সেই ট্রলার ফেলে দিয়ে লোকজনকে নদীতে ফেলে পিটিয়েছে। বাস থেকে নামিয়ে মেরেছে, ময়মনসিংহে একইভাবে গোলাগুলি করেছে। এই হচ্ছে আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র।”

‘এত ভয় কেন’? প্রশ্ন রেখে তিনি নিজেই উত্তরে বলেন, “জনগণ থেকে তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছ। জনগণের সাথে তোমাদের কোনো সম্পর্ক নাই।“

মুক্ত বিএনপি চেয়ারপারসনকে ‘ভয়’ পায় বলেই বর্তমান সরকার তাকে জামিন তো নয়ই, বিদেশে চিকিৎসার জন্যও যেতে দিচ্ছে না বলে তার অভিযোগ।

‘মাফিয়াদেরও জামিন হয়, মুক্তি পায়’

মির্জা ফখরুল বলেন, “আজকে তোমরা ক্যাসিনো সম্রাটকে জামিন দিয়ে মুক্ত করে দাও। সে এখন যুবলীগে মহাসমাবেশে সামনের সারিতে শেখ হাসিনার সাথে বসে থাকে। কী দেশ আমাদের! যারা লুট করে, যারা মাফিয়া হিসেবে কাজ করে, যারা এদেশের সব কিছু ধ্বংস করে দেয়, তাদের জামিন হয়, তারা মুক্তি পায়।

“অথচ গণতন্ত্রের জন্য যিনি ৯ বছর সংগ্রাম করলেন এবং যিনি জীবনের ৩৫টি বছর গণতন্ত্রের জন্য কাজ করেছেন, তাকে তোমরা আটকিয়ে রেখে দাও। আমাদের নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাকে কতগুলো মিথ্যা মামলায় সাজিয়ে-গুছিয়ে তাকে সাজা দিয়ে বসে আছে। আরে ওই সাজা কি টিকবে? টিকে কখনও? মিথ্যা মামলায় সাজা টিকে না কখনও।”

ক্ষমতাসীনদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “এভাবে কাউকে আটকিয়ে রাখা যায় না। আর জোর করে, জবরদস্তি করে কোনোদিন মানুষের ন্যায়ের সংগ্রামকে বন্ধ করে রাখা যায় না।“

সরকার ফের ‘অতীতের মত মিথ্যা মামলা’ দায়েরের কৌশল নিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন বিএনপির এই নেতা।

“এখন শুরু করেছে নতুন কায়দা। সেই কায়দা কী? মামলা শুরু করেছে। গত কয়েকদিন আগে নরসিংদীতে দেখলাম- একজন আওয়ামী লীগের লোককে ধরেছে। তার বাড়িতে দেশি বোমা ও বারুদ পেয়েছে। ওকে ধরেছে। আর মামলা দিয়েছে আমাদের যুবদলের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারিসহ সাতজনের বিরুদ্ধে। এটা নতুন কৌশল।“

দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, “আপনারা গণতন্ত্রের কথা বলেন, সংবিধানের কথা বলেন। এই সংবিধানকে তো শেষ করেছেন আপনারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার করা হয়েছিল আপনাদের দাবি মেনে। আপনারা ১৭৩ দিন হরতাল করেছিলেন।

“তখন জাতীয় পার্টি-জামায়াতকে নিয়ে আন্দোলন করে এমন অবস্থা তৈরি করলেন, এক অচলাবস্থা। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যখন বুঝতে পারলেন যে, জনগণ এটা চায়; তখন তিনি পার্লামেন্ট ইলেকশন করে নতুন পার্লামেন্টে এক রাতে…আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটা পাস করেছি।“

রাজবাড়ী মহিলা দলের নেত্রী সোনিয়া আখতার স্মৃতিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে ফখরুল বলেন, “তার অপরাধ কী? তিনি একটা পোস্ট শেয়ার করেছিলেন। রাত্রি ২টার সময়ে তার দুই ছোট ছোট বাচ্চা আছে, তাদেরকে অসহায় অবস্থায় রেখে তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। সে নাকি প্রধানমন্ত্রীকে কটূ বাক্য বলেছেন।“

ক্ষমতাসীনদের ‘আচরণ’ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিবের আরও অভিযোগ, “ওরা মনে করে- দেশটা তাদেরই বাপের দেশ; তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। এখানে সাধারণ মানুষ আমরা সব চাকর-বাকর, ক্রীতদাস আরকি। আমাদেরকে যেমন খুশি ব্যবহার করা যাবে।

“আপনাদের কথাটা ভালো লাগবে না, সেটাই আপনারা করতে চাচ্ছেন। আপনারা যে ভাষায় কথা বলেন, এটা গণতন্ত্রের ভাষা নয়; আপনারা যে ভাষায় কথা বলেন, এটা সহনশীলতার ভাষা নয়। এটা দেশকে তৈরি করবার ভাষা নয়।”

ফের বিচারবহির্ভূত ‘হত্যাকাণ্ড’ শুরু হয়েছে উল্লেখ করে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে আপনারা শুরু করছেন, হত্যা করছেন। আমরা আর অন্যায় অত্যাচার সহ্য করব না। আমরা রুখে দাঁড়াব।“

‘খাজাঞ্চিখানায় টাকা নাই’

মির্জা ফখরুলের দাবি, “খাজাঞ্চিখানায় তো টাকা নাই, টাকা শেষ। এজন্য বলছেন যে- আর বাড়ানো হবে না ওই দুঃস্থ মহিলাদের তালিকা। কোথাও তাদের টাকা নাই। রিজার্ভে টাকা নেই। সব খেয়ে ফেলেছে। বড় বড় গলায় বলছে, একজন বললেন, আমরা কি টাকা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছি। আমরা বললাম যে, আপনারা টাকা চিবিয়ে খাননি। আপনারা রিজার্ভের টাকা গিলে খেয়ে ফেলেছেন।

“এই সরকার এমন একটা খাত বাকি রাখে নাই- যেখানে তারা চুরি করে নাই, দুর্নীতি করে নাই। আজকে চতুর্দিকে দুর্নীতি। আপনি যেখানে তাকাবেন, সেখানে দুর্নীতি। কোনো কাজ করতে পারবেন না ঘুষ না দিয়ে; কোনো কাজ হবে না টাকা না দিয়ে, কমিশন না দিয়ে কোনো কাজ হবে না।“

ফরিদপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এ এফ এম কাইয়ুম জঙ্গীর সভাপতিত্বে এবং মহানগরের সদস্য সচিব গোলাম মোস্তফা মিরাজ ও জেলার সদস্য সচিব  এ কে এম কিবরিয়া স্বপনের সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা শাহজাহান ওমর, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, জহিরুল হক শাহজাদা মিয়া, শাহ আবু জাফর, মজিবুর রহমান সারোয়ার, মাহবুবউদ্দিন খোকন, শ্যামা ওবায়েদ, অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া সেলিমুজ্জামান সেলিম, খন্দকার মাশুকুর রহমান মাশুক, নায়েবা ইউসুফ ও আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন, যুবদলের সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, কৃষক দলের শহিদুল ইসলাম বাবুল, স্বেচ্ছাসেবক দলের এস কে জিলানি, ছাত্রদলের কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবন, সাইফুল ইসলাম পটু, মোদারেছ আলী ইছা, এ কে কিবরিয়া স্বপন, বি সিদ্দিকী মিতুল।

 

‘ফরিদপুরে ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত’

এদিকে শনিবার সকাল ১০টা থেকে ফরিদপুর জেলায় মোবাইল ইন্টারনেট সেবায় বিঘ্ন ঘটছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় লোকজন।

বিএনপির ফরিদপুর বিভাগীয় সমাবেশের প্রেস উপ-কমিটির আহ্বায়ক এ বি সিদ্দিক মিতুল অভিযোগ করে বলেন, “সরকার নানাভাবে আমাদের এই সমাবেশকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে, সর্বশেষ তারা জেলার মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করেছে।”

সড়কে যানবাহন ছিল কম

ফরিদপুরে বিএনপির গণসমাবেশের আগের দিন শুক্রবার সকাল থেকে জেলা মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ডাকে আঞ্চলিক বাস, মিনিবাসসহ দূরপাল্লার সব রুটে বাস ধর্মঘট চলেছে।

শনিবার সকাল থেকে ফরিদপুর শহরে যান চলাচল একেবারেই কম দেখা গেছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। হাতে গোনা কিছু ভ্যান, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচল করলেও পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন যাত্রীরা।

জেলার প্রবেশপথ শহরের রাজবাড়ী রাস্তার মোড়, বদরপুরের মোড়, ভাঙ্গা রাস্তার মোড় ও ইমাম উদ্দিন স্কয়ার এলাকায় পুলিশের তল্লাশি চৌকি দেখা গেছে।

এসব স্থানে ইজিবাইক, ভ্যান, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন ছোট যান থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ যাত্রীদেরও নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।

কোমরপুর ফিলিং স্টেশনের সামনে কয়েকজন শ্রমিক জানান, তারা ধান কাটার জন্য মাদারীপুরের শিবচরে গিয়েছিলেন। এখন বাড়ি ফিরতে চেষ্টা করে ফরিদপুরে আটকা পড়েছেন।