“চব্বিশকে একাত্তরের কাতারে আনা সমীচীন নয়”, বলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ।
Published : 23 Mar 2025, 06:46 PM
সংবিধানে ব্যাপক সংশোধনী আনা যেতে পারে, কিন্তু দেশে ‘গণপরিষদের কোনো প্রয়োজন নেই’ বলে মনে করে বিএনপি।
পাঁচ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে নিজেদের মতামত জানাতে গিয়ে রোববার এ অবস্থান তুলে ধরে দলটি।
এদিন দুপুরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কো-চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে লিখিত মতামত জমা দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “যেগুলোতে একমত হওয়া উচিত, সেগুলোতে একমত হয়েছি। আর যেগুলোয় আমাদের ভিন্নমত দেওয়া প্রয়োজন, সেগুলোয় আমরা মতামত সহকারে দিয়েছি। মোটামুটি আমরা পুরোপুরি সহযোগিতার মধ্যে আছি।”
মতামত জমা দেওয়ার সময় বিএনপি নেতাদের মধ্যে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান ছিলেন।
ঐকমত্য কমিশনের কো-চেয়ারম্যানের সঙ্গে ছিলেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বদিউল আলম মজুমদার, দুদক সংস্কারে গঠন করা কমিশনের ইফতেখারুজ্জামান ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মুনীর হায়দার।
সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে মতামত চেয়ে গত ৬ মার্চ বিএনপিসহ ৩৭ টি রাজনৈতিক দলকে ‘চিঠি ও স্প্রেডশিট’ পাঠায় ঐকমত্য কমিশন।
১৩ মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানাতে বলা হয়। রোববার পর্যন্ত ১৬টি রাজনৈতিক দল তাদের মতামত জমা দেয়।
রোববার বিএনপি ছাড়াও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) তাদের মতামত জমা দেয়।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর কয়েকটি সংস্কার কমিশনের পাশাপাশি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও গঠন করা হয়। মুহাম্মদ ইউনূস এই কমিশনের প্রধান।
‘গণপরিষদ ও গণভোট নির্বাচন নয়’
সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে বা আলাদা করে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে নতুন আত্মপ্রকাশ করা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
এ প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, “গণপরিষদ নিয়ে অনেকে বক্তৃতা দিয়েছে। নতুন রাষ্ট্র হয়েছে, সেখানে সংবিধান রচনা করা দরকার, রাষ্ট্রের সংবিধান নাই, সেজন্য সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে নিয়ে প্রতিনিধিত্ব আকারে গণপরিষদ গঠন করা হয়।
“সেটা নির্বাচনের মাধ্যমে হতে পারে, সিলেকশনের মাধ্যমেও হতে পারে। সেই গণপরিষদ একটা সংবিধান প্রণয়ন করে এবং সেটা গৃহীত হওয়ার পর সংবিধানের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচন হয়।”
সালাহউদ্দিন প্রশ্ন করেন, “এখানে আমাদের রাষ্ট্র কি নতুন হয়েছে? আমাদের রাষ্ট্র পুরাতন রাষ্ট্র; ৫৩-৫৪ বছর। আমাদের একটা সংবিধান আছে। সেই সংবিধানের হয়ত গণতান্ত্রিক চরিত্র বিনষ্ট হয়েছে, তার সঙ্গে আমরা একমত নই। এজন্য রাষ্ট্র কাঠামো ও গণতান্ত্রিক কাঠামো নির্মাণ করা দরকার নতুনভাবে। সে জন্য আমরা সংবিধানের ব্যাপক সংশোধনী এনেছি।
“যারা গণপরিষদ দাবি করছে, তারাও ৬৯টা প্রস্তাব দিয়েছে সংশোধনের জন্য। আমরা একটু কম দিয়েছি। এগুলো আলোচনা করে আমরা একটা বৃহত্তর ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের একটা ব্যাপক সংশোধিত সংবিধান পেতে পারি। সেই সংবিধান তারা নতুন সংবিধান বলতে পারে, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এখানে গণপরিষদের কোনো প্রয়োজন নেই।”
বিএনপির এই নেতা বলেন, “সংশোধিত সংবিধানকে তারা নতুন নামে ‘রিপাবলিক’ বলতে পারে; আমাদের তো আপত্তি নাই। কিন্তু তাদের সেই আইডিয়াটা পুরো জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়াটা কতটা যুক্তিসংগত, সেটার দাবি রাখে।”
গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবও এসেছে একাধিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে।
গণভোট প্রসঙ্গে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘‘ গণভোটের বিধান তো আছে সংবিধানের ১৪২ আর্টিকেলে। সেখানে বলা আছে, আর্টিকেল ৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২ ইটসেলফ। এগুলো যখন সংশোধিত হবে, তখন গণভোটের প্রয়োজন হবে।
“যদি নতুন সংবিধানে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আরও কোনো প্রভিশন যদি এই গণভোটের অধীনে নিয়ে আসা হয় সেটা তখন দেখা যাবে। সেই সমস্তক্ষেত্রে গণভোটের কথা আসতে পারে।’’
তিনি বলেন, “আমরা মনে করি, এখন সংসদ নির্বাচন করা উচিত; গণভোট নির্বাচন নয়। আমরা মনে করি আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিকতভাবে একটি রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে সমস্ত আলাপ-আলোচনা সংসদে করা যাবে।”
‘একাত্তর আর ’২৪এর গণঅভ্যুত্থান এক হতে পারে না’
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘উনারা একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে একই কাতারে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে নিয়ে এসেছেন, যেটা আমরা মনে করি সমীচীন নয়। আগের প্রিয়াম্বলই (প্রস্তাব) থাকা উচিত।
“২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের অংশটি সংবিধানের অন্য জায়গায় কীভাবে চতুর্থ তফসিল যুক্ত করা যায়, সেটা পরে আলোচনা করা যায়।”
বিএনপির এই নেতা বলেন, “এখানে সরকারের কোনো লেজিটেমেসির অভাব আছে বলে আমরা মনে করি না। এই সরকার সাংবিধানিকভাবেই গঠিত হয়েছে। আর্টিকেল ১০৬ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে এডভাইজারি রোল হিসেবে যেটা আছে, সেটার ভিত্তিতে এ সরকার শপথ নিয়েছে।”
দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত কমিশনের সুপারিশ প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “স্প্রেডশিটে ২০টির মত সুপারিশ ছিল। ২০টার মধ্যে আমরা ১১টাতে সরাসরি একমত।
“একটি প্রস্তাবে আমরা ভিন্নমত পোষণ করেছি। কারণ ওখানে একটা আইন সংশোধনের বিষয় রয়েছে; আয়কর সংক্রান্ত।’’
প্রশাসন সংস্কারের সুপারিশ সম্পর্কে তিনি বলেন, “এখানে ২৬টা বিষয়ে প্রস্তাব আছে। সেখানে আমরা এর প্রায় অর্ধেক বিষয় একমত। আর বাকি অর্ধেক বিষয়ে আমাদের মতামত-মন্তব্য আছে।”
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রায় সব প্রস্তাবে বিএনপি একমত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
‘নিম্ন আদালতের জন্য আলাদা কাউন্সিল’
সালাহউদ্দিন বলেন, “সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আপনারা জানেন, সেটা অলরেডি পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় হাই কোর্টের রায়ে বহাল হয়েছে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের আদলে লোয়ার জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব করেছি, যেন একটা জবাবদিহি থাকে নিম্ন আদালতের জন্য।
“বিচার বিভাগের যেসব প্রস্তাব তারা দিয়েছে, ৪৫টি বিষয়ে একটু মন্তব্য সহকারে মতামত দিয়েছি।”
‘ইসির স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না’
সালাহউদ্দিন বলেন, “একটি বিষয়ে আমাদের মতামত পজিটিভলি দিয়েছি। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশন, এই ইসির ক্ষমতাকে খর্ব করার জন্য সংস্কার কমিশন কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। যেগুলো আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ।
“যেমন এনআইডি। এটা যদি আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়া হয়, তাহলে ইসিকে বার বার এনআইডি বিষয়ে সহযোগিতার জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে হবে। তার চাইতে আমরা মনে করি এনআইডির কার্যক্রম পুরোটাই নির্বাচন কমিশনের হাতে রাখা উচিত।”
সীমানা নির্ধারণও নির্বাচন কমিশনের কাছে রাখা উচিত বলে বিএনপি মনে করে।
তিনি বলেন, ‘‘সীমানা নির্ধারণ ইসির আইন আছে এবং সাংবিধানিক এখতিয়ার। নির্বাচন কমিশনের সেই আইনে সামান্য একটা প্রিন্টিং মিসটেক ছিল, সেটা আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে দিয়েছিলাম। আইন মন্ত্রণালয়ে সেটা গিয়েছে, কিন্তু এখনো সংশোধন হয়নি।
সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলে, “নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতার জন্য সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে বলে কমিশনের একটা সুপারিশ আছে।
“নির্বাচন কমিশনের মত স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা রাখাটা উচিত বলে মনে করছি না আমরা।”
রাষ্ট্রের নাম ‘রিপাবলিক’ করার সুপারিশে ‘না’
সালাহউদ্দিন বলেন, “সুপারিশে উনারা শুরু করেছেন রিপাবলিক দিয়ে, রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন দিয়ে, যেটাকে প্রজাতন্ত্র না বলে জনগণতন্ত্র বা নাগরিকতন্ত্র বা পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ এর ক্ষেত্রে বাংলায় বলছেন যে জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। বাংলায় উনারা নাগরিক তন্ত্র এবং জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ লিখতে চান।
“সেটা কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। দীর্ঘদিনের প্র্যাকটিসের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নাম মেনে নিয়েছে। এখন বিষয়টা নিয়ে এলে কতটুকু কী অর্জন হবে, সেটা প্রশ্নের দাবি রাখে। আমরা এ বিষয়ে একমত নই।”
‘মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা’ নামে আলাদা চাপ্টার সংযুক্ত করার জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, “যেটা আসলে অনেকটা আমরা মনে করি যে, অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে অভিমতটা আসতে পারে।”
তিনি বলেন, “নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ, এখানে উনারা যেসমস্ত প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন এবং যেগুলো কমিশনের কথা বলেছেন, বিশেষ করে ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল গঠন করে কিছু অনির্বাচিত ব্যক্তিদের এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রধানদের এখানে মেম্বার করার যেসমস্ত প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে করে দেখা যাবে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আর কোনো গুরুত্ব থাকে না। রাষ্ট্র নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে এটা সংবিধানের মূল চেতনা। সেই জায়গায় এটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমরা মনে করি।”
দুই কক্ষের পার্লামেন্টের বিষয়ে উচ্চকক্ষের আসন ও মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছে বিএনপি।
সালাহউদ্দিন বলেন, “নারীদের সংসদীয় আসন সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ করার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হলেও মনোনয়ন প্রক্রিয়ার বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে।”