হরতালে ঢাকায় বাসে আগুন-মৃত্যু, সড়কে চলাচল কম

প্রায় ৪৫ মাস পর বিএনপির এ হরতালের আগের দিন ও রাতেও নগরীতে যানবাহনে নাশকতা চালানো হয়েছে।

বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতালের মধ্যে রোববার সকালে ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেইটে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের পাশের সড়কে শিকড় পরিবহনের একটি বাস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকে বিএনপির নেতাকর্মীরা দিনভরই ছিলেন আড়ালে; আর কয়েক জায়গায় বাসে আগুন দিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর মধ্যে সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে ঢাকায় মানুষ বের হয়েছে কম, সড়কে যান চলাচলও ছিল সীমিত।

রাজধানীর কাকরাইল ও নয়াপল্টনে আগের দিন সংঘর্ষ থেকে শুরু হওয়া সংঘাতের পর হরতালের ঘোষণা আসার পরই বিকাল থেকেই বাসে আগুন দেওয়া হয়। দুর্বৃত্তরা ভোর বেলাতে ডেমরা এলাকায় একটি বাস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেন। পরে দিনের বেলা আরও কয়েকটি স্থানে বাসে আগুন দেওয়া হয়।

প্রায় ৪৫ মাস পর বিএনপির এ হরতালের আগের দিন ও রাতেও ঢাকাজুড়ে যানবাহনে নাশকতা চালানো হয়েছে।

এতে নগরীজুড়ে তৈরি হওয়া আতঙ্কের মধ্যে সকাল থেকেই সড়কে মানুষের উপস্থিতি ছিল স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কম। গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত গাড়িও সকালের ভাগে অতটা দেখা যায়নি।

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির সংখ্যা বাড়লেও রাজধানীতে চলাচলকারী বাসের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল; দূরপাল্লার বাসও ছেড়ে যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে বাসে আগুনের সময় দুই মৃত্যু ছাড়া রাজধানীতে তেমন বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ও সংঘাতের খবর আসেনি।

এরমধ্যে হরতালের প্রথমভাগে গুলশানের বাসা থেকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আটক করেন গোয়েন্দা পুলিশ। তাকে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় গোয়েন্দা কার্যালয়। দিনভর সেখানে রাখার পর রাতে তাকে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশ হত্যা এবং প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় রমনা মডেল থানায় করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হয়।

এদিন পুলিশ আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও মির্জা আব্বাসসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জ্যেষ্ঠসহ অনেক নেতার বাসাবাড়িতেও তল্লাশি চালায়। তবে তাদের কেউ সেসময় বাসায় ছিলেন না। 

হরতালের ভোর শুরু বাসে আগুনে

ঢাকার ডেমরায় ভোরে বাসে আগুন আর সেখানে ঘুমের মধ্যে ওই বাসের চালকের সহকারীর মৃত্যুর খবর দিয়ে শুরু হয় হরতালের সকাল। এর কয়েক ঘণ্টা পর মোহাম্মদপুরে বাসে আগুন দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় নির্মাণাধীন ভবনে উঠে পড়া এক ব্যক্তির নিচে পড়ে মৃত্যর খবর দিয়েছে পুলিশ।

এর মধ্যে আরও দুটি বাসে আগুন দিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা হয়েছে ঢাকায়।

দীর্ঘদিন পর ডাকা হরতালে দিনভর যানজটের এ শহরে রাস্তাগুলো ছিল ফাঁকা, মোটরসাইকেল-রিকশা-সিএনজি অটোরিকশার দখলে ছিল বড় সড়কগুলো। বাস চলেছে, তবে অন্যদিনের চেয়ে অনেক কম। বিপণিবিতান, দোকানপাট বেশির ভাগ জায়গাতেই বন্ধ ছিল।

ঢাকার মোড়ে মোড়ে দিনভর কড়া পাহারায় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যরা। শনিবারের সহিংসতার ঘটনায় বিএনপির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রাজধানীতে মামলা হয়েছে। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ‘ক্রাইমসিন’ হিসেবে হলুদ টেপ দিয়ে ঘিরে রেখেছে সিআইডি। সেখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। বিএনপির নেতারা সেভাবে মাঠে না থাকলেও হরতাল বিরোধী মিছিল-সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ।

ঢাকা ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় রোববার দিনের বেলা ১৫টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগের খবর দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। বিভিন্ন জায়গায় সংঘাতও হয়েছে। লালমনিরহাটে বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নাটোরে বাসার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন শ্রমিক দলের এক নেতা।

শনিবার ঢাকায় শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রাখতে পারেনি বিএনপি। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রাণঘাতী সংঘাতের পর পণ্ড হয়ে যায় তাদের কর্মসূচি। সেখানেই রোববার হরতালের ঘোষণা দলটি।

সকাল ৬টা থেকে হরতাল শুরুর আগে ভোর ৩টার দিকে ডেমরা পশ্চিম দেইল্লা পাকা রাস্তার ওপর পার্ক করে রাখা ‘অছিম পরিবহনের’ একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে বাসের হেলপার ২০ বছর বয়সী নাঈম ওরফে নাজিম পুড়ে মারা যান। সেখানে দগ্ধ হন রবিউল নামে আরেক যুবক।

ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা এরশাদ হোসাইন বলেন, “তারা দুজনই অছিম পরিবহন বাসের হেলপার। রাতে দুজন একটি বাসের ভেতর ঘুমিয়ে ছিলেন।”

ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা জানান, এরপর সকাল ৯টা ৬ মিনিটে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শেকড় পরিবহনের একটি বাসে আগুন লাগায় একদল দুর্বৃত্ত। সিদ্দিকবাজার ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায়।

এরপর সকাল ১০টা ২২ মিনিটে মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার ‘পরিস্থান পরিবহন’ এর একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়ার খবর আসে। আর ১০ টা ২৮ মিনিটে পুরান ঢাকার বংশালের তাঁতিবাজার মোড় ‘বিহঙ্গ’ পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়।

এদিকে মোহাম্মদপুরে পরিস্থান পরিবহন বাসে অগ্নিকাণ্ডের পর জনতার ধাওয়ায় জাকির হোসেন রোডের একটি নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে উঠেছিলেন আব্দুর রশিদ (৩৮) নামে এক ব্যক্তি। পরে তিনি সেখান থেকে পড়ে মারা যান।

পুলিশের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার আজিজুল হক বলেন, আসাদ অ্যাভিনিউয়ে মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের কাছে ‘পরিস্থান পরিবহন’ এর একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়েছিলেন রশিদ।

“আগুন দেওয়ার পর রাস্তার লোকজন ধাওয়া দিলে সে জাকির হোসেন রোডের একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছাদে গিয়ে ওঠে। ওই ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পালাতে গিয়ে রশিদের মৃত্যু হয়।"

তবে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর অভিযোগ, “হরতালের দিন দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে আদাবর থানার সাবেক যুবদল নেতা বর্তমানে আদাবর থানাধীন ৩০ নং ওয়ার্ড বিএনপির স্থানীয় সরকার বিষয়ক সম্পাদক মোঃ আবদুর রশিদকে যুবলীগ-ছাত্রলীগ-আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মারধর করার পর একটি নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে নিমর্মভাবে হত্যা করে।”

আগুন-মৃত্যুর খবরে থমথমে ঢাকা

সকাল থেকেই ঢাকার রাস্তায় বাস ছিল অনেক কম। বেসরকারি অনেক অফিসই তাদের কর্মীদের ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ এর সুযোগ দিয়েছে। জরুরি কাজ ছাড়া মানুষ পথে তেমন বের হননি। বাস না পেয়ে রিকশাতেই দূরের গন্তব্যে গিয়েছেন অনেকে।

মহাখালীতে প্রতিদিন সকালের অফিস সময়ে যানজট থাকলেও হরতালে ফাঁকা রাস্তায় ছুটতে দেখা যায় রিকশা ও অটোরিকশা। দুপুরে আগে আগে এই পথে মানুষের চলাচল বেশি দেখা যায়। দোকান-পাটও খুলতে শুরু করে।

মহাখালীতে অটোরিকশা চালক রফিক মোল্লা বলেন, “সকালের দিকে কিছু বাস ছিল। কিন্তু সকালে বাস পোড়ানোর পর থেকে রাস্তায় আর বাস নাই।”

হরতালের মধ্যেও বাস চলাচলের ঘোষণা দিয়েছিল ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতি। সকালে দূরপাল্লার বাস তেমন ছাড়েনি। বাসকর্মীরা বলছেন, যাত্রী না পাওয়ায় ট্রিপ বন্ধ রেখেছেন তারা।

সকালে দূরপাল্লার বাস না ছাড়লেও মহাখালী এলাকায় গাজীপুর-গুলিস্তান, গাজীপুর-সায়দাবাদ রুটে চলাচলকারী বলাকা ও আজমেরী গ্লোরীসহ কয়েকটি পরিবহনের দু-চারটি বাস চলতে দেখা যায়। সকালে মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকার তাঁতী বাজার ও গুলিস্তান এবং ঢাকার বাইরে কয়েকটি জেলায় বাসে আগুন দেওয়ার খবর এসেছে। বাস কম চলাচলের কারণ জানতে চাইলে পরিবহন শ্রমিকরা এই উদ্বেগের কথাও জানাচ্ছিলেন।

বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যেতে দেখা যায়নি।

মিরপুর, কল্যাণপুর, টেকনিক্যাল ও গাবতলী এলাকায় রাস্তার পাশে দোকানপাট খোলা থাকলেও যাত্রী ও পথচারী সকালে ছিল কম। বেলা বাড়ার সঙ্গে এসব এলাকায় বাড়ে ব্যস্ততা। দু-চারটি নগর পরিবহনের বাস চলতে দেখা গেছে। চলছে বিআরটিসির বাসও।

সকালে যাত্রাবাড়ী এলাকার সড়কে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে অনেক যাত্রীদের। তবে যাত্রীদের সংখ্যাও প্রতিদিনের মত ছিল না।

মাতুয়াইল-মতিঝিল রুটে চলাচল কারী তারাবো পরিবহনের সহকারী মাহতাব মিয়া বলেন, “যাত্রী নাই। মালিকে কইছে তাই গাড়ি লইয়া নামছে ওস্তাদে। যে কয়জন পাই তাই নিয়া যাইতাছি।’’

সকাল ৮টার দিকে সাধারণত যাত্রী ঠাসা থাকে এই রুট। সেখানে সকালে হাঁক-ডাকেও যাত্রী না পাওয়ার কথা জানান মাহতাব।

খিলগাঁওয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালের কাজ করেন সায়েম হোসেন, থাকেন সায়দাবাদে। সকাল ৯টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “রাস্তা একদম ফাঁকা। কোনো মানুষজন নেই, বাস যা আছে তার চেয়ে মানুষ একেবারেই কম। ফুটপাতে ব্যবসা করা লোকজনও নেই।”

রাজধানীর পান্থপথ এলাকায়ও সকালে দোকান-পাট খোলা ছিল কম। বেলা বাড়লে মানুষের চলাচলও বাড়ে। দুপুরের আগ দিয়ে পান্থপথ এলাকার সারি সারি ফার্নিচারের দোকানসহ প্রায় সব দোকানই খুলে যায়।

উদ্বেগ নিয়ে কর্মস্থলে

হরতালের দিন সকালে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়েই কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হন অনেকে। বাস কম থাকায় তাদের পোহাতে হয় ভোগান্তি। রিকশা বা অটোরিকশাতে বেশি ভাড়া দিয়ে ছুটতে হয় গন্তব্যে। সড়কে ব্যক্তিগত গাড়িও কম ছিল।

শনির আখাড়ায় মোটরসাইকেল চালক রফিউল ইসলাম বলেন, “সকাল ৮টায় যাত্রী পাওয়া যায়। আজ নেই, কোথাও মানুষের জটলা দেখিনি।”

মোটরসাইকেলে শনির আখড়া থেকে মিরপুর, বনানী, গুলশানের যাত্রী পরিবহন করেন রফিউল। তবে এই রুটে যাত্রী না পাওয়ায় সকালে মোহাম্মদপুরে একজনকে নামিয়ে ফের শনির আখড়া আসেন তিনি।

মাঠে ছিল আওয়ামী লীগ

হরতালে রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ছিল তৎপর। সকাল থেকে যাত্রাবাড়ী ও সায়দাবাদ এলাকায় পুলিশকে টহল দিতে দেখা যায়। যাত্রাবাড়ী, কাজলা, শনির আখাড়ায় হরতালের সমর্থনে বিএনপি-জামায়াতের কোনো মিছিল দেখা যায়নি। তবে বিভিন্ন ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা হরতালবিরোধী মিছিল করেন।

নয়াপল্টনে বিএনপির অফিসটি ‘ক্রাইমসিন’ হিসেবে হলুদ টেপ দিয়ে সংরক্ষণ করেছে সিআইডি। সেখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।

বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতালের প্রতিবাদে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা।

রোববার সকালে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফীর নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে বের হয়। এরপর জিপিও জিরো পয়েন্ট ঘুরে ফের সেখানে গিয়ে শেষ হয় ওই মিছিল।

মঙ্গলবার থেকে দেশজুড়ে ৩ দিনের অবরোধ বিএনপির

প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় গ্রেপ্তার ফখরুল আদালতে

শনিবারের সহিংসতার ঘটনায় ২৮ মামলা, গ্রেপ্তার ৬৯৬

'হত্যা-আগুন-ভাঙচুর' আর সংঘাতে গেল হরতালের দিন

দুই দিনে পুড়ল ৩৭ যানবাহন, পুলিশ বক্স, বিদ্যুৎ অফিস: ফায়ার সার্ভিস

মির্জা ফখরুল আটক

উত্তাপ গড়াল প্রাণঘাতী সংঘাতে, হরতাল বাড়াল উৎকণ্ঠা

সংঘর্ষ ছড়াল কয়েক স্থানে, পণ্ড বিএনপির সমাবেশ