Published : 05 May 2025, 11:46 PM
বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে জোরালো অবস্থান নিলেও এখনই ভোট চায় না জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। বাস্তবতার নিরিখে নতুন দল হিসেবে এখনই ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো ভাবনা ‘বাস্তবসম্মত নয়’ বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
সেই কারণে তারা চাইছেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিচার এবং সংবিধান ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংস্কার।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের দলটি গণপরিষদ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা মানুষের কাছে তুলে ধরার কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। আর নির্বাচন প্রশ্নে এখন ছাত্র সংসদ আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আগ্রহ রয়েছে তাদের।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মত ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা বা বামপন্থিদের মত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়নি এনসিপি। ডান, বাম ও বিভিন্ন মত, ধর্ম ও পথের তরুণদের সামনে রেখে ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করা দলটি ‘ন্যায় ও সমতার’ ভিত্তিতে ‘বহুত্বপূর্ণ’ সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণাপত্রে বলেছে।
যদিও দলটি এখনো তাদের গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেনি, গঠনতন্ত্র ঠিক করতে গেল ২৮ এপ্রিল তারা একটি কমিটি গঠন করেছে।
দুই মাস আগে আত্মপ্রকাশ করা এনসিপির প্রথম কর্মসূচি ছিল ইফতারকেন্দ্রিক। রোজার ঈদের আগে-পরে তারা চারটি সাধারণ সভা করেছে।
এসব সভার সিদ্ধান্তের আলোকে শ্রমিক, আইনজীবী, প্রবাসীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়ে সহযোগী সংগঠন খোলার পথ কিছুটা এগিয়েছে। এর বাইরে দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা কমিটি, রাজনৈতিক শাখা, নির্বাহী শাখারও সীমিত কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
চলতি মাসের মধ্যে বেশ কিছু জেলা ও উপজেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে সারাদেশে একযোগে কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে এনসিপি। বর্তমানে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি এবং বিভিন্ন অসঙ্গতিকে সামনে এনে ঢাকার অলিগলিতে নিয়মিত মশাল মিছিল করছে তারা।
দলের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দীন মোহাম্মদ বলেন, “এনসিপি চায়- অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটাকে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে লাগানো। এখন কতগুলো সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
“সাধারণ মানুষ সবেমাত্র দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে কি না, সাংবিধানিক কাউন্সিল কী, সংসদের উচ্চ কক্ষ কী- এসব বিষয় বুঝতে শুরু করেছে। আমরা সংস্কার কাজটা এগিয়ে নিতে যেতে চাই।”
নির্বাচন দিতে গিয়ে সংস্কারের দরজা এখনই বন্ধ করা হলে সংস্কার আর হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কারণ নির্বাচনে একটি দল এক-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদে গেলে বিদ্যমান কাঠামোয় তাদের যে অসীম ক্ষমতা অর্জিত হবে, সেটাতে কাটছাঁট করতে চাইবে না।
“তারা ক্ষমতার ভারসাম্য চাইবে না, ক্ষমতাকে পুরোপুরি ভোগ করতে চাইবে। সেটা আমরা ১৯৯১ সালে দেখেছি, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগকেও দেখেছি। সেই প্রেক্ষাপটে আমরা নির্বাচন বিমুখও না, আবার নির্বাচন কখন হবে- সেটা নিয়ে অনীহাও নেই। আমরা টাইম বেইজড অ্যাপ্রোচের পরিবর্তে টাস্ক বেইজড অ্যাপ্রোচে বিশ্বাসী।”
এনসিপি নেতা আলাউদ্দীন বলেন, “অনেকে বলছে যে- ইউনূসকে পাঁচ বছর চাই বা দুই বছর চাই। আমরা এই বক্তব্যের সাথেও নেই। আমরা চাই প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন চাচ্ছে, তারা আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল। বেশিরভাগ কর্মকাণ্ডই নির্বাচনকেন্দ্রিক। গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের যে ঐতিহাসিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেই সম্ভাবনা হচ্ছে এনসিপির রাজনৈতিক ভিত্তি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর ওই ঘটনা আওয়ামী লীগের রাজনীতির ভিত্তি হিসাবে দাঁড়িয়েছে।
“আওয়ামী লীগ সেই ভিত্তিকে পরবর্তীতে ব্যবহার-অপব্যবহার দুটোই করেছে। চব্বিশের পর এনসিপির গঠন ও রাষ্ট্র সংস্কারের সম্ভাবনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এনসিপি স্বাভাবিকভাবেই যে ঐতিহাসিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেখানে আগের দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক চক্র না ভেঙে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষপাতী না।”
সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে বারবার তাগিদ দিচ্ছে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মোর্চা। বিএনপির শীর্ষ নেতারা বরাবরই বলে আসছেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেটিকে এগিয়ে নেবে নির্বাচিত সরকার।
বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দীন বলেন, “অভ্যুত্থানের পক্ষের কিছু কিছু শক্তি অধিকাংশ সংস্কারের ক্ষেত্রে একমত। জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ সবাই অধিকাংশ জায়গায় একমত। কিন্তু একটা দল চাচ্ছে রুল অব গেইম আগেরটাই থাকবে।
“আমরা বলেছি যে, না- আগেরটা হবে না। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আগের রুল অব গেইম ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ১৯৯১ সালের অভ্যুত্থানের পরও আগের রুল অব গেইম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।”
চলমান রাষ্ট্রসংস্কার কর্মসূচিতে রাজনৈতিক ঐক্য গড়তে গত ৩০ এপ্রিল গণসংহতি আন্দোলন ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। দলটি এখনই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে আগ্রহী না হলেও ছাত্র সংসদ আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাইছে।
আলাউদ্দীন বলেন, “আমরা নির্বাচন চাই; সবার আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাই। কারণ ছাত্ররা এই গণঅভ্যুত্থানে সামনের সারিতে ছিল। তাদের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা এখন খুব প্রয়োজন।
“গণঅভ্যুত্থানের পর একজন আমলা কলমের এক খোঁচায় তৃণমূলের সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়েছে। এর মাধ্যমে এই সরকারকে দুর্বল করা হয়েছে- যাতে করে এই সরকার ঠিক মতো ফাংশন করতে না পারে। সরকারকে কার্যকর করার জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা বেশি জরুরি। তৃতীয়ত, আমরা চাই গণপরিষদ নির্বাচন। সেটা জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একসাথে হতে পারে, কিংবা পৃথক হতে পারে।”
বিএনপির সঙ্গে মতের বিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বিরোধ হচ্ছে দলীয় স্বার্থ বনাম জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে। তারা রাষ্ট্রের সংস্কারের চেয়ে দলকে দ্রুত ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
“চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দল হিসাবে এনসিপির ইতিহাস শুরু হয়েছে; কিন্তু বিএনপির লম্বা ইতিহাস রয়েছে। অতীতে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের হারানোর কিছু নেই; তাই আমরা সামনের দিকে তাকাচ্ছি। কিন্তু বিএনপির হারানোর অনেক কিছুই আছে, তাই তাদের পেছনের দিকে তাকাতে হয়।”
তবে এনসিপি ‘গোলমাল’ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘পিছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে’ বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি।
গত ১২ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, “যারা আয়না ঘরে দীর্ঘদিন থেকে, জেলে থেকে এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করেছে, এই নতুন দল আবার যেন এমন একটি গোলমাল শুরু করে নির্বাচনকে বিলম্বিত করার একটা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এই কথাগুলো জনগণ বলা শুরু করেছে।”
এনসিপি নতুন দল হওয়ায় জাতীয় নির্বাচনের চাইতে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার দিকে মনোযোগ বেশি বলে জানিয়েছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা সময় নিচ্ছি। কারা আমাদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কে আবদ্ধ হতে চান, আমরা সেই মানুষগুলোকে চিনতে চাচ্ছি। কাজটি অতটা সহজ নয়।
“আমাদের কাছে জনপ্রত্যাশার চাপ অনেক বেশি; সেই তুলনায় আমাদের অভিজ্ঞতা কিছুটা কম। সব বাস্তবতা মিলিয়ে এখন আমাদের জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে সংগঠন শক্তিশালীকরণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এখনই এনসিপির ক্ষমতায় যাওয়ার ভাবনা ‘বাস্তবসম্মত নয়’ বলে মনে করেন দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব আকরাম হোসেন।
তার ভাষ্যে, “এনসিপি নতুন রাজনৈতিক দল হওয়ার কারণে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া বাস্তবসম্মত নয়। সুতরাং নির্বাচন নিয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়ার কোনো কারণ নেই। নির্বাচন হলে সেখানে আমরা অংশ নেব কি নেব না, সেটা সময়ের ব্যাপার।
“কিন্তু যেই বিষয়টি আমাদের জন্য এখন গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে- রাষ্ট্র কাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে যেসব অপশক্তির বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছিলাম, সেগুলো দূর করা। সেজন্য নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারমূলক উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।”
দ্রুত ভোটের দাবিতে অনেক দল সরব হলেও রাজনৈতিক সরকার এলে তারা রাষ্ট্র সংস্কারে খুব বেশি ভূমিকা রাখবে না বলেই মনে করেন এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক সাইফুল্লাহ হায়দার।
তার কথায়, “রাষ্ট্রের কিছু সংস্কারমূলক কাজ করতে হলে সেটা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েই সম্ভব। কারণ এই সরকারের পেছনে সব রাজনৈতিক দলের অনুসমর্থন রয়েছে।
“পরবর্তীতে কোনো রাজনৈতিক সরকার আসলে তারা তাদের দলীয় এজেন্ডাকে বেশি গুরুত্ব দেবে; সেটা সব দল ও মতের পক্ষে নাও যেতে পারে।”
গঠনতন্ত্র প্রণয়নে এনসিপির কমিটি
সংস্কার প্রশ্নে ঐক্য গড়তে গণসংহতি, ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে এনসিপির বৈঠক
নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে 'পলিটিক্যাল কাউন্সিল' করল এনসিপি