এর মধ্য দিয়ে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের জেনোসাইড নিয়ে যে সকল বিভ্রান্তি, কুতর্ক ও তথ্যবিভ্রাট আছে, তার পরিপূর্ণ অবসান হবে।
Published : 05 May 2023, 11:34 AM
সম্প্রতি (গত ২৪ এপ্রিল) ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স (আইএজিএস) ‘বাংলাদেশ রেজল্যুশন-এর মাধ্যমে ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দিয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন; কেননা, জাতিসংঘের কাছ থেকে বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতি অর্জনের ক্ষেত্রে এটি আমাদের ভালো সহযোগিতা দেবে। আর এর মধ্য দিয়ে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের জেনোসাইড নিয়ে যে সকল বিভ্রান্তি, কুতর্ক ও তথ্যবিভ্রাট আছে, তার পরিপূর্ণ অবসান হবে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগিরা বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে অনেকের দাবি। আর মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে সারা বাংলাদেশে অসংখ্য গণহত্যা হয়েছে। বিষয়টি দিবালোকের মতো সত্য হলেও, এখনও আমাদের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করার জন্য দেশে-বিদেশে কাজ করতে হচ্ছে। অনেকে অবাক হতে পারেন এই ভেবে যে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের সহযোগিরা গণহত্যা করেছে, মুক্তিযোদ্ধারা ৯ মাস যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন, ৪০ বছর পরে হলেও ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি সহযোগিদের বিচার হয়েছে, তাহলে বায়ান্ন বছর পরে গণহত্যার স্বীকৃতি কেন প্রয়োজন হয়ে পড়ল? এর সোজাসাপ্টা উত্তর হচ্ছে, গণহত্যার স্বীকৃতিটি প্রয়োজন, যারা গণহত্যার শিকার হয়েছেন তাদের আত্মত্যাগের আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতির জন্য, সকল অপরাধীর বিচার সম্পন্ন করা এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্য।
দুই.
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে– জেনোসাইডের বাংলা গণহত্যা নয়। যদিও আমি ইতোমধ্যে গণহত্যা শব্দটি ব্যবহার করেছি এবং এটি করেছি জনপরিসরে বিষয়টির সহজ বোধগম্যতার কথা মনে রেখে। কিন্তু জেনোসাইডকে বাংলায় জেনোসাইডই বলতে হবে; কেননা, ‘জেনোসাইড’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন পোলিশ অ্যামেরিকান আইনের পণ্ডিত রাফায়েল লেমকিন (Raphael Lamkin)। তাঁর এই নামকরণের পূর্বে আর্ন্তজাতিক এই অপরাধের কোনো নাম ছিল না। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, মানুষের ইতিহাসে হাজার হাজার জেনোসাইড হলেও, লেমকিন কর্তৃক ‘জেনোসাইড’ নামকরণের পূর্বে মানুষের ইতিহাসের নৃশংস এই অপরাধটি ছিল ‘নামবিহীন একটি অপরাধ’! আরেকটি চমকপ্রদ (কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক) তথ্য হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নাজি ও জাপানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পূর্বে পৃথিবীর ইতিহাসে নিয়মাবদ্ধ বিচারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কখনো হয়নি।
জেনোসাইডকে কেন বাংলায় জেনোসাইড বলতে হবে, সেটিকে একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়েছিল ‘কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড’। জেনোসাইড কনভেনশনের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে অনুযায়ী, “জেনোসাইড বলতে কোনো জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, বর্ণগত অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণভাবে অথবা আংশিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায় নিয়ে করা নিম্নোক্ত কাজগুলোকে জেনোসাইড বলে গণ্য করা হবে – (ক) ওই গোষ্ঠী (বা দলের) সদস্যদের হত্যা করা; (খ) ওই গোষ্ঠীর সদস্যদের মারাত্মক শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা; (গ) ইচ্ছাকৃতভাবে ওই গোষ্ঠীর জীবনের ওপর এমন অবস্থা আরোপ করা যাতে এটির সম্পূর্ণ বা আংশিক শারীরিক ধ্বংস সাধিত হয়; (ঘ) ওই গোষ্ঠীর মধ্যে নতুন (শিশুর) জন্ম বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা; এবং (ঙ) জোরপূর্বক ওই গোষ্ঠীর শিশুদেরকে অন্য গোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর করা।”
এই সংজ্ঞাটিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি যে, শুধু গণহত্যা নয়, জেনোসাইডের সংজ্ঞার ব্যাপ্তি আরও বড় এবং সূক্ষ্ম। ফলে কোনো একটি জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, বর্ণগত অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠী অন্য কোনো গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা না করেও জেনোসাইডের অপরাধ করতে পারে। জেনোসাইডের এই সর্বজনীন সংজ্ঞাকে বিবেচনায় রেখে বলা যেতে পারে যে, ১৯৭১ সালে যারা বাঙালি জনগোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যাই শুধু নয়, মারাত্মক শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করেছিলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে শারীরিকভাবে বাঙালি জনগোষ্ঠীর সম্পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংস সাধন করেছিলেন, তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনা যাবে।
তিন.
‘বাংলাদেশ রেজল্যুশন’ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আইএজিএস কর্তৃক বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতি সহজ কোনো কাজ ছিল না। বিষয়টিকে আইজিএস-এ উত্থাপন করা, রেজল্যুশন ড্রাফট করা, ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে প্রস্তাব অনুমোদন করিয়ে জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়াটির পেছনে লেগেছিলেন শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর। তাঁকে সার্বক্ষণিক সমর্থন এবং যথাযথ সহযোগিতা দিয়ে গেছেন অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যান্টন, ড. হেলেন জার্ভিস, অধ্যাপক এডাম জোন্স, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, অধ্যাপক এলিসা ভন জোয়েডেন-ফর্জে, ড. শাহরিয়ার ইসলাম ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস-এর সহকারি অধ্যাপক ইমরান আজাদ। এর বাইরে আইরিন ভিক্টোরিয়া ম্যাসিমিনো এবং থেরেসা ল্যাং নানাভাবে সহায়তা করেছেন।
এ ব্যাপারে সম্প্রতি লেখা এক কলামে তৌহিদ রেজা নূর জানাচ্ছেন যে, জেনোসাইডের স্বীকৃতি অর্জনের কাজটি মসৃণ নয়। যেহেতু আইনি সংজ্ঞার দ্বারা জেনোসাইড সংজ্ঞায়িত, তাই ঘটে যাওয়া অথবা ঘটমান অপরাধসমষ্টিকে কেউ ইচ্ছে হলেই জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে ঘোষণা দিতে পারেন না। ইতিহাসের আলোকে নানা কার্যকারণ বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি আইনের কষ্টিপাথরে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় এ ব্যাপারে। জেনোসাইড নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন, এ বিষয়ে যাঁরা পড়ান, আইনি লড়াই লড়েন, তাঁরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পূর্বাপর বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করেন কোথাও জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে, কি হয়নি।
২৪ এপ্রিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের (আইএজিএস) পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতির মাইলফলকে এসে পৌঁছানোর দীর্ঘ পথটি ছিল বন্ধুর। পদে পদে কখনো আইএজিএসের গঠনতন্ত্রে থাকা বিধি-উপবিধিজনিত প্রতিবন্ধকতা, কখনোবা বোঝাপড়াজনিত প্রতিবন্ধকতায় শ্লথ হয়েছে এই রেজল্যুশন বিষয়ে আইএজিএসের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া। বিষয়টি খোলাসা করে বলতে গিয়ে তৌহিদ লিখেছেন যে, “স্পেনের বার্সেলোনায় ২০২১ সালের ১৮ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের (আইএজিএস) দ্বিবার্ষিক কনফারেন্স হয়েছিল। আমি সেই কনফারেন্সে ‘ফিফটি ইয়ারস অব বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড আফটারম্যাথস’ শীর্ষক এক প্যানেল সেশনের প্রস্তাব করেছিলাম, যেখানে বাংলাদেশের চারজন গবেষক গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। আইএজিএস যেন বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতি দিয়ে এই কনফারেন্স থেকে একটি রেজল্যুশন প্রকাশ করে সে দাবি উত্থাপন করা হলে অধ্যাপক এডাম জোন্স পূর্ণ সমর্থন করেন। কনফারেন্সের শেষ দিন আইএজিএসের বিজনেস মিটিংয়ে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্মকর্তাদের গোচরে আনা হলে তাঁরা গঠনতন্ত্র মোতাবেক ড্রাফট রেজল্যুশন জমা দিতে পরামর্শ দেন ... পরে ২ আগস্ট ২০২১ বাংলাদেশের শহীদদের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে আইএজিএসে ড্রাফট রেজল্যুশন জমা দিই।”
আইএজিএসের নির্বাহী কমিটি তৌহিদ রেজা নূরের প্রস্তুত করা ড্রাফটটি গ্রহণ করার পরে বিধি মোতাবেক প্রেরণ করে রেজল্যুশন কমিটির কাছে। এর সাড়ে চার মাস পরে ১৭ ডিসেম্বর রেজল্যুশন কমিটি বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়। রিভাইজড ডকুমেন্টটি তাদের কাছে পাঠানো হয় ২৬ ডিসেম্বর। এর পরে আইএজিএসের নির্বাহী কমিটি রেজল্যুশনের সংযুক্তি হিসেবে সেকেন্ডারি বিভিন্ন দলিলের তালিকা জমা দিতে বলে। ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রয়োজনীয় সংযুক্তি পাঠান তৌহিদ রেজা নূর। রেজল্যুশন কমিটি জমা দেওয়া সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে এবং তা গ্রহণ করে নির্বাহী কমিটিতে ভোটাভুটির জন্য পাঠায়। এরপরও নানা প্রক্রিয়া শেষ করে শতকরা ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ‘বাংলাদেশ রেজল্যুশন’ পাশ হয়।
এই প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে জেনোসাইড এক্সপার্ট ও স্কলারদের বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান আইএজিএস ঘোষণা দিল যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংস ঘটনাসমূহ ছিল জেনোসাইড। বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে এই ঘোষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অর্জন। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেকে বাংলাদেশের জেনোসাইড নিয়ে কাজ করছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং অনেক তরুণ গবেষক ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বসে বাংলাদেশের জেনোসাইড নিয়ে গবেষণা করছেন। এদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জাতিসংঘের কাছ থেকে বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃত আদায় করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে বলে জোর প্রত্যাশা রইল।