Published : 06 May 2025, 09:30 AM
লন্ডনে চার মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর দেশে ফিরছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া; তাকে বরণ করে নিতে নেতাকর্মীরা সকাল থেকেই ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে অবস্থান নিয়েছেন।
গত জানুয়ারিতে যেভাবে লন্ডনে গিয়েছিলেন, সেভাবেই কাতারের আমিরের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে খালেদা জিয়া দেশে আসছেন। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় তার ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে। তার সঙ্গে দেশে আসছেন দুই পুত্রবধূ- তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান সিঁথি।
এদিন ভোরের আলো ফোটার পর থেকেই থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিমানবন্দর সড়কে জড়ো হতে শুরু করেন। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বনানী, খিলক্ষেত, বিমানবন্দরে অবস্থান নেন।
তারা পিকআপ কিংবা বাসে করে গান বাজাতে-বাজাতে দলের পতাকা, দেশের পতাকা উপস্থিত হয়েছেন নেত্রীকে স্বাগত জানাতে। কেউ-কেউ মাথায় দলের পতাকা লাগিয়ে এসেছেন।
‘খালেদা জিয়ার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম', ‘খালেদা, জিয়া', ‘তারেক, রহমান', ‘খালেদা জিয়া ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই' ইত্যাদি স্লোগান দিচ্ছেন তারা।
নেতা-কর্মীদের অবস্থান ঘিরে সড়কে ও বিমানবন্দর এলাকায় বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্য, পুলিশ, র্যাব, এপিবিএন ও আনসার সদস্যকে অবস্থান নিতে দেখা গেছে।
খিলক্ষেত থানা ছাত্রদলের কর্মী জিয়াউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাটি ও মানুষের নেত্রী আজ দেশে আসবেন। তাকে শুভেচ্ছা জানাতেই আসা। বাংলাদেশের মানুষ প্রিয় নেত্রীর অপেক্ষায়।”
পল্টন থেকে আসা বিএনপি সমর্থক আজাদ হোসেন বলেন, “চার মাস পর আপসহীন নেত্রী আসছেন। এটা আমাদের এবং পুরো জাতির জন্য আনন্দের। আমরা এসেছি তাকে বরণ করে নিতে। পুরো দেশের মানুষই আজ তার আগমনের দিকে পথ চেয়ে আছে।"
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিমানবন্দরে আসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, জ্যেষ্ঠ যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, “খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা গণতন্ত্রের উত্তরণের পথকে সহজ করবে। আজ দেশের জন্য ও জনগণের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিন।”
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরা ঘিরে ঢাকার সড়কে যানজট হতে পারে–এমন শঙ্কায় বিদেশগামী যাত্রীদের বিমানবন্দরে যেতে হাতে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে বের হওয়ার অনুরোধ করেছে এয়ারলাইন্সগুলো। বিমানবন্দর এলাকায় নেওয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তা।
খালেদা জিয়ার জন্য গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে তার বাসভবন ‘ফিরোজা’ পুরোপুরি প্রস্তুত করা হয়েছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
পথনকশা মেনে নেতাকর্মীদের অবস্থানের নির্দেশ
বিমানবন্দর থেকে তার গুলশানের বাসায় যাওয়ার পথে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর পথনকশা ঠিক করে দলীয় নেতাকর্মীদের সে অনুযায়ী অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছে বিএনপি।
দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বিএনপি ও এর বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের সবাইকে সুশৃঙ্খলভাবে রাস্তার দুইধারে অবস্থান নিয়ে নেত্রীকে স্বাগত জানাতে হবে। সব নেতাকর্মীদের দলীয় পতাকা ও জাতীয় পতাকা হাতে রাস্তার এক পাশে দাঁড়াতে হবে। গাড়ি বহরের সঙ্গে মোটরসাইকেলে যাওয়া যাবে না। হেঁটেও যাওয়া যাবে না।
এছাড়া বিমানবন্দর ও বিএনপির চেয়ারপারসনের বাসা ফিরোজায় কেউ ঢুকতে পারবেন না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
দলের নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির কর্মীরা অবস্থান নিচ্ছেন বিমানবন্দর থেকে লো মেরিডিয়েন হোটেল পর্যন্ত। ছাত্রদল লো মেরিডিয়েন হোটেল থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত। আর যুবদল কর্মীরা অবস্থান নিচ্ছেন খিলক্ষেত থেকে হোটেল র্যাডিসন পর্যন্ত।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির নেতাকর্মীরা থাকবেন হোটেল র্যাডিসন থেকে আর্মি স্টেডিয়াম পর্যন্ত।
স্বেচ্ছাসেবক দল অবস্থান করবেন আর্মি স্টেডিয়াম থেকে বনানী কবরস্থান পর্যন্ত। কৃষক দল বনানী কবরস্থান থেকে কাকলী মোড় পর্যন্ত এবং শ্রমিক দল বনানীর শেরাটন হোটেল পর্যন্ত থাকবে।
পথের বাকি অংশের মধ্যে ওলামা দল, তাঁতীদল, জাসাস, মৎস্যজীবী দলের নেতাকর্মীরা অবস্থান করবেন বনানী কাঁচাবাজার পর্যন্ত। এরপর মুক্তিযোদ্ধা দলসহ সব পেশাজীবী সংগঠন অবস্থান করবে গুলশান-২ গোলচত্বর পর্যন্ত।
মহিলা দল অবস্থান করবে গুলশান-২ নম্বর গোলচত্বর থেকে গুলশান অ্যাভিনিউ রোড পর্যন্ত। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যরা গুলশান-২ নম্বর গোলচত্বর থেকে গুলশান অ্যাভিনিউ রোড পর্যন্ত অবস্থান করবেন।
বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীদের নিজেদের সুবিধামত স্থানে অবস্থান নিতে বলা হয়েছে।
যান চলাচলে বিধিনিষেধ
খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা উপলক্ষে নেতাকর্মীদের ভিড় সামলাতে ঢাকা মহানগর পুলিশও বিমানবন্দর সড়কে যানচলাচল নিয়ন্ত্রণ করার কথা জানিয়েছে।
জনসাধারণকে এদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গুলশান/বনানী থেকে উত্তরা পর্যন্ত সড়ক যথাসম্ভব পরিহার করে বিকল্প রাস্তায় চলাচলের অনুরোধ করা হয়েছে পুলিশের তরফ থেকে।
ওই সময়ে বিএনপিকর্মীদের রাস্তায় না থেকে ফুটপাতে অবস্থান করতে এবং প্রয়োজনীয় স্বেচ্ছাসেবক মোতায়েন করে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করার অনুরোধ করা হয়েছে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওই সময় অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচলের সুযোগ থাকবে। ঢাকা সেনানিবাসের রাস্তায় চলতে পারবে হালকা যানবাহন।
সোমবার ডিএমপির পাঠানো গণবিজ্ঞপ্তিতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার তথ্য তুলে ধরে সকলের সহযোগিতা চাওয়া হয়।
>> মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গুলশান/বনানী হতে উত্তরা পর্যন্ত সড়ক যথাসম্ভব পরিহার করে আব্দুল্লাপুর কামারপাড়া-ধউর ব্রিজ-পঞ্চবটী-মিরপুর বেড়িবাঁধ দিয়ে গাবতলী হয়ে চলাচল করতে অনুরোধ করা হয়েছে চালকদের।
>> জটিলতা এড়াতে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
>> উত্তরা ও মিরপুরের বাসিন্দাদের বিমানবন্দর সড়ক ব্যবহার না করে বিকল্প হিসেবে হাউজ বিল্ডিং-জমজম টাওয়ার-১২ নম্বর সেক্টর খালপাড়-মেট্রোরেল উত্তরা উত্তর স্টেশন- উত্তরা সেন্টার স্টেশন-মিরপুর ডিওএইচএস হয়ে চলাচল এবং উত্তরা সেন্টার স্টেশন হতে ১৮ নম্বর সেক্টর-পঞ্চবটী হয়ে মিরপুর বেড়িবাঁধ দিয়ে চলাচল করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
>> গুলশান, বাড্ডা ও প্রগতি সরণি এলাকার যাত্রীরা কাকলী, গুলশান-২, কামাল আতাতুর্ক সড়কের পরিবর্তে গুলশান-১/পুলিশ প্লাজা-আমতলী-মহাখালী হয়ে মহাখালী বাস টার্মিনাল সংলগ্ন র্যাম্প ব্যবহার করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে এয়ারপোর্ট/উত্তরা যেতে পারবেন।
>> মহাখালী বাস টার্মিনাল হয়ে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলগামী যানবাহন মিরপুর-গাবতলী রোড হয়ে চলাচল করতে পারবে।
>> এয়ারপোর্ট/৩০০ ফিট রাস্তা হয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলা যানবাহন বনানী/কাকলী র্যাম্পের পরিবর্তে মহাখালী র্যাম্প/এফডিসি র্যাম্প ব্যবহার করতে পারবে।
>> ঢাকা সেনানিবাসের রাস্তায় (জিয়া কলোনি/জাহাঙ্গীর গেইট/সৈনিক ক্লাব/স্টাফ রোড) সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত শুধু হালকা যানবাহন চলতে পারবে।
>> এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে অটোরিক্শা ও মটরসাইকেল নির্ধারিত টোল পরিশোধ করে সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার গতিতে এক্সপ্রেসওয়ের বাম পাশের সেইফ লেন ব্যবহার করে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলতে পারবে। ওভার স্পিড ও লেইন পরিবর্তন ঠেকাতে এক্সপ্রেসওয়েতে পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ থাকবে।
>> বিকল্প হিসেবে ঢাকা-জয়দেবপুর পথে চলা ট্রেন ব্যবহার করা যাবে। করা হলো। ডিএমপির অনুরোধে সকল আন্তঃনগর ট্রেন মঙ্গলবার সকাল হতে দুপুর পর্যন্ত টঙ্গী, এয়ারপোর্ট এবং তেজগাঁও স্টেশনে দুই মিনিটের জন্য থেমে যাত্রী নেবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কমলাপুর-টঙ্গী রুটে অতিরিক্ত একটি শাটল ট্রেন পরিচালনা করবে।
>> হজযাত্রীসহ বিদেশগামী যাত্রীদের এয়ারপোর্টে যাওয়ার ক্ষেত্রে এবং ওই এলাকায় এসএসসি পরীক্ষার্থীদের যথেষ্ট সময় নিয়ে বাসা হতে বের হতে হবে।
>> মিরপুর ও উত্তরাবাসীকে বিকল্প হিসেবে মেট্রোরেল ব্যবহারের অনুরোধ করা হয়েছে।
>> খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে আসা কাউকে ব্যাগ, লাঠি ইত্যাদি বহন না করার অনুরোধ করা হয়েছে।
>> অভ্যর্থনা জানাতে আসা কেউ যানবাহন নিয়ে খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে যুক্ত হতে পারবে না।
>> অভ্যর্থনা জানাতে আসা কেউ মোটরসাইকেল নিয়ে কোনোক্রমেই গুলশান/বনানী হতে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত অবস্থান করতে পারবেন না বা মটরসাইকেল নিয়ে লোকজনের মধ্যে চলতে পারবেন না। তবে ওই রাস্তা দিয়ে (জনসমাগম না হলে) সাধারণ বাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেল চলতে পারবে।
আবেগঘন বিদায়
৭৯ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন থেকে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির পাঠানো রাজকীয় বহরের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স করে গত ৭ জানুয়ারি লন্ডনে যান।
সেখানে লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসাধীন ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। টানা ১৭ দিন ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি ২৫ জানুয়ারি থেকে ছেলে তারেক রহমানের বাসায় ছিলেন।
দেশে ফেরার জন্য সোমবার দুপেুরে খালেদা জিয়া লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তার বড় ছেলে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই গাড়ি চালিয়ে মাকে বিমানবন্দরে নিয়ে যান। তারেকের মেয়ে জায়মা রহমানও গাড়িতে ছিলেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনকে বিদায় জানাতে দলটির প্রবাসী নেতাকর্মীরাও হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিড় করেন। বিদায় বেলায় টার্মিনালে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। হুইল চেয়ারে বসা খালেদা জিয়াকে জড়িয়ে ধরেন ছেলে তারেক ও নাতনি জায়মা।
২০০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে দেশ ছাড়ার পর থেকে লন্ডনেই আছেন তারেক রহমান এবং তার স্ত্রী জোবাইদা রহমান। ১৭ বছর পর শাশুড়ির সঙ্গে দেশে ফিরছেন জোবাইদা, তবে তারেক কবে ফিরতে পারবেন, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
তাকে দেখিয়ে বিমানবন্দরে উপস্থিত বিএনপিকর্মীদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, “ভাইয়াকে দেখে রেখো।”
স্থানীয় সময় সোমবার বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে কাতারের আমিরের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স খালেদা জিয়াকে নিয়ে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর ত্যাগ করে।
পাুরনো খবর
দুই পুত্রবধূকে নিয়ে দেশের পথে খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা: গাড়ি রাখার বিষয়ে পুলিশের নির্দেশনা