প্রশ্ন হলো, এই ঝাঁকুনি কে দেবে? দেশের মানুষকে নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলার সামর্থ্য কী বিএনপির আছে? মানুষ বিএনপির কোন নেতাকে নিয়ে আগ্রহী হবে?
Published : 26 Aug 2023, 05:44 PM
মাঝে মাঝে কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচি আর বক্তৃতা-বিবৃতিতে হুমকি-ধমকি প্রদানের মধ্যেই বিরোধী দলের রাজনীতি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। জাতীয় নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে, রাজনীতি নিয়ে টেনশন বাড়ছে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা, তারা নির্বাচনে অংশ না নিলে কী হবে, ক্ষমতাসীনরা যেনতেন প্রকারে একটা নির্বাচনের আয়োজন করে আবারও ক্ষমতায় আসবে, নাকি বিএনপি তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি বাস্তবায়ন করে জনরায় নিয়ে ক্ষমতায় আসবে, এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও বিএনপির নেতারা তর্জন-গর্জন অব্যাহত রেখেছেন।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকার হটাতে ‘বড় রকমের ঝাঁকুনি’ দরকার বলে মন্তব্য করেছেন। প্রশ্ন হলো, এই ঝাঁকুনি কে দেবে? দেশের মানুষকে নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলার সামর্থ্য কী বিএনপির আছে? মানুষ বিএনপির কোন নেতাকে নিয়ে আগ্রহী হবে? দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডিত এবং বয়সজনিত বিভিন্ন রোগে জর্জরিত বেগম খালেদা জিয়া কী আগামী দিনে দেশ পরিচালনা করতে পারবেন? খালেদার জিয়ার পরিবর্তে বিএনপির হাল কে ধরবেন? একাধিক মামলায় দণ্ডিত ফেরার হয়ে ইংল্যান্ডে বসবাসকারী তারেক রহমান কি বিএনপির হাল ধরতে পারবেন? দেশবাসী ও বিএনপির নেতাকর্মীরা কী তাকে মেনে নেবে? সবচেয়ে বড় কথা আওয়ামী লীগ কি বিএনপির ফিরে আসার সুযোগ দেবে? ২০০৪ সালের একুশে অগাস্ট গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করতে চেয়েছে যে দল, সেই দলকে আওয়ামী লীগ ন্যূনতম ছাড় দেবে? তা যদি না দেয়, তাহলে দেশে আগামী নির্বাচনে কী হবে?
আমাদের দেশের রাজনীতিতে এমন অসংখ্য প্রশ্ন আছে। উদ্বেগ, ভয়, আশঙ্কা আছে। কিন্তু এর কোনো সমাধানসূত্র নেই। আপাতত রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন পরাশক্তির কাছে ধরনা দিচ্ছেন। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ভারতের সমর্থন পাবার চেষ্টা করছেন। যদিও এদেশে কে ক্ষমতায় এলো, কিংবা ক্ষমতায় এলো না, এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় এবং আগ্রহ বৃহৎ দেশগুলোর খুব আছে কিনা ভাববার বিষয়। তারা আছে তাদের ধান্দায়। তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ কীভাবে রক্ষা পাবে, এটাই তাদের একমাত্র এজেন্ডা। তারা কাউকেও ক্ষমতায় বসিয়েও দেবে না। ক্ষমতা থেকে নামিয়েও দেবে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই বিদেশিদের কথায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমাদের দেশেও হবে না। তারপরও রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশিদের পেছনে ধরনা দিচ্ছে। তাদের পায়ে তেল মাখছেন নেতারা। একটা স্বাধীন দেশের রাজনীতিবিদদের জন্য এটা যে অত্যন্ত অপমানের—এই বোধটাও কারো আছে বলে মনে হয় না।
আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ নেই। তারা রাজনীতি করেন ক্ষমতায় যাবার জন্য এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য। এখানে রাজনৈতিক দল মানে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত থাকা মানে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া। যে দল যখন ক্ষমতায় আসে সেই দলের নিচুতলার কর্মীরাও ক্ষমতার স্বাদ পায় এবং কুৎসিতভাবে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে, এই ছবি আমাদের দেশে গত চার দশক ধরে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এই গভীর সামাজিক অন্যায়, মূল্যবোধের এই ভয়ঙ্কর পতনের পেছনে আমাদের ভূমিকাও একেবারে কম নয়। আমাদেরই ঘরের ছেলেমেয়েরা যখন বিপথে যায়, সৌখিন নির্বুদ্ধিতায়, ভয়ে কিংবা লোভে, আমরা তাদের বাধা দিইনা৷ আমরা হয়তো ভাবি এভাবেই হবে৷ সাফল্যের শর্টকাট পেলেই আর কোনও সমস্যা থাকবে না৷ আমাদের সুবিধাবাদিতা, পরোটা-কাবাবের লোভ আর গা-ভাসানোর নীরবতার নীতির ফল আজ দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্কীর্ণ স্বার্থপরতা, অসামাজিক কাজের সঙ্গে প্রকাশ্যে জড়িয়ে থাকা, সমস্তরকম অপরাধ করেও রাজনীতির নামে আশ্রয় পাওয়া—এই অবস্থাটার মধ্যে৷
আমরাও এখন সেয়ানা হয়েছি। চালাক হয়েছি। হতাশ, ব্যর্থ, প্র্রচলিত স্রোতে গা-ভাসানোর বিদ্যায় অভ্যস্ত আমরা সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা যতই দমবন্ধ হোক না কেন, আমাদের মতো মানুষরা অন্যায়ের কোনও প্রতিবাদ করার কথা ভাবিনি৷ অন্য কেউ কখনও প্রতিবাদ করে লাঞ্ছিত হলে প্রকাশ্যে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াইনি৷ বরং নিজের নিজের ‘নিরাপত্তা’ রক্ষা করার চেষ্টায় দূরে সরে থেকেছি৷ ‘চোখ বুজে কোনও কোকিলের দিকে’ কান ফিরিয়ে রেখেছি৷
আমাদের মধ্যে আবেগ মাঝে-মাঝে ভর করে বটে, তবে তা দ্রুতই মিলিয়ে যায়। আবেগ অবশ্যই মানুষের স্বাভাবিক বেঁচে থাকার জন্য একেবারে প্রাথমিক প্রয়োজন কিন্তু তার সঙ্গে যদি সচেতন কোনও চিন্তা যুক্ত না থাকে তবে সেই আবেগ আমাদের বেশিদূর নিয়ে যেতে পারে না৷ সচেতন চিন্তা ছাড়া আবেগেরও দৃঢ়তা থাকে না৷ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সময়েও অন্যায়ের মূল কারণটি বোঝার চেষ্টার বদলে, অন্যায়ের কাঠামোটিকে চিহ্নিত করবার বদলে আমরা কেবল ভাবি, ওকে সরিয়ে দিলেই বুঝি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে৷ কার্যত তা কখনও হয় না৷ হওয়ার কথাও নয়৷
গত প্রায় ৪০ বছর ধরে উন্নতি ও সাফল্যের যে সমাজ-বিচ্ছিন্ন ধারণা আমাদের সংস্কৃতিতে শেকড় গেড়েছে, তার বিপরীত চিন্তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি৷ ফলে আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম এই সমাজ, দেশ, বিশ্বের কোনও কিছু নিয়ে মাথা না ঘামিয়েও কোনওরকমে নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করে ফেলা যাবে৷ বাস্তবে দেখা গেল এই ভাবনার যা ফল হওয়ার ঠিক তাই হয়েছে৷ উত্তরপ্রজন্মও নিজের সাফল্যকে দেখেছে ঠিক যেভাবে দেখা স্বাভাবিক। অনেক সুযোগসুবিধে পেয়ে, উজ্জ্বল সফল কিছু ছেলেমেয়ে বাড়ি থেকে বহুদূরে বসে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে৷ তারা ধীরে ধীরে এ দেশের এই সমাজেরই মধ্যে হয়ে গেছে এক ভিন্ন পৃথিবীর বাসিন্দা৷ একটি বড় অংশ নানান রাজনৈতিক দলে কর্মী হিসেবে চাকরি করে৷ সে সব দলের আদর্শ বিষয়ে তারা কিছু জানে না, জানানোর কোনও চেষ্টাও হয় না৷ তারা কেবল নিজের নিজের দলের ক্ষমতা বজায় রাখা এবং ভোটের আগে-পরে এলাকা দখলের কাজে ব্যবহৃত হয়। বদলে কিছু অর্থ ক্ষমতাশালী লোক তাদের দেবেন, বাকিটা তাদের আদায় করে নেওয়ায় কেউ বাধা দেবে না৷ কারও মনে হতে পারে অবস্থাটা যেন ‘মধ্যযুগের’ মতো যখন রাজা-জমিদাররা সিপাইদের নিজেদের যুদ্ধবিগ্রহের কাজে লাগাতেন, বাকি সময় তাদের ‘চড়ে খাওয়ার’ অধিকার থাকত৷ তাতে তারা প্রজার ঘরে আগুন লাগাক কি তার গোয়ালের গরুবাছুর খুলে আনুক! তার বাইরে যে ‘উত্তরপ্রজন্ম’ তারা এই দুই ধাপের মাঝখানে হতাশা ও আত্মোন্নতির চেষ্টার দোলাচলে থেকেছে৷ তার ফলে দেশে ক্ষমতা পরিবর্তন হলেও ব্যবস্থাটা কিছু বদলাচ্ছে না।
দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বেকারত্ব, কর্মহীনতা৷ যে কোনও দেশের জনগোষ্ঠীর জীবিকা ও উপার্জন প্রধানত নির্ভর করে তার প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর৷ ভুললে চলবে না যে জমির অনুপাতে বসবাসকারীর সংখ্যা পৃথিবীতে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪৬ হলেও আমাদের দেশের ক্ষেত্রে প্রায় ৩০০০৷ কোনও দানখয়রাতি, দারিদ্র্যরেখা কিছু দিয়েই এই জনসংখ্যার মর্যাদাপূর্ণ জীবিকার ব্যবস্থা করা যে কোনও সরকারের পক্ষেই কঠিন।
অথচ, আশির দশক থেকে এ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে বহুজাতিকদের স্বার্থে যথেচ্ছ অপচয় করা হচ্ছে৷ দেশের সর্বোচ্চ দায়িত্বে থাকা সরকার এক্ষেত্রে স্বদেশের স্বার্থ না দেখে মুষ্টিমেয়র আর্থিক স্বার্থ দেখতে চুক্তিবদ্ধ৷ একদিকে বাড়ছে ধর্মকেন্দ্রিকতা, আরেক দিকে বাড়ছে রাজনৈতিক যথেচ্ছাচার। ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদী আতঙ্কের পাশাপাশি আরও অনেক বড় ও গভীর সঙ্কটে দেশ নিমজ্জিত। একটা পোশাকি উন্নয়নের ঢোল বাজানো হচ্ছে। এবং ‘উন্নয়ন’ তাকেই বলা হচ্ছে যাকে উন্নয়নের এজেন্টরা ঠিক বলছেন।গণতন্ত্রের মহিমা এখানে একমুখী তালি বাজানো।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে, শিক্ষাকেন্দ্রগুলো হয়েছে রাজনীতির মহাআড়ৎ। অরাজকতাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবাদ, সমালোচনাকে টুটি টিপে ধরা হয়েছে। বিরোধী দল বিবৃতিসর্বস্ব। দেশে আইন, নীতি, কল্যাণমুখী পরিকল্পনা-কোনো কিছুরই অস্ত্বিত্ব নেই। ভালো ছাত্ররা— জিওম্যাট-টোফেল দিয়ে বিমানে চড়ে পৃথিবীর সব উন্নত দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আমাদের শিক্ষাও সীমাহীন ক্ষয়ের দিকে এগিয়ে চলছে চোখ-কান বন্ধ করে।
আমাদের নেতারা ঠিক করেছেন, তারা কার চেয়ে কে খারাপ হবেন—এই প্রতিযোগিতা করেই কাল পার করে দেবেন। তারা ঠিক করেছেন যে মানুষের কাছে যাওয়ার দরকার নেই, আমিই হচ্ছি সম্রাট। আমিই জানি কোনটা ভাল জনতার জন্য। আমাদের সে সব টোটকা জানা আছে।
শাসকদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির কোনও পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। রাজনীতি এখন রাজনীতি থেকে নেমে গণনীতি, সমাজের সমস্ত সংস্থায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, স্কুলে কলেজে কলকাঠি নাড়ছে নেতা এবং পাতি-নেতারা। তাদের রাজনৈতিক দলের নেতা বলব না, তারা হল স্রেফ ‘আমাগো লোক’। অরাজকতা আমাদের চিরকালের পাথেয়, এখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তীব্রভাবে। কৃষিতে, বাণিজ্যে, শিল্পতে, এমনকী শিল্পজগতেও। এর কোথায় শেষ? আবার নতুন করে দেশ গড়বে কে? সে মানুষেরা কোথায়?