প্রতিহিংসা-প্রতিশোধে লিপ্ত না হওয়ার আহ্বান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের।
Published : 07 Aug 2024, 11:04 PM
দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন তারেক রহমান।
বুধবার বিকালে নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দেওয়া বক্তব্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘‘দেশকে গণতন্ত্র উত্তরণের চলমান প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে সারাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
”প্রশাসনের প্রতি আহ্বান শক্ত হাতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করুন। প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। ধর্ম-বর্ণ পরিচয়ের কারণে কেউ যেন নিরাপত্তাহীনতায় না থাকে সবার আগে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।”
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের দলগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘‘ষড়যন্ত্রকারীদের এই নৈরাজ্যের কাছে আমরা হার মানতে পারি না।”
তারেক রহমান মুসলমান, বৌদ্ধ, হিন্দু, খৃষ্টান নির্বিশেষে বিএনপির নেতাকর্মীদের বন্ধু ও পাড়া প্রতিবেশীদের রক্ষার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ভূখন্ডে বসবাসকারী প্রত্যেকটি মানুষের একটিই পরিচয় সেটি হচ্ছে, আমরা বাংলাদেশি।”
পুলিশ জনগণের শত্রু নয় মন্তব্য করে তার অভিযোগ, ‘‘একটি সভ্য এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুলিশ অপরিহার্য। অত্যাচারি হাসিনা বিনাভোটে ক্ষমতায় থাকার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
”আমি বিশ্বাস করি, বিএনপি বিশ্বাস করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো প্রত্যেকে বিশ্বাস করে পুলিশের ভেতরে একটি চক্র ছাড়া অধিকাংশ পুলিশ কর্মকর্তা এবং সদস্য চাকুরিবিধি মেনে, দেশের আইন কানুন মেনেই দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছে। হাসিনা পালানোর পরে বর্তমানে সুকৌশলে একটি চক্র পুলিশের মনোবল ভেঙে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। পুলিশকে অকার্য্কর করে দেওয়া গেলে দেশকে অস্থিতিশীল করা সহজ। ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মনে নিরাপত্তাহীন সৃষ্টি করা সহজ।”
‘বিএনপির পরিচয়ে কেউ অপকর্ম করলে ধরিয়ে দিন’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘অস্থিতিশীলকারীদের আমি হুঁশিয়ার করে বলতে চাই, পুলিশ কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর আজ থেকে এই মুহূর্ত থেকে হামলা কিংবা নৈরাজ্য বন্ধ করুন।
”এমনকি বিএনপির কেউ দলের নাম ব্যবহার করে কোনো অপকর্ম করতে চাইলে তাকে ধরে আইনের হাতে তুলে দিন। কোনো পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যথানিয়মের অভিযোগ দায়ের করুন।”
প্রতিহিংসা-প্রতিশোধে লিপ্ত না হওয়ার অনুরোধও করেন তিনি।
‘অতীত সমালোচনা আর নয়’
তারেক রহমান বলেন, ‘‘অতীত সমালোচনা কিংবা নৈরাজ্যের বদলে নৈরাজ্য কোনো সমাধান হতে পারে না। বরং বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।
‘‘শাসন-প্রশাসনকে সময়পোযোগী করে গড়ে তোলা এখন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের দাবি। জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে নিয়োগ কিংবা প্রমোশনে মেধার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকতে হবে।”
দেশকে আমদানি ও বিদেশি ঋণ নির্ভরতা থেকে বের করে আনার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশীয় উৎপাদন এবং উপাদনের প্রযুক্তির নির্ভরতা বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থান তৈরি করে বেকার সমস্যার সমাধান দ্রুতই চেষ্টা করতে হবে। গার্মেন্টস, শ্রম, ওষুধ, আউটসোসিংসহ সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে নিয়ে রপ্তানিমুখী বাজারের আওতায় আমাদেরকে যেকোনো মূল্যে বাড়াতে হবে।
”প্রযুক্তিনির্ভর ও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে দেশে-বিদেশে শ্রমবাজারে আমাদেরকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো দক্ষ ও মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও বাস্তব সম্মত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার নীতির উপরে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। সবার জন্য সুবিচার নিশ্চিত করতে আইন শাসন অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।”
‘উচ্চ কক্ষ চালুর প্রস্তাব’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘দেশে ও প্রবাসে এমন অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন যারা জ্ঞানে বিজ্ঞানে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিজ্ঞদের অনেকেই সংশ্লিষ্ট হতে চান না। সুতরাং এইসব গুনি মানুষদের রাষ্ট্র পরিচালনায় ও নীতি প্রণয়নে অন্তর্ভুক্ত করতে জাতীয় সংসদে উচ্চ কক্ষ চালু করার প্রস্তাব বিএনপি রেখেছে এরই ভেতরে।
‘‘রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় গুনগত পরিবর্তন না পারলে আমাদের এই বিপ্লবে কাঙিত ফল মিলবে না।”
‘দ্রুততম সময়ে জাতীয় নির্বাচন চাই’
গত ১৫/১৬ বছর ধরে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ করে তিনি বলেন, “ছাত্র-জনতার এ রক্তঝরা বিপ্লবের চূড়ান্ত লক্ষ্য একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। তাই বিপ্লবের লক্ষ্য বাস্তবায়নে দ্রুততম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। স্বৈরাচার হাসিনা পতনের রক্ত রঞ্জিত বিপ্লবকে সার্থক এবং সফল করে আসুন নাগরিক হিসেবে দায়িত্বশীল আচরন করি।“
তিনি বলেন, “আসুন সবাই মিলে রাষ্ট্র ও সমাজে মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করি, প্রতিষ্ঠা করার শপথ গ্রহণ করি। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি দুর্নীতিমুক্ত এবং জবাবদিহিমূলক নিরাপদ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।”
নেতাকর্মীদের প্রতি বার্তা
লন্ডনে বসবাসরত তারেক রহমান ভার্চুয়াল মাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, ‘‘আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে তারুণের জন্যে যে তারুণের নেতৃত্বে বাংলাদেশে আজ এই বিপ্লব সফল হয়েছে। আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকলে আগামী দিনে বাংলাদেশের জন্য, তারুণ্যের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যতে গড়তে পারব।
‘‘সবাই যার যার এলাকায় জনগণের সঙ্গে থাকবেন, জনগণের সঙ্গে রাখবেন। কারণ জনগণই বিএনপির সকল ক্ষমতার উৎস।”
‘বিজয়ের জন্য মোবারকবাদ’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘আপনাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে গণহত্যাকারী হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। প্রমাণ হয়েছে আবারও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ কখনও পরাজয় মানে না, মানতে পারে না এবং মানবে না।
”বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো অপশক্তি বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না, ইনশাল্লাহ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আর ২০২৪ সালের মুক্তিযুদ্ধ উভয় মুক্তিযুদ্ধেই জনগণের বার্তা একটি। কি সেটি? সেই বার্তা হলো শর্ত দিয়ে স্বাধীনতা হয় না। স্বাধীনতা প্রিয় জনগণ, স্বাধীনতা অর্জন কিংবা স্বাধীনতা রক্ষায় কোনো শর্ত মানে না, মানতে রাজি না।”
তিনি বলেন, ‘‘আমি যত মানুষের সাথে কথা বলেছি, প্রতিটি মানুষ অনুভূতি প্রকাশের প্রথম উচ্চারণ ছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে বলছি। দেশ এবং জনগণকে স্বাধীন করতে গিয়ে চোখে মুখে বুকে গুলি আলিঙ্গন করা আবু সাঈদ কিংবা মুগ্ধের মতন হাজারো ছাত্র-ছাত্রী-তরুণ-তরুনীকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। আহত হয়েছেন অসংখ্য, অগুণিত মানুষ। এর ভেতরে ছাত্র-ছাত্রী রয়েছেন, এর ভেতরে রয়েছেন সাধারণ মানুষ, গৃহিণী, এর ভেতরে রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীবৃন্দ।”
গণতন্ত্র বিজয়ের ইতিহাসে এই মানুষগুলো স্মরণীয় হয়ে থাকবেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, দেশের ছাত্র সমাজ বিজয়ের নতুন অমর একটি ইতিহাস রচনা করেছেন। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ৫ অগাস্ট বাংলাদেশ দেখেছে আরেকটি বিজয়।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পোশাক শিল্পে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এরা আন্দোলনের শক্তি নয়, গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি।
বিএনপি মহাসচিবের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর পরিচালনায় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সেলিমা রহমান বক্তব্য দেন।
নয়া পল্টনে বিএনপির উদ্যোগে এ সমাবেশে রাজধানীর বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড থেকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী আসেন। নটরডেম কলেজ থেকে শুরু করে কাকরাইল বিজয় নগর সড়কের মানুষের ঢল জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
সমাবেশে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যসহ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
>>>>>>>>>>
এসএম/আরএআর
>>>>>>>>>>