পুলিশের কাজে বিরক্ত এক যাত্রী বলেন, “তারা এইটা পারেন কিনা আপনার মাধ্যমে প্রশ্ন রাখলাম।”
Published : 28 Oct 2023, 12:35 AM
একদিকে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মানতে সরকারকে ‘বাধ্য’ করার হুমকি দিয়ে বিএনপির মহাসমাবেশ, অন্যদিকে তাদেরকে ঠেকিয়ে ‘মাঠ দখলে’ রাখার প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের, আবার অনুমতি না থাকলেও জমায়েতের ঘোষণা জামায়াতে ইসলামীর।
শনিবার রাজধানীতে কী হয়, তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কিছুটা অবসান হয় পুলিশের ঘোষণায়। আগের রাতে দুই দলকেই তাদের পছন্দের এলাকায় সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়ার পর শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি।
সকালের অপেক্ষায় না থেকে রাত থেকেই আসতে থাকে মিছিল। নেতারা বলছেন, সকালে বইবে ‘জনস্রোত’।
একই সঙ্গে দুই দলের জমায়েত গত এক বছরে বহুবার দেখেছে ঢাকাবাসী। তবে ‘মহাযাত্রার’ ঘোষণায় এবারের কর্মসূচিতে এনেছে বাড়তি মাত্রা।
এই ঘোষণা প্রথমে ছিল বিএনপির। পরে আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়, আসল ‘মহাযাত্রা’ হবে তাদের।
শনিবার কি তবে নতুন কোনো ঘটনার শুরু হতে যাচ্ছে?- এ নিয়েই জিজ্ঞাসা সাধারণের। কারণ, রাজনৈতিক সংঘাতে শেষ পর্যন্ত ভোগে তারাই।
সমাবেশের আগে দিন পথে পথে তল্লাশিতে বিরক্ত হয়েছে মানুষ। ঢাকামুখী বাস সীমিত বা বন্ধ হওয়ায় বাতিল হতে হয়েছে যাত্রা।
সমাবেশের আগে দিন শুক্রবার ছুটির কারণে এমনিতে রাস্তাঘাট ফাঁকা, তার মধ্যে পুলিশ-র্যাবের তৎপরতার খবরে বাইরে মানুষের উপস্থিতি ছিল একেবারে কম।
এর মধ্যে আগাম ঘোষণা ছাড়াই সকালে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার পথে বাস বন্ধ করে দেয় মালিক সমিতি। অন্যান্য রুটেও বাসের সংখ্যা গেছে কমে।
ফিরে এসেছে ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বরের স্মৃতি। সেদিন ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের দিন চলেনি বাস, অটোরিকশা, এমন দেখা মেলেনি ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেলেরও।
পরিবহন মালিকরা এবারও জোর দিয়ে বলতে পারছেন না বাস চলবে কি না।
বিএনপির সমাবেশস্থল নয়া পল্টন ঘিরে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ; প্রস্তুত রাখা হয়েছে সাঁজোয়া যান এবং বসানো হয়েছে বিপুল সংখ্যক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা।
একাধিক জোট ও দলের কর্মসূচি থাকলেও বিএনপি অবশ্য সংঘাতের আশঙ্কা করছে না বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা কোনো আশঙ্কা করছি না। আমাদেরটা (মহাসমাবেশ) আমরা করব।”
তল্লাশিতে ‘ফোন নিয়ে বাড়াবাড়ি’
সমাবেশের আগের দিন রাজধানীর প্রবেশ মুখ গাজীপুরে একাধিক চৌকি বসিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সন্দেহভাজনদের মোবাইল ফোনও ঘেঁটে দেখেছেন তারা, ফেইসুবক অ্যাকাউন্টের পোস্টও পরীক্ষা করেছেন, যেটিকে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলছেন যাত্রীরা।
সাইনবোর্ড এলাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক বিক্রয় প্রতিনিধি বলেন, “ঢাকায় কেন যাচ্ছি, কোথা থেকে আসছি, ঢাকার কোথায় যাব, এই পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ ঠিক আছে। কিন্তু মোবাইল ফোনের লক খুলে দিতে বলছেন পুলিশ সদস্যরা। বাধ্য হয়ে তাদের মোবাইলের লক খুলে দিতে হচ্ছে। তারা এইটা পারেন কিনা আপনার মাধ্যমে প্রশ্ন রাখলাম।”
ব্যাগ তল্লাশির পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্র বা অন্য আইডি কার্ড আছে কি-না- এমন প্রশ্ন করার হচ্ছে বলে জানিয়েছেন যাত্রীরা।
গাবতলীতে পুলিশের তল্লাশি চৌকি পেরোতে ঢাকামুখী যানবাহন দেরি হওয়ায় দীর্ঘ যানজট দেখা গেছে সেখানে; শুক্রবার সন্ধ্যায় যানজট গিয়ে ঠেকেছে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের আমিনবাজারে।
দারুস সালাম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জামাল হোসেন এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “নাশকতা ঠেকাতে যানবাহনে চেক করা হচ্ছে। একটু যানজট সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় ঢোকার মুখে গাড়ি চলাচল সচল রাখতে কাজ করছে পুলিশ।”
তল্লাশি চালানোর বিষয়ে এক প্রশ্নে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুধু সমাবেশকে ঘিরে নয়, সব সময় নিরাপত্তার স্বার্থে তল্লাশি ও অভিযান হয়ে থাকে।”
র্যাব-২ এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে শুক্রবার সকাল থেকে মোহাম্মদপুর, আদাবর, ধানমন্ডি, কলাবাগান, নিউমার্কেট, হাজারীবাগ, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও এবং তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেছেন, নাশকতা এড়াতে পুলিশ ও র্যাব-১ পোড়াবাড়ি ক্যাম্পের উদ্যোগে ঢাকাগামী যানবাহনে তল্লাশি চলেছে।
কেরানীগঞ্জ থেকে বুড়িগঙ্গা নদী পারাপারের খেয়ানৌকা চলাচল বন্ধ রাখতে মাঝিদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, সড়কে তল্লাশি এড়িয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা যাতে নদী পেরিয়ে না যেতে পারে সেজন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এ পদক্ষেপ নেন।
চার হাজার গ্রেপ্তারের অভিযোগ বিএনপির
‘মহাসমাবেশকে’ কেন্দ্র করে দলের নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তারের অভিযোগ এনেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের নামে মামলা হয়েছে ৪১৮টি, গ্রেপ্তার হয়েছে ৪ হাজার ২০ জন।”
সরকারের সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, “যদি সরকার এবং রুলিং পার্টি যদি কোনো রকমের বাড়াবাড়ি করে, অত্যাচার নির্যাতন করে তার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।”
সরকারি দলের পক্ষ থেকে লাঠি ও লগি বৈঠা নিয়ে আসার যে কথা বলা হয়েছে, সেগুলোকে ‘উসকানি’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, ““আসলে পুরো ব্যাপারটাই একটা প্রভোকেশন চলছে। তাদের সরকার প্রধান এক রকম বলছে, অন্যদিকে তারা (প্রশাসন) পুরো জনগণকে জিম্মি করে ফেলতে চাইছে তাদের দমননীতি দিয়ে।”
শনিবার ঢাকায় বাস চলবে?
এই প্রশ্নই এখন বড় রাজধানীবাসীর কাছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রশ্নে বললেন, “গাড়ি চালানোর জন্য আমাদের নির্দেশ আছে, তবে যদি কোনো জ্বালাওপোড়াও ভাঙচুর না করে। কাল তিন গ্রুপের মিটিং, স্বাভাবিকভাবেই একটু আতঙ্ক বিরাজ করছে।”
এই আতঙ্কের কথা বলে শুক্রবার ময়মনসিংহ থেকে বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর যাত্রীদের ভোগান্তি আর বিরক্তি উঠে চরমে। জরুরি প্রয়োজনে ঢাকাগামী অনেকে ছোট ছোট বাহনে বিকল্প পথে ঢাকার দিকে আসেন। তবে দিতে হয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া।
নেত্রকোণার মদনের বাসিন্দা আব্দুল গণি বলেন, “মেয়েটা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। রোববার থেকে তার ক্লাশ শুরু। তাই সপরিবারে তাকে নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছি। নেত্রকোণার মদন থেকে অটোরিকশা দিয়ে ময়মনসিংহ এসেছি।
“এখানে এসে দেখি সকল ধরনের বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। আগে জানলে হয়ত আমরা আসতাম না। হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্তে আমরা খুব বিপাকে পড়েছি। রাজনীতির নামে এসব আমাদের কাম্য নয়। “
চাকরিসূত্রে ময়মনসিংহে থাকা কাজল দেওয়ান নামে আরেক যাত্রী বলেন, “সপ্তাহে শেষে পরিবারের সঙ্গে দুটো দিন কাটাব এটাই স্বাভাবিক। ঢাকায় স্ত্রী সন্তানেরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু বাস চলাচল না করায় যেতে পারছি না।
“এটা কী… আসলে কিছু না হতেই পরিবহন বন্ধ। সরকার কি চাইছে আমরা বুঝতে পারছি না। সাধারণ মানুষ হিসেবে এমন কষ্ট মেনেও নিতে পারছি না। আমরা চাই নোংরা রাজনীতি বন্ধ হোক।”
ময়মনসিংহের বাস কে বন্ধ করেছে, সেটি জানা না থাকার দাবি করলেন এনায়েত উল্লাহ। অথচ তার কোম্পানি এনা পরিবহন চলে এই রুটেও।
তিনি বলেন, “সেটা আমার নলেজের বাইরে। আমিও পরে শুনেছি।”
বিএনপির অবস্থান ‘নমনীয়’
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপির আন্দোলন নতুন নয়। ২০১১ সাল থেকেই এই দাবি জানিয়ে আসছে দলটি।
২০১৪ সালে এই দাবিতে নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি প্রতিরোধের ডাকও দেয় বিএনপি। সে সময় আন্দোলনে ব্যাপক সহিংসতা, বিশেষ করে পেট্রল বোমা হামলা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছিল ব্যাপক।
তবে বিএনপির এবারের কর্মসূচি অনেক নমনীয়। যদিও শনিবারের সমাবেশ থেকে আন্দোলনের মোড় ঘোরানোর ঘোষণা আছে।
মির্জা ফখরুলের আগের দিনের বক্তব্য অবশ্য নমনীয়। তিনি বলেন, “সরকার যেন তার সম্বিত ফিরে পায়, শুভবুদ্ধির উদয় হয় এবং তারা একদফা দাবি মেনে নিয়ে নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে একটা নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে, নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নেই।”
আওয়ামী লীগ কেন মাঠে
বিএনপির সমাবেশের দিন নিজেরাও দুপুরে জমায়াতের পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানের কর্মসূচি নিয়েছে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো।
যে কোনো মূল্যে ‘মাঠ দখলে রাখব’ এমন ঘোষণা শুক্রবার দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ‘নানা ধরনের ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা মরতে হলে মরব, তবুও মাঠ ছাড়ব না। এটা বাংলাদেশের আরেক মুক্তিযুদ্ধ। এটাতে জিততে পারব যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি।
“আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেঁচে থাকতে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে দেব না, এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা। বাংলাদেশ নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র সফল হতে দেব না।"
সমাবেশে শান্তি বজায় রাখতে বিএনপির প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন দেখতে চাওয়ার কথা তুলে ধরে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বলেন, “ফখরুল সাহেবকে বলেন, তিনি যে শান্তিপূর্ণ বলেছেন, তারা যেন শান্তিটা বজায় রাখে। আমরা শান্তি চাই, নির্বাচনের আগেও শান্তি চাই, পরেও শান্তি চাই।”