কণ্ঠরোধের তন্ত্র

খুব তুচ্ছ কারণে যদি মামলা দিয়ে হয়রানি করে সাধারণ বাকস্বাধীনতাটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে আস্তে আস্তে কোনো কিছুই বলা বা লেখার স্বাধীনতা থাকবে না। আজ যারা স্বার্থ ও সুবিধার কারণে ক্ষমতাবানদের পক্ষে দাঁড়িয়ে গণমাধ্যমের বাকস্বাধীনতায় লাগাম দেওয়ার সওয়াল করছেন, তাদের এই কথাটা ভেবে দেখা খুব জরুরি।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 3 April 2023, 10:33 AM
Updated : 3 April 2023, 10:33 AM

চুপ করিয়ে দেওয়া, থামিয়ে দেওয়া, কণ্ঠ রোধ করে দেওয়া মোটেও ভালো কথা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই ঘটনাটিই সমাজের নানা পর্যায়ে ঘটছে। যে যেখানে শাক্তিশালী, সে-ই প্রতিপক্ষের কণ্ঠ রোধ করার ব্যাপারে মরিয়া হয়ে উঠছে। ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা তাদের পরাক্রম দেখাতে যখন কণ্ঠরোধের তন্ত্র কায়েম করেন, তখন আসলে সমাজের শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। আর শ্বাসরোধ হওয়া ব্যক্তি যে জীবন বাঁচাতে ছটফট করে, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বাঁচতে চায়, এটা কে না জানে? এতে করে অনিবার্য অস্থিরতাকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু এসব ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা করার সময় কারও আছে বলে মনে হয় না। বিশেষত দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নিজেদের আচরণের ব্যাপারে একেবারেই বেপরোয়া। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এই বেপরোয়া ও অপরিণামদর্শী আচরণের কারণে পুরো সমাজটাই যেন রসাতলে যেতে বসেছে।

দৈনিক ‘প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমান ও প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার কথাটি উল্লেখ করা যায় এ প্রসঙ্গে। গত ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে পত্রিকাটিতে প্রকাশিত একটি সংবাদে একজন দিনমজুরের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে উদ্ধৃত করা হয়, “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’’ এই উদ্ধৃতির সঙ্গে একটি শিশুর ছবি ছিল, যে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে স্মৃতিসৌধের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এ সংক্রান্ত ফেসবুক পোস্ট ও খবরের স্ক্রিনশট বেশ ভাইরাল হয়।

প্রতিবেদনে ওই উক্তিটি আরেক ব্যক্তির হলেও শিশুটির ছবি বিভ্রান্তি তৈরি করেছে বলে অভিযোগ ওঠে।

পরে পত্রিকাটি পোস্ট সংশোধন করলেও এই খবরটিকে ‘মিথ্যা’ ও ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ উল্লেখ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫-এর (২), ৩১, ৩৫ ধারায় আনা অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামিরা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ব্যবহার করে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ণ করে এবং বিভ্রান্তি ছড়াতে মিথ্যা তথ্য প্রচার করেছে।

প্রথম আলো, প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক, বার্তা সম্পাদক কিংবা সম্পাদক দোষী না নির্দোষ ওই আলোচনায় যাব না। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে ইতিমধ্যে অনেক মতামত প্রকাশিত হয়েছে। তবে দেশের শীর্ষ একটি পত্রিকার সম্পাদকের নামে এভাবে মামলা করা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে গ্রেফতার করার ঘটনাটি ভীষণ উদ্বেগের। শেষপর্যন্ত সম্পাদকের আগাম জামিন এবং প্রতিবেদকও জামিন পেয়েছেন। তবে এর ফলে আখেরে ক্ষতি হবে গণমাধ্যমের, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সর্বোপরি দেশের ভবিষ্যৎ সমাজের।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত যে কোনো প্রতিবেদনের ভুল বা অসঙ্গতি থাকলে কেউ তা নিয়ে সংক্ষুব্ধ হতে পারেন এবং তা নিরসনের জন্য দেশে প্রেস কাউন্সিল আইন রয়েছে। বিদ্যমান ওই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রেস কাউন্সিল আইনকে উপেক্ষা করে সরাসরি কোনো প্রতিবেদককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো, গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখার এবং সমালোচনামূলক বা ভিন্নমত প্রকাশ করলে শায়েস্তা করার অভিপ্রায়কে স্পষ্ট করে তোলে, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের নামান্তর।

নানা সীমাবদ্ধতা ও অবক্ষয় সত্ত্বেও আমাদের দেশে এখনও বিত্তবান, ক্ষমতাবানদের নিষ্ঠুরতা, অন্যায় অত্যাচার-অনাচার তুলে ধরার একমাত্র জায়গা হচ্ছে গণমাধ্যম। দেশে কার্যকর বিরোধী দল বা বিরোধী রাজনীতির অভাব পূরণের প্ল্যাটফর্মও হচ্ছে গণমাধ্যম। এই গণমাধ্যম যদি কোনো কারণে আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তা সামষ্টিক ক্ষতি। যদিও গণমাধ্যমের ব্যাপারে মানুষের বিস্তর অভিযোগ আছে। কোনো কোনো গণমাধ্যম ঘটনাকে একপেশে বা খণ্ডিত আকারে প্রকাশ-প্রচার করে, ক্ষমতাবানদের দালালি করে, দুর্নীতিগ্রস্ত মালিকশ্রেণির পক্ষে ভূমিকা পালন করে, কখনো কখনো সামাজিক অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পও ছড়ায়। বস্তুনিষ্ঠতার ব্যাপারে বেশিরভাগ গণমাধ্যম উপেক্ষা প্রদর্শন করে। গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে এমন বিস্তর অভিযোগ আছে। আজকাল তথ্যই হচ্ছে শক্তি, সবচেয়ে বড় অস্ত্র। বস্তুনিষ্ঠ এবং দায়িত্বশীলভাবে এটির ব্যবহার করা না হলে সমাজে বহু অনাচারের উদ্ভব ঘটবে। এতদসংশ্লিষ্ট পেশার সঙ্গে সরাসরি যেসব মানুষ জড়িত এ বিষয়ে তাদের দায় সবচেয়ে বেশি। অবশ্য এ জন্য তাদের পেশাগত এমনকি জানমালের ঝুঁকিও কম নয়। বোধ করি আখেরে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে এই বহুমাত্রিক ঝুঁকি থেকে ব্যক্তি, পেশা এবং সমাজকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু ওই কাজটি না করে রাষ্ট্র যদি নিজেই নিপীড়কের ভূমিকা পালন করে, তাহলে আর ভরসা কোথায়?

এটাও ঠিক যে, বাকস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে যা খুশি তা-ই বলা বা ছাপা যায় না। বিশেষত তা যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়। কিংবা যদি তা বিদ্বেষপ্রসূত হয় বা একটি গোষ্ঠীর মনে আঘাত লাগে। কিছু মানুষ নিশ্চয়ই বলবেন, কোনো কথায় কারও মনে আঘাত লাগলে সেটা বিবেচ্যই নয়। বাকস্বাধীনতা শুধু স্বাধীনতাটুকুর কারণেই জরুরি।

বাকস্বাধীনতার ব্যাপারটি একটু জটিল। ধরা যাক, আমার স্বাধীন কথায় আপনার মনে আঘাত লাগতে পারে। কথাটা বলে আমার নিজের আনন্দ হচ্ছে বটে, কিন্তু সেই চক্করে আপনার খারাপ লাগা বাড়ছে। এতে আপনি আপত্তি জানালে আমার কথা বলার অধিকার খর্ব হয়। আবার আপনার মানসিক অবস্থা বিচার করলে আমার বাক-সংযমের ব্যাপারটিও সামনে চলে আসে।

প্রায় সব কথাতেই কারও না কারও মনে আঘাত লাগতে পারে। রাষ্ট্র এ ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে। রাষ্ট্র অনেক সময় নাগরিকদের খারাপ লাগাকে গুরুত্ব দেয়। কোনো কোনো রাষ্ট্র কারও কোনো কথা খারাপ লাগলেই (এমনকি, খারাপ লাগার আশঙ্কা থাকলেও) তা নিষিদ্ধ করে দেয়। আমাদের দেশে যেমন ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ নিষিদ্ধ। ফ্রান্সে যেমন ইহুদিবিদ্বেষী কথা নিষিদ্ধ। অনেক সময় রাষ্ট্র বলতে পারে, যে কথা শুনতে খারাপ লাগছে, অথবা যে সিনেমা-ছবি-বই-নাটকে কোনো বিশ্বাসে আঘাত লাগছে, দয়া করে সেগুলোকে এড়িয়ে চলুন। ভালো না লাগলে সালমান রুশদি বা তসলিমা নাসরিনের বই পড়বেন না। আপনি যে গান শোনেন তা আমার কুরুচিকর মনে হতে পারে, এবং সেই গান লোকে শুনে যদি ভাবে যে, সমাজ কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে, সেই চিন্তাও আমাকে যন্ত্রণা দিতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ না মাইকে সজোরে সেই গান চালিয়ে আপনি আমার জীবন অতিষ্ঠ করছেন, ততক্ষণ আপনার সেই গান শোনায় হস্তক্ষেপ করার পক্ষে যুক্তি দুর্বল, কারণ আপনার যা ঘোর অপছন্দের, তা হয়তো আরেক জনের কাছে বেঁচে থাকার মন্ত্র। সেই জন্য মানুষের মত-মন্তব্যের ব্যাপারে রাষ্ট্রের হাত গুটিয়ে থাকাই সমীচীন। অবশ্য, কোনো মত-মন্তব্য যখন এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব হবে, তখন রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে বিলক্ষণ। কিন্তু সেটা বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়, মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রক্রিয়া।

কিন্তু রাষ্ট্র যদি নানা উছিলায় বাকস্বাধীনতা খর্ব করতে থাকে, তা হলে কি এমন একটা সমাজে পৌঁছনো যাবে যেখানে সবাই একে অপরকে ‘কিন্তু সবার চাইতে ভাল পাউরুটি আর ঝোলাগুড়’-এর বাইরে কোনো কথা বলবে না? মুশকিল হলো, বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিতে দিলে এমন ‘নিরামিষ’ সমাজে পৌঁছনোও অসম্ভব। কারণ, রাষ্ট্র তো কোনো বায়বীয়, বিমূর্ত অস্তিত্ব নয়। সেই ক্ষমতার চূড়ায় যাঁরা বসে থাকেন, তাঁদের দল আছে, মতাদর্শ আছে, বিশ্বাস আছে, নিজস্ব ‘ভাবাবেগ’ আছে, এবং তাতে আঘাতও লাগে বড় সহজেই। সেই রাষ্ট্র ‘ন্যায়ানুগ’ হবে, অর্থাৎ সবার ভাবাবেগকে সমান মর্যাদা দেবে, এমনটা ভেবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। অতএব রাষ্ট্রের হাতে বাকস্বাধীনতা খর্ব করার অধিকার একবার তুলে দিলে শেষ পর্যন্ত তাদের অধিকারটুকুই খর্ব হবে, যারা রাষ্ট্রের চালকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখায়।

খুব তুচ্ছ কারণে যদি মামলা দিয়ে হয়রানি করে সাধারণ বাকস্বাধীনতাটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে আস্তে আস্তে কোনো কিছুই বলা বা লেখার স্বাধীনতা থাকবে না। আজ যারা স্বার্থ ও সুবিধার কারণে ক্ষমতাবানদের পক্ষে দাঁড়িয়ে গণমাধ্যমের বাকস্বাধীনতায় লাগাম দেওয়ার সওয়াল করছেন, তাদের এই কথাটা ভেবে দেখা খুব জরুরি।

এখানে একটা কথা মনে রাখা ভালো যে, বাকস্বাধীনতা জিনিসটা কিন্তু নিখরচায় মেলে না। বহু ক্ষেত্রেই তার মূল্য চোকাতে হয়। বন্ধুবিচ্ছেদ থেকে মানহানির মামলা, সবই হতে পারে। অফিসে বসের বিরুদ্ধে বাকস্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগ করলে চাকরি যাওয়াও বিচিত্র নয়। কিন্তু সেই বিরুদ্ধতাগুলোও অপর দিকের স্বাধীনতারই প্রকাশ। যতক্ষণ তা আইনের স্বীকৃত গণ্ডিতে থাকছে, অর্থাৎ কোনো কথায় ক্ষুণ্ণ হয়ে কেউ বন্দুক হাতে তেড়ে না আসছে, ততক্ষণ এতে আপত্তির কোনো কারণ নেই। কিন্তু রাষ্ট্র যদি বাকস্বাধীনতায় লাগাম পরাতে আসে, সেটা বিপজ্জনক, কারণ রাষ্ট্রই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার হাতে দমনপীড়নের আইনি অধিকার আছে। আর রাষ্ট্রযন্ত্রে যেহেতু ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর প্রভাব বেশি, তাই সেই ক্ষমতার ওপর লাগাম পরানোই গণতান্ত্রিক সমাজের উদ্দেশ্য, তার প্রসার নয়।

পরিশেষে যে কথাটি না বললেই নয় যে, গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাগরিকদের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, যা যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে আমাদের সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে, তা সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার হরণের প্রক্রিয়া দ্রুত বন্ধ করা না হলে দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কবর রচনা হবে। তাই দলমত নির্বিশেষে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষের সকল শক্তির দায়িত্ব ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি তোলা। কণ্ঠরোধের তন্ত্র নয়, কণ্ঠ ছেড়ে গাইবার তন্ত্র সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক।