সাজার রায়ের বিরুদ্ধে খালেদার আপিল

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি হাতে পাওয়ার পরদিন হাই কোর্টে আপিল করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2018, 09:33 AM
Updated : 20 Feb 2018, 02:35 PM

এই আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করা হবে কি না- বৃহস্পতিবার সে সিদ্ধান্ত দেবে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাই কোর্ট বেঞ্চ।

নথিপত্রসহ ১২২৩ পৃষ্ঠার ওই আপিল আবেদনে ফাইলিং লইয়ার হিসেবে আবদুর রেজাক খানের নাম রয়েছে। সাজার রায়ের বিরুদ্ধে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে খালেদা জিয়ার খালাস চাওয়া হয়েছে সেখানে।

আপিল আবেদন মঙ্গলবার হাই কোর্টে উপস্থাপন করার পর খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “বৃহস্পতিবার আপিল গ্রহণের ওপর শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। আপিল গ্রহণ করা হলে ওই দিনই আমরা জামিন আবেদন করব। আশা করি উনি (খালেদা জিয়া) জামিন পাবেন।”

ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান গত ৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। সেই সঙ্গে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ অপর পাঁচ আসামির প্রত্যেককে ১০ বছরের জেল ও জরিমানা করা হয় রায়ে।

রায়ের দিন বিচারক বলেছিলেন, তার পুরো রায় ৬৩২ পৃষ্ঠার। সেদিন তিনি এর সারসংক্ষেপ আদালতে পড়ে শোনান। সোমবার বিকাল ৪টার দিকে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলে দেখা যায়, তা ১১৬৮ পৃষ্ঠার।

রায়ে বলা হয়, সরকারি এতিম তহবিলের টাকা এতিমদের কল্যাণে ব্যয় না করে পরস্পর যোগসাজশে আত্মসাৎ করে খালেদা জিয়াসহ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আসামিরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধ করেছেন।

খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের হাতে সোমবারই রায়ের সত্যায়িত কপি তুলে দেন আদালতের পেশকার মোকাররম হোসেন। দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলকেও রায়ের কপি দেওয়া হয়।

বিএনপির নেতারা অভিযোগ করে আসছিলেন, খালেদা জিয়াকে বেশি দিন বন্দি রাখতেই রায়ের অনুলিপি দিতে দেরি করা হচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করে বলছিলেন, রায়ের অনুলিপি পেতে বিএনপি উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিচারকের কাছে আবেদন জানাতে দেরি করেছে।

রায়ের ১১ দিন পর সত্যায়িত অনুলিপি হাতে পেয়ে সোমবার রাতে খালেদার আইনজীবীরা সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলীর ধানমণ্ডির চেম্বারে জরুরি বৈঠকে বসেন। এরপর মঙ্গলবার সকাল থেকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্মেলন কক্ষে দুই দফা বৈঠক করেন তারা।

ওই বৈঠক চলার মধ্যেই খালেদার আইনজীবী দলের সদস্য ব্যারিস্টার কায়সার কামাল দুপুরে হাই কোর্টের সংশ্লিট শাখায় আপিল আবেদন জমা দেন। পরে তা বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের বেঞ্চে শুনানির জন্য তোলা হয়।

বিএনপি চেয়ারপারসনের পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি জয়নুল আবেদীন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জমির উদ্দিন সরকার, খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলীসহ বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরহাদ আহমেদ ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইউসুফ মাহমুদ মোর্শেদ ও সাবিনা পারভিন। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।

শুনানির শুরুতে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা আদালতকে জানান।

এ সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরহাদ আহমেদ বলেন, “জামিনের দরখাস্ত থাকলে আমাদের (রাষ্ট্রপক্ষকে) যেন কপি দেওয়া হয়।”

তখন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, “তারা মেনশন স্লিপ দিয়েছেন।”

এরপর তিনি বিএনপিনেত্রীর আইনজীবীদের বলেন, জামিনের আবেদন থাকলে তারা যেন তা রাষ্ট্রপক্ষকে আগে দিয়ে দেন।

খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন তখন বলেন, বুধবার যেহেতু ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ছুটি, সেহেতু বৃহস্পতিবার সকালে তারা আবেদনের কপি দেবেন।

এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপিল আবেদনের কপি চেয়ে রোববার শুনানি করার মত দেন।

এ সময় আদালত খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের মঙ্গলবারই রাষ্ট্রপক্ষকে কপি সরবরাহ করতে বলে। 

বিচারক বলেন, দুদকের মামলা সাধারণত বুধ ও বৃহস্পতিবার শুনানির জন্য আসে। বুধবার যেহেতু আদালত বন্ধ, এ আপিল বৃহস্পতিবার তালিকায় আসবে।

আপিলের যুক্তি

# নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপিলের যুক্তিতে বলা হয়েছে, জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের নামে অর্থ বরাদ্দ বা এর কোনো লেনদেনের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততা নেই। তাছাড়া ট্রাস্টের অর্থ ‘আত্মসাত হয়নি’, বরং ব্যাংকে তা বেড়ে তিনগুণ হয়েছে।

# মামলার তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনে আরেক যুক্তিতে বলা হয়েছে, এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা মামলা থেকে খালেদা জিয়াকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই তাকে মামলার অভিযোগপত্রে সম্পৃক্ত করেছেন। এটা তিনি করেছেন ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ হয়ে। বিভিন্ন সময় আইন ভঙ্গ করে দুদকের ওই  কর্মকর্তাকে চাকরি সংক্রান্ত ‘সুযোগ-সুবিধা’ দেওয়া হয়েছে।

# আরেক যুক্তিতে বলা হয়েছে,মামলার শুনানিতে দুদক ট্রাস্ট ফান্ডের মূল নথি দেখাতে পারেনি। ২০০৮ সালের যে সম্পূরক নথি দেখানো হয়েছে তা জাল। এ মামলার জন্যই এসব নথি ‘সৃজন করা হয়েছে’।

# আইনের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আপিলের আরেক যুক্তিতে বলা হয়েছে, ট্রাস্টের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড বা লেনদেনে যদি অনিয়ম থাকত তাহলে তা প্রতিকারের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। কিন্তু সে আইনে মামলা না করে করা হয়েছে দুর্নীতি দমন আইনে। কোনোভাবেই এ বিষয়টি দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে না।

# ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্যকে রায়ে ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। সেখানে তিনি যা বলেছিলেন তা হল- “অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে নির্বিচারে গুলি করে প্রতিবাদী মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে। ছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করা হচ্ছে। এগুলো কি ক্ষমতার অপব্যবহার নয়?  ক্ষমতার অপব্যবহার আমি করেছি? শেয়ার বাজার লুট করে লক্ষ কোটি টাকা তছরুফ হয়ে গেল, নিঃস্ব হল নিম্ন আয়ের মানুষ, ব্যাংকগুলো লুটপাট করে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে।”

যুক্তিতে বলা হয়, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করেছি’ বাক্যাংশের পরে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছিল। কিন্ত তা সরাসরি খালেদা জিয়ার বক্তব্য হিসেবে গ্রহণ করে ‘বিচারিক মননের প্রয়োগ ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে’ আদালত।

‘তিনি নির্দোষ’

আপিল আবেদন করার পর খালেদার আইনজীবী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, “বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, এটা সাক্ষী-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভবপর হয় নাই বলে আমরা মনে করি। তিনি নির্দোষ এবং তিনি আপিলে খালাস পাবেন।” 

সাবেক এই আইনমন্ত্রীর ভাষায়, ১১৬৮ পৃষ্ঠার ওই রায়ের ‘পাঁচ ভাগের চার ভাগই একেবারে অবান্তর’।ওই রায় পড়ে তারা ‘অবাক’ হয়েছেন।

একটা উদাহরণ দিই আপনাদের…. বেগম জিয়া নাকি স্বীকার করে নিয়েছেন যে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এটা মিথ্যা, সম্পূর্ণ অসত্য। রায়ের মধ্যে একটি কথা লিখে সারা দেশের মানুষের মধ্যে প্রচার করা হল, এটাও ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। কোনো আসামি কি বলে যে,‘ আমি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছি’?”

দুদক ‘প্রস্তুত’

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা এখনো তাদের দরখাস্তের (আপিল) কোনো কপি পাইনি। আমরা আপিলে মোকাবেলা করব। সর্বোতভাবে আমরা প্রস্তুত।”

রায় নিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “এটা উনাদের ব্যক্তিগত অভিমত। উনারা যখন আপিল দায়ের করেছেন, তার সঙ্গে সঙ্গে এ আপিলের জুরিসডিকশন হাই কোর্টের। হাই কোর্টে এটা থাকা অবস্থায় এ ধরনের মন্তব্য করা ঠিক না।”

দুদক খালেদা জিয়ার সাজা বাড়ানোর আবেদন জানিয়ে আপিল করবে কিনা জানতে চাইলে খুরশীদ আলম বলেন, “এ বিষয়ে কমিশন কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। কমিশন এখন পর্যন্ত সেটা জানায়নি।”

পুরনো খবর