জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজার রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপিল আবেদন শুনানির জন্য গ্রহণ করে নিম্ন আদালতের দেওয়া অর্থদণ্ড আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেছে হাই কোর্ট।
Published : 22 Feb 2018, 11:18 AM
তবে পাঁচ বছরের দণ্ড নিয়ে কারাগারে থাকা খালেদা জিয়া এ মামলায় জামিন পাবেন কি না- তা জানতে রোববার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আপিলের গ্রহণযোগ্যতার শুনানি করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেয়।
আদালত বলেছে, আপিল শুনানির জন্য আদেশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে বিচারিক আদালত থেকে মামলার নথি হাই কোর্টে পাঠাতে হবে।
এদিন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হলেও দুদকের সময়ের আবেদনে রোববার বেলা ২টায় শুনানির নতুন সময় ঠিক করে দিয়েছে আদালত।
ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান গত ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন।
খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ অপর পাঁচ আসামির প্রত্যেককে ১০ বছরের জেল এবং আসামিদের প্রত্যেককে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার করে জরিমানা করা হয় রায়ে।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, সরকারি এতিম তহবিলের টাকা এতিমদের কল্যাণে ব্যয় না করে পরস্পর যোগসাজশে আত্মসাৎ করে খালেদা জিয়াসহ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আসামিরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধ করেছেন।
১১৬৮ পৃষ্ঠার ওই রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর গত ২০ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টে আপিল করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবীরা।
আদালত খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের মঙ্গলবারই রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদককে আপিল ও জামিন আবেদনের কপি সরবরাহ করতে বললেও আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল অনুলিপি হস্তান্তর করেন বৃহস্পতিবার সকালে।
মূল রায়সহ ১২২৩ পৃষ্ঠার আপিল আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে খালেদা জিয়ার খালাস চাওয়া হয়। আর ৮৮০ পৃষ্ঠার জামিন আবেদনের মধ্যে ৪৮ পৃষ্ঠাজুড়ে ৩২টি যুক্তিতে খালেদা জিয়ার মুক্তি চাওয়া হয়।
শুনানির সময় হট্টগোল
আপিলের গ্রহণযোগ্যতার শুনানির জন্য দুই পক্ষের আইনজীবীরাই সকালে আদালতে উপস্থিত হন।
খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন মওদুদ আহমদ, জমির উদ্দিন সরকার, খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নুল আবেদীন, আব্দুর রেজাক খান, মাহবুব উদ্দিন খোকন, সানা উল্লা মিয়া, আমিনুল হক, রাগীব রউফ চৌধুরী, সগীর হোসেন লিয়ন ও ব্যারিস্টার এ কে এম এহসানুর রহমান। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজন বিএনপি নেতাকেও আদালতে দেখা যায়।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা ও মোমতাজ উদ্দিন ফকির এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরহাদ আহম্মেদ। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খূরশীদ আলম খান ও মোশারফ হোসেন কাজল।
সকাল সাড়ে ১০টায় আদালত বসলে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাহাবুব উদ্দিন খোকন আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর রাষ্ট্রপক্ষে ফরহাদ আহম্মেদ বলেন, তারা খুব অল্প সময় আগে আসামিপক্ষের কাছ থেকে কপি পেয়েছেন। শুনানির আগে তাদের সময় প্রয়োজন।
রাষ্ট্রপক্ষ বেলা ২টা পর্যন্ত সময় চাইলেও বিচারক শুনানির জন্য বেলা ১২টায় সময় ঠিক করে দেন।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দুই পক্ষের আইনজীবীদের আদালতে উপস্থিত দেখে জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, যেহেতু দুই পক্ষই উপস্থিত আছে, সেহেতু আগেই শুনানি শুরু হতে পারে।
কিন্তু আসামিপক্ষ এ সময় একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার কথা বলে।
এই অপেক্ষার মধ্যেই বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের ব্যাপক ভিড়ের কারণে আদালতে হট্টগোল তৈরি হয়। খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদেরও ওই ভিড় পেরিয়ে এজলাসে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল দাঁড়িয়ে আদালতকে বলেন, এভাবে শুনানি করা সম্ভব না। তিনি দুই পক্ষেই আইনজীবীর সংখ্যা সীমিত করে দিতে অনুরোধ করেন।
বিচারক এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনিও সহমত প্রকাশ করেন।
এসময় আদালত কক্ষে হৈ চৈ-হট্টগোল আরও বেড়ে গেলে উভয় পক্ষকে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে পৌনে ১২টায় আদালত ১০ মিনিট বিরতিতে যায়।
আদালত নেমে গেলে হট্টগোল আরও বেড়ে যায়। এসময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জমির উদ্দিন সরকার ও রেজাক খান আদালত কক্ষের দরজাতেই আটকা পড়েন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে আসন থেকে উঠে পরিস্থিতি সামাল দিতে দেখা যায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশারফ হোসেনও তার সঙ্গে ছিলেন।
দশ মিনিট পর ঠিক ১২টায় আদালত বসলে জয়নুল আবেদীন দাঁড়িয়ে বলেন, তাদের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা উপস্থিত রয়েছেন। আপিলটি শুনানি করবেন এ জে মোহাম্মদ আলী।
সংশোধিত ফৌজদারি আইনের ১০(১) ধারায় আপিলটি করা হয়েছে জানিয়ে এ জে মোহাম্মদ আলী তা শুনানির জন্য গ্রহণ করার আবেদন করেন।
আপিল গ্রহণ করা হলে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন দেওয়া হবে বলে জানান এই আইনজীবী।
নথি দেখে বিচারক বলেন, “ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সাজা বা দণ্ড স্থগিতের বিধান আছে। কনভিকশন কি স্থগিত করা যায়? ক্রিমিনাল অ্যাক্ট ল অ্যামেন্ডম্যান্ড অ্যাক্টে কনভিকশন স্থগিতের বিধান নাই। আপনারা তো সাজা স্থগিতের পাশাপশি কনভিকশনও স্থগিত চেয়েছেন।”
মোহাম্মদ আলী বলেন, “সাধারণত এটা একটা প্রথা। সেজন্য এটা আমরা চেয়েছি।”
এরপর আদালত আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে আদেশ দেয়।
জামিন শুনানি
আদালত আপিল আবেদন শুনানির জন্য গ্রহণ করার পর খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন শুনানির জন্য ওঠে।
এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, “পনের দিন ধরে তিনি (খালেদা জিয়া) কাস্টডিতে আছেন। যেহেতু তাকে লঘু সাজা দেওয়া হয়েছে, সেজন্য আমরা তার জামিন চাইছি। বয়স, সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় তিনি জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন।”
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ সময় দাঁড়িয়ে বলেন, “আপিল ইতোমধ্যে আদালত গ্রহণ করেছে। আজ সকালে আমরা জামিন আবেদন পেয়েছি। রেকর্ড আসার পরই বিষয়টি (জামিন আবেদন) নিয়ে শুনানি করা হোক।”
এ সময় বিচারক বলে, “আপিলকারীর সাজা তো কম। আদালতের রীতি আছে পাঁচ-সাত বছর বা তার কম সাজা কম হলে জামিন দেওয়ার। তারা তো অন মেরিট বেইল চাচ্ছে না।”
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ফৌজদারি আইনে নারী হিসেবে আদালত জামিনের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। কিন্তু দুদক আইনে সে সুযোগ নেই। জামিনের আবেদন অনেক বড়, যুক্তিও দেওয়া হয়েছে অনেক। কার্যতালিকায় এনেই শুনানি করা হোক।
এ সময় এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, সাধারণত কম সাজা হলে আপিল করলে জামিন দিয়ে দেওয়া হয়।
বিচারক এ সময় বলেন, “আপিল বিভাগের অনেক আদেশ আছে, কম সাজা হলে জামিন দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেগুলো এসব স্পেশাল আইন প্রণয়নের আগে। যেহেতু দুদক আইনে আছে তাদের যুক্তিসঙ্গত সময় দেওয়ার, তাই আমরা রোববার দুপুর ২টায় শুনানির জন্য রাখলাম।”
জামিন আবেদনের যুক্তি
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা জানান, ৩২টি গ্রাউন্ডে জামিন আবেদনটি করা হয়েছে। ৪৮ পৃষ্ঠার গ্রাউন্ড ও মামলার আনুষঙ্গিক নথিপত্রসহ জামিন আবেদনটি মোট ৮৮০ পৃষ্ঠার।
জামিন আবেদনের যুক্তিতে বলা হয়েছে, আবেদনকারীর বয়স ৭৩ বছর। তিনি শারীকিভাবে বিভিন্ন জাটিলতায় ভুগছেন। তিনি ৩০ বছর ধরে গেঁটেবাত, ২০ বছর ধরে ডায়াবেটিস, ১০ বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে আয়রন ঘাটতিতে ভুগছেন।
১৯৯৭ সালে খালেদা জিয়ার বাঁ হাঁটু এবং ২০০২ সালে ডান হাঁটু প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ কারণে তার গিঁটে ব্যথা হয়, যা প্রচণ্ড যন্ত্রণাদায়ক। এ কারণে তাকে হাঁটাহাঁটি না করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। শারীরিক এসব জাটিলতার কারণ বিবেচনায় নিয়ে জামিন মঞ্জুর করার আর্জি জানানো হয়েছে আবেদনে।
আরেক যুক্তিতে বলা হয়েছে, উপমহাদেশ ও দেশের উচ্চ আদালতের দীর্ঘ ঐতিহ্য অনুযায়ী, আসামি নারী হলে তার অনুকূলে জামিন বিবেচনা করা হয়।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূলের জন্য ২০০৭-০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট মামলাটি করেছিল দাবি করে জামিনের আরেক যুক্তিতে বলা হয়, মামলার প্রথম অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা জামিন আবেদনকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি।
“তাছাড়া জামিন আবেদনকারী বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির চেয়ারপারসন। বিচারিক আদালত এ বিষয়টি উপেক্ষা করেছে। যে মামলায় তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তাকে হয়রানী করার জন্য। ফলে তার জামিন আবেদন গ্রহণের সবিনয় আর্জি জানাচ্ছি।”
শুনানির পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী মওদুদ আহমদ বলেন, আগামী রোববার খালেদা জিয়া জামিন পাবেন বলে তিনি আশা করছেন।
“আদালত যা ভাল মনে করেছে সেটাই করেছে। আমরাও সেটা মেনে নিয়েছি। আগামী রোববার খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হবে। আমরা আশা করছি ওইদিনই আদালত তাকে জামিন দেবে।”
আর খুরশীদ আলম খান বলেন, “যেহেতু দুর্নীতি দমন কমিশন এই মামলার বাদী, এই আইনেই বলা আছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার চাইতে গেলে কমিশনকে তা শুনতে হবে। যেহেতু জামিন আবেদনটি বিশাল। সেখানে ৩২টি গ্রাউন্ড আছে, মমলার এফআইরসহ আবেদনটি মোট ৮৮০ পৃষ্ঠার, তাই যুক্তিসঙ্গত সময় চাইলাম। আদালত আমাদের যুক্তি শুনে আগামী রোববার বেলা ২টায় শুনানির জন্য রেখেছে।”