বিজয়ী হওয়া ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ নেতা।
Published : 09 Jan 2024, 12:53 AM
আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পেয়েছেন সোয়া তিন কোটির বেশি ভোট। ভোটে চমক দেখানো স্বতন্ত্ররা অনেক স্থানেই নৌকার সঙ্গে সমানতালে লড়ে নিজেদের বাক্সে টেনেছেন ১ কোটি ২০ লাখের মতো ভোট।
এতে দৃশ্যমানভাবেই নৌকার বিপুল ভোট কমেছে। তবে স্বতন্ত্র হওয়ার সুযোগে ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই ভোট কেটেছে নৌকার।
একই সঙ্গে শুধু আসন সংখ্যায় নয়, তারা এবার ভালোভাবে বেকায়দায় ফেলেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীদেরও। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার পরও ভোটে দুর্দশায় পড়েছে এরশাদের দলটি; আসন সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমার পাশাপাশি ভোটও কমে গেছে। সংসদে বিরোধে দলে থাকা লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীরা পেয়েছেন মোটে ১৭ লাখের কিছুটা বেশি ভোট।
এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নেওয়া অধিকাংশই আওয়ামী লীগের, তাই নিজেদের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি হয়ে গেছে- বলছেন একজন বিশ্লেষক।
তুলনামুক কম ভোটার উপস্থিতির এবারের নির্বাচনের ভোটার সংখ্যার প্রাথমিক ফলাফল বিশ্লেষণে এসব তথ্য মিলেছে।
রোববার ২৯৯টি আসনে ভোট হলেও ২৯৮টির ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ ২২২টি, স্বতন্ত্র ৬২টি, জাতীয় পার্টি ১১টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসন পেয়েছে।
এসব আসনে এবার ভোট পড়েছে প্রায় ৪২ শতাংশ। এগুলোতে ১১ কোটি ৮৯ লাখ ভোটারের মধ্যে ৪ কোটি ৯৯ লাখ ভোটার ভোট দিয়েছেন।
আসন ছাড়ের ভাগাভাগির মধ্যে জাতীয় পার্টির ভোটও কমেছে একাদশ সংসদ নির্বাচনের তুলনায়।
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির পদধারী অন্য নেতারাও ভোট করায় দুই দলের প্রতীকের ভোট কমেছে। স্বতন্ত্র হিসেবে দলের লোকেরাই তাদের ভোটে ভাগ বসিয়েছেন।
সবশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৬ কোটি ৩১ লাখ ৭৬ হাজার ১১৪টি; যা ছিল প্রদত্ত ভোটের ৭৬%। সেবার বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ ৩৯টি দল অংশ নেয়।
এর আগে বিএনপির বর্জন করা ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৪৭ আসনে (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ১ কোটি ২৭ লাখ ৫৭ হাজার ৩৪৭; যা প্রদত্ত ভোটের ৭২.১৪%।
এর আগে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকায় ভোট পড়েছিল (শরিকদের ৭ প্রার্থী ছিল) ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬২৯, যা প্রদত্ত ভোটের ৪৮.০৪%।
‘দল চ্যালেঞ্জে পড়লে তারা ঠিকই ভোট দিতে যেত’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নেওয়া অধিকাংশই আওয়ামী লীগের। তাই নিজেদের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি হয়ে গেছে।”
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট যুক্ত করা হলে ভোটের হিসাব ভিন্ন হতো বলে মনে করেন তিনি।
তার মতে, ওই সব প্রার্থীদের ভোট যদি যুক্ত করা হয় তাহলে বরং একাদশ নির্বাচনে পাওয়া ভোটের চেয়ে বেশি হবে।
এবার গতবারের তুলনায় কম ভোট পাওয়ার ব্যাখ্যায় এই বিশ্লেষক বলেন, “একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধীদল অংশ নিয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগের ভোট ভাগ না হয়ে সকল ভোট আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে দিয়েছিল। তাই ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোটের হারও বেড়ে গিয়েছিল।”
এবারও যদি আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকত তাহলে এবারও গতবারের মতোই বা ভোট পাওয়ার হার আরও কিছুটা বাড়তে পারতো, উল্লেখ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, “যে ভোট কাস্টিং হয়েছে, ৪০ শতাংশের একটু বেশি। সেটা খুব যে দারুণ ভোট কাস্টিং তা নয়। কিন্তু এ ধরণের ভোট কাস্টিংয়ে ‘কাজ চলে যায়’। যেহেতু অন্য একটি দল নির্বাচনে আসে নাই, সেই দুঃখ তো থেকেই গেল। তবে বিএনপি ডাক দিয়েছে বলে ভোট কমেছে- এটা বলাটা ঠিক হবে না।”
তার মতে, এখানে একাধিক ফ্যাক্টর কাজ করেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গাতে আবহাওয়ার ব্যাপারটা ছিল।
“এবারের ভোটে মানুষ আগে থেকেই জানে, জয়-পরাজয় মূলত আওয়ামী লীগের মানুষজনের মধ্যেই হবে। যারা সরকারের বড় সমর্থক তাদের একটি অংশ ভোট দিতে যাননি। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়। পশ্চিমা বিশ্বেও যখন দেখা যায়, যখন তার দল চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যায়, তখন সে ভোট দিতে যায়।”
এবারের ভোট: আওয়ামী লীগ ৬৬%, স্বতন্ত্র ২৪%
রোববার ২৯৮ আসনের ১১ কোটি ৮৯ লাখ ৮৯ হাজার ২৪১ ভোটারের মধ্যে ৪ কোটি ৯৯ লাখ ৬৫ হাজার ৪৬৭ জন ভোট দিয়েছেন; প্রদত্ত ভোটের হার প্রায় ৪২ শতাংশ।
এর মধ্যে প্রায় ৬৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা; সংখ্যায় মোট সোয়া তিন কোটিরও বেশি। স্বতন্ত্ররা পেয়েছেন ২৪ শতাংশ ভোট। জাতীয় পার্টি পেয়েছে ৩ শতাংশ এবং অন্যান্যরা পেয়েছে ৭%।
আওয়ামী লীগের রেকর্ড ভোট, বিএনপির অর্ধেক জামানতহারা
প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের জয়ী ২২২ প্রার্থী তিন কোটির বেশি ভোট এবং দলটির হেরে যাওয়া নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পেয়েছে ২৭ লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি ভোট।
জাতীয় পার্টির জয়ী ১১ জন সাড়ে নয় লাখের মতো ভোট পেয়েছেন। হেরে যাওয়া প্রার্থীরা পেয়েছেন সাড়ে সাত লাখেরও বেশি। সব মিলিয়ে লাঙ্গলের প্রার্থীরা পেয়েছেন ১৭ লাখের বেশি ভোট।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে জাপার দ্বিগুণ প্রার্থী জয় পেয়েছিল, দলটি ৪৪ লাখেরও বেশি ভোট পায়, যা ছিল প্রদত্ত ভোটে ৫.৩৭%।
এবার আলোচনায় থাকা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন রেকর্ড সংখ্যক ৬২ আসনে। আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলে দেড় শতাধিক আসনে হেরে যাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন প্রায় ৭১ লাখ ভোট। সব মিলিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন এক কোটি ২০ লাখের বেশি ভোট।
এবার আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চার কোটি ৬৪ লাখেরও বেশি ভোট পায়। বাকি সাড়ে ৩৫ লাখ ভোট পান ২৬টি দলের হেরে যাওয়া প্রার্থীরা, যা প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৭%।
এবার ভোটে অংশ নেওয়া মোট ২৮টি দলের মধ্যে জাসদ, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির দুজন জয়ী হন নৌকা প্রতীকে। জাতীয় পার্টি-জেপি নৌকা নিয়ে ভোট করে হেরে যান এবং কল্যাণ পার্টি একটি আসনে জয় পায়।