দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর কেউ খেলতে পারবে না: প্রধানমন্ত্রী

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, যারা ‘জয়বাংলা’ স্লোগানে বিশ্বাস করে না, ৭ মার্চের ভাষণকে প্রেরণা বলে মনে করে না, তারা স্বাধীন বাংলাদেশই চায় না। দেশের মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নতি চায় না।“

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2024, 03:12 PM
Updated : 7 March 2024, 03:12 PM

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করলেও তাকে অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে দেওয়া হয়নি মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতেই হবে। দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর খেলতে দেওয়া হবে না।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের ৫৩ বছর পূর্তির দিন বৃহস্পতিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, “দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য জাতির পিতা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটাই আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। যে কাজটা তাকে করতে দেওয়া হয়নি।

“১৫ অগাস্ট নির্মমভাবে হত্যা করে মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। কাজেই এই দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর কেউ যেন ছিনিমিনি খেলতে না পারে।”

যারা মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনী ‘জয়বাংলা’ স্লোগানে বিশ্বাস করে না, ৭ মার্চের ভাষণকে যারা প্রেরণা বলে মনে করে না, তারা স্বাধীন বাংলাদেশই চায় না বলেও মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ প্রধান। বলেন, “তারা দেশের উন্নয়ন চায় না, দেশের মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নতি চায় না।“

তাদেরকে মানুষ কেন ভোট দেবে?-সেই প্রশ্ন রেখে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, “সেজন্যই তারা বারবার ইলেকশন বানচাল করে মানুষের দুর্ভোগ বাড়াতে চায়, বারবার অগ্নিসন্ত্রাস সৃষ্টি করে দেশটাকে ধ্বংস করতে চায়।”

উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য সবাইকে কাজ করে যেতে হবে।”

অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার লেখা ও সংকলন নিয়ে বই ‘বঙ্গবন্ধু থেকে দেশরত্ন: অনুপ্রেরণার মহাকাব্য’ এর মোড়ক উন্মোচন করেন শেখ হাসিনা। 

স্বাধীনতার চিন্তা ১৯৪৮ সাল থেকেই

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পরের বছরই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের কথা ভাবতে শুরু করেন বলেও জানান শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পর জাতির পিতাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘স্বাধীনতার কথা আপনি কখন থেকে চিন্তা করেন?’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘১৯৪৮ সালে যখন মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার পাকিস্তানিরা কেড়ে নিয়েছিল, সেদিন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওদের সঙ্গে আর থাকব না’।”

ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই স্বাধীনতা এসেছে বলে মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, “দিনের পর দিন অধিকারবঞ্চিত-শোষিত মানুষের কথা বলতে গিয়ে তিনি বারবার কারাবরণ করেছেন, জেল, জুলুম, অত্যাচার সহ্য করেছেন, যে লক্ষ্য তিনি স্থির করেছিলেন, সেই লক্ষ্য সামনে রেখে একটার পর একটা পদক্ষেপ নিয়েছেন।

“যেটা কখনো তিনি মুখে উচ্চারণ করেননি। কিন্তু একটি জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা বা তাদেরকে সংগঠিত করা, ঐক্যবদ্ধ করা- এটা একটি কঠিন কাজ ছিল। সেই কঠিন কাজ তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করে যান।”

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তারের পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি থাকার সময় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল জানিয়ে সেটি নস্যাৎ করে দেওয়ার কাহিনীও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “আইয়ুব খান কারাগার থেকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেই দিনটা কঠিন ছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের আওয়ামী লীগের অনেক বড় বড় নেতা কিন্তু সাময়িক মুক্তি পেয়ে আইয়ুব খানের সঙ্গে বৈঠকে বসার পক্ষে ছিল।

“তারা সেদিন বন্দিখানায় ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে যান এবং বাবাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, ‘আপনার যাওয়া উচিত।’

“বিমান রেডি তেজগাঁও এয়ারপোর্টে, নাসির নামে একজনের নেতৃত্বে গাড়ি রেডি রয়েছে। আমাদের তাজউদ্দিন সাহেব, মোমেন সাহেব, ডা. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম থেকে শুরু করে মানিক মিয়া, সবাই কিন্তু সেখানে উপস্থিত। আমার মা অনেক আগেই বলেছিলেন যে, ‘এই ধরনের একটা প্রস্তাব আসবে কখনই তুমি মানবে না।’

“ঐ দিন আমার মা যখন খবর পেলেন সব নেতারা ওখানে গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেছেন, তখন মা আমাকে বললেন, ‘তোমাকে এখনই ওইখানে যেতে হবে।’

“আমি গেলাম, বাইরে দাঁড়ানো। আমাদের নেতাদের ভেতরে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমি গেইটের বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি অপেক্ষায় ছিলাম কখন বাবা আমাকে একটু দেখতে পাবেন।

“একটা কাঁচের দরজা ছিল। আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। আব্বা যখন দেখলেন, চলে আসলেন। আব্বা বলল, ‘তোর মা কী বলেছে? কোনো চিঠি চিঠি দিতে আসিস না। কারণ, নেতারা তো ওখানে ঘুরঘুর করছে।

“আমি বললাম, ‘নেতারা সব এসেছেন আপনাকে বুঝাইয়া নিতে। মা বলছেন, এই অবস্থায় প্যারোলে আপনাকে যাওয়া যাবে না। মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। সব বন্দিরা মুক্তি পাবে, তার পরেই যাবেন।’ আব্বা বললেন, ‘ঠিক আছে’।”

তখন আওয়ামী লীগ নেতাদের অবস্থানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ঘণ্টাখানেক ধরে আমাদের নেতারা কিন্তু আব্বাকে ওটাই বুঝিয়েছে। যখন তারা বুঝল আব্বা কিছুতেই রাজি না, তখন ওনারা সবাই চলে আসলেন ৩২ নম্বর বাড়িতে।

“তারা বলছেন, ‘আপনি এটা কী করলেন ভাবি (বঙ্গবন্ধু পত্নী)? দেশের সর্বনাশ করে দিলেন। সব থেকে মারাত্মক কথা হল, আপনি বিধবা হবেন, ওরা তো মুজিব ভাইকে মেরে ফেলবে’।”

এর কিছুদিন আগেই ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহরুল হককে হত্যা করা হয়।

শেখ হাসিনার ভাষ্য, “মা বললেন, যদি মুক্তি পেতেই হয় সকলকে নিয়েই মুক্তি পেতে হবে। বিধবা তো আর আমি একা হব না, ৩৪ জন সবাই হবে, তাদের কী হবে?”

মঞ্চে উপস্থিত সংসদ সদস্য নাহিদ এজহারের দিকে তাকিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, “তার বাবাও বন্দি ছিল ওই সময়। কতটা অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল!”

সশস্ত্র লড়াইয়ে পাকিস্তান ভাঙার চক্রান্তের অভিযোগে ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়েছিল, তার অন্যতম আসামি ছিলেন নাহিদ এহজারের বাবা নাজমুল হুদা।

শেখ হাসিনা জানান, তার মাকে মানাতে না পেরে আওয়ামী লীগের নেতারা তার কাছে ছুটি যান।

তিনি বলেন, “আমি বারান্দায় গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানে আমাদের দুই নেতা গেলেন, তারা বললেন, ‘তুমি কেমন মেয়ে বল তো, তুমি চাও না তোমার বাবা জেল থেকে মুক্তি পাক? তুমি কেন সেখানে গিয়েছিলে?’

“তখন আমি বলেছিলাম, ‘আমার বাবা, বাবার মতই মাথা উঁচু করে ফেরত আসবে। আপনারা বোঝাতে আসবেন না।’

“আমি খুব চোটপাটের মধ্যে কথাটা বলে ফেলেছি, এর মধ্যে মাও এসেছে। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। মা বলল, ‘কোনো চিন্তা নেই, তোমার বাবা ঠিকই বের হয়ে আসবে। কারণ, জনগণ সঙ্গে আছে। জনগণের শক্তি বড় শক্তি, ওরা কিছু করতে পারবে না’।”

মায়ের আত্মবিশ্বাস নিয়ে এখনো বিস্ময় জাগে শেখ হাসিনার। তিনি বলেন, “একটা অদ্ভুত শক্তি ছিল আমার মায়ের। দেশের কঠিন কঠিন সময়ে তিনি সিদ্ধান্তগুলো দিয়েছিলেন। সেটাই কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।”