স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা একটি বিতর্কমুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা কায়েম করতে পারিনি। নির্বাচন এলেই এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন, বিতর্ক ইত্যাদি শুরু হয়। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে, সে বিতর্কের ফয়সালা আমরা করতে পারিনি।
Published : 22 Jul 2023, 12:01 AM
দেশের রাজনীতি কি আবার সংঘাতময় হয়ে উঠছে? লক্ষণ সুবিধের নয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মুখোমুখি অবস্থান শান্তিকামী মানুষের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। নির্বাচনই অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় দূর হচ্ছে না। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ কোনো পক্ষকেই সমঝোতার পথে চলতে উৎসাহিত করছে বলে মনে হয় না।
গত ১৫ বছর টানা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকায় দেশের দৃশ্যমান অনেক অগ্রগতি হয়েছে। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ভালো। আমরা এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। মধ্য ও উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে সরকার অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু সরকার পরিবর্তন হলে উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত থাকবে কিনা সে শঙ্কাও অনেকের মধ্যে রয়েছে।
আমরা গর্ব করে বলে থাকি যে, অনেক লড়াই-সংগ্রাম করে আমরা দেশে গণতন্ত্র কায়েম করেছি। সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রপ্রিয়; অবৈধভাবে বা চোরাপথে বন্দুকের জোরে যারা ক্ষমতা দখল করে, এ দেশের মানুষ তাদের মেনে নেয় না, নির্বিবাদে তাদের শাসন চালাতে দেয় না। তারপরও সত্য এটাই যে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দুইবার আমাদের ওপর অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসন চেপে বসেছিল। নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে, বছরের পর বছর আন্দোলন করে ভোট দিয়ে সরকার বদলের একটি ধারা আমরা চালু করেছি।
বেশি মানুষ যাদের ভোট দেয়, তারা দেশ শাসনের অধিকার পায়– এই ব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু হয়েছে। এটাকে প্রকৃত গণতন্ত্র না বলে ভোটের গণতন্ত্র বলাই ভালো। অথচ স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা একটি বিতর্কমুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা কায়েম করতে পারিনি। নির্বাচন এলেই এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন, বিতর্ক ইত্যাদি শুরু হয়। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে, সে বিতর্কের ফয়সালা আমরা করতে পারিনি। বেশি মানুষের ভোট পেয়ে যারা ক্ষমতায় যাচ্ছে তারা কিন্তু বেশি মানুষের কল্যাণ করছে না, কল্যাণ করছে অল্প সংখ্যক মানুষের।
অল্প মানুষ সুখে থাকবে, বেশি মানুষ অসুখী থাকবে– এটা তো স্বাধীনতার মূল্যবোধ তথা ন্যায়ের কথা নয়, ইনসাফের কথা নয়। একদিকে কিছুসংখ্যক মানুষের ধন-সম্পদ বাড়ছে, অঢেল বিত্তের অধিকারী হয়ে তারা বিলাসী জীবনযাপন করছে, অন্যদিকে বেশি সংখ্যক মানুষের জীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন কষ্ট-দুর্ভোগ। দিন যত যাচ্ছে, ততই মানুষে মানুষে ধনবৈষম্য বাড়ছে, বাড়ছে দারিদ্র্য। কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে, কমছে না হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যাও।
আমরা দাবি করে থাকি যে, আমাদের দেশের মানুষ রাজনীতি সচেতন। তারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল করে না। সত্যি কি তাই? ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কি সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি? কাকে ভোট দেই, কেন দেই, যাকে ভোট দেই তিনি আমাদের ভোটের মর্যাদা রক্ষা করেন কিনা, এগুলো কি সত্যি আমরা বিচার-বিবেচনা করি? ভোটদানে আমাদের বিচক্ষণতার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলা যেতে পারে যে, আমাদের ভোটে যারা ক্ষমতায় যায়, ক্ষমতায় গিয়ে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করলে পরবর্তী নির্বাচনে আমরা তাদের ভোট দেই না। এটা কি ভোটারদের সচেতনতার পরিচয় বহন করে না? প্রশ্ন হলো, এ রকম বৃত্তবন্দি হয়ে থাকার নাম কি সচেতনতা? আমাদের এই বৃত্তের মধ্যে চলার কি শেষ হবে না? আমরা কি বৃত্ত ভাঙার কোনো চেষ্টা করব না? যারা ওয়াদা ভঙ্গ করছে বারবার, তাদের কাছেই কেন আমাদের ঘুরেফিরে সমর্থন জানাতে হবে?
ভোটের গণতন্ত্রের জন্য আমরা উদ্বিগ্ন। অথচ আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার কোনো বালাই নেই। দলের প্রধান নেত্রী বা নেতার ইচ্ছার বাইরে দল চলে না, সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। কোনো কোনো সময় কোনো দলের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে কেউ কেউ কথা বলার সুযোগ পেয়ে থাকেন তবে আলাপ-আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয় দলীয় প্রধানের ওপর। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চা আমাদের এই পর্যন্তই।
আমরা জানি যে, একটি দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকে রাজনীতিবিদদের হাতে। তারাই দেশ চালান। কখনো সরকারে থেকে, কখনো বিরোধী দলে থেকে। আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের অক্ষমতা-ব্যর্থতা কি কারও নজর এড়ায়? তারা কতটুকু সৎ, বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী? তারা কী নিজেদের জন্য রাজনীতি করেন, নাকি মানুষের জন্য? যাদের পেশিশক্তির জোর বেশি, যারা রাতারাতি টাকাওয়ালায় পরিণত হয়েছেন– রাজনীতিতে আজকাল তাদেরই দাপট বেশি। রাজনীতিতে ভালো মানুষের প্রান্তিক অবস্থান নিয়ে আমাদের তেমন উদ্বেগ আছে কি? আগে ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসার প্রসার ও সুরক্ষার জন্য রাজনীতিবিদদের চাঁদা দিতেন অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের চলতে হতো ব্যবসায়ীদের চাঁদার টাকায়।
এখন ব্যবসায়ীরা আর টাকা দিয়ে রাজনীতিবিদ না পুষে নিজেরা সরাসরি রাজনীতিতে নামছেন। পেশাদার রাজনীতিকের সংখ্যা কমছে, বাড়ছে ব্যবসায়ী রাজনীতিকের সংখ্যা। কিছুসংখ্যক রাজনীতিবিদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফলে রাজনীতি সম্পর্কেই মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে। অথচ মানুষের মধ্যে আস্থার মনোভাব তৈরির জন্য কোনো উদ্যোগ রাজনীতিবিদদের নেই। ভালো হওয়ার প্রতিযোগিতা কারও মধ্যে নেই, খারাপ হওয়ার প্রতিযোগিতা আছে প্রবলভাবে।
দেশের মানুষের কাছে শ্রদ্ধা-সম্মান পাওয়ার জন্য রাজনীতিবিদদের কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকতেই রাজনীতিবিদরা আজকাল বেশি পছন্দ করেন। তারা বিতর্কে থাকতে চান, প্রচারে থাকতে চান, কারণ প্রচারেই যে প্রসার! রাজনীতিবিদদের পরস্পরের প্রতি চরম সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেশের রাজনীতিকে ক্রমাগত অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কেবল প্রতিপক্ষের প্রতি বিদ্বেষ বা বিরূপতা নয়, একদলে থেকেও সদ্ভাব-সদাচার রক্ষা করতে পারেন না অনেকেই। ফলে দলের মধ্যে দলাদলি, কোন্দল, রেষারেষি এখন চরমে। ঐক্য নয় বিভেদ, মিত্রতা নয় তিক্ততা– এটাই যেন রাজনীতির মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
অস্থিতিশীলতা তৈরি করাই যেন এখনকার রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। একদল ক্ষমতায় থাকার জন্য মরিয়া, অন্যদল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। ক্ষমতায় থাকার জন্য এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নীতিহীনতার প্রতিযোগিতা বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতায় থাকার জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলায় রাষ্ট্রযন্ত্রের যাবতীয় শক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার যেমন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আন্দোলনের নামে হরতাল-জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে জান-মালের ক্ষতিসাধন করাও স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
চলতি রাজনীতির ধারায় দুটি দল একে অপরের প্রতিপক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া হচ্ছে যে ‘এ’ না হলে ‘বি’ অবশ্যই ভোটে জিতবে। মানুষের সামনে আর কোনো ভালো বিকল্প না থাকায় এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার রাজনীতি প্রবল হয়ে উঠেছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখকষ্ট লাঘব করা কিংবা সুশাসন নিশ্চিত করা এখন আর বড় কথা নয়। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, শক্তি প্রদর্শনই এখন রাজনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।
আমাদের দেশের প্রকৃত উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির ধারা অব্যাহত ও বেগবান করতে হলে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রয়োজন বলে অনেকেই মনে করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, বিপরীত ধারার দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোনো ধরনের সমঝোতা কি আদৌ সম্ভব? কেউ হয়তো বলবেন, এই দুই দলের মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য এখন এতই কমে এসেছে যে, স্থায়ী না হলেও ইস্যুভিত্তিক সমঝোতা না হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
অথচ যুক্তিহীনতাই যে এখন রাজনীতিকে বেশি প্রভাবিত করছে– তার কী হবে? একদল বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, অন্যদল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসী বলে এতদিন যে পার্থক্যরেখা টানা হতো, এখন আর তা টানা খুব সহজ নয়। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীরা যদি বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামি ভাবধারার মিশেলে বিশ্বাসী হয়, তাহলে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরাও এখন ইসলামি ভাবধারা থেকে খুব দূরে অবস্থান করছে কি? দুই দলের পার্থক্যটা তাহলে কোথায়? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমানের অবস্থান, সম্মান ও মর্যাদাই কি এখন দুই দলের বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু?
যদি তাই হয় তাহলে প্রয়াত দুই নেতাকে এক কাতারে না নামিয়ে, দুই জনের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানকে স্বীকার করে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে এবং মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার অবদানের কথা বিনা বিতর্কে মেনে নিলেই তো এই দুই দলের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য হলেও রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণে এই সমঝোতা অসম্ভব বলে মনে না হলেও বাস্তবতা যে ভিন্ন সেটাও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বিতর্কও আমাদের দেশের বিভাজনের রাজনীতির একটি বড় কারণ। আমাদের গৌরব উজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের যারা বিরোধিতা করেছিল তাদের চলমান রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে এবং তাদের রাজনৈতিক অধিকার থাকা উচিত কি উচিত না– সে দ্বন্দ্বেরও আমরা নিরসন করতে পারিনি। সমঝোতার রাজনীতি বাস্তবায়ন সহজ হবে না যত দিন না আমরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে সমাজ, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিতে না পারি।
আমরা মুখে বলি দেশের ভেতর রাজনৈতিক অস্থিরতা চাই না, সংঘাতের রাজনীতি চাই না। বাস্তবে এই অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদেরই আমরা উৎসাহ দেই, মদদ দেই জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে বলেই দেশের প্রতি বিদেশিদেরও নজর পড়ছে। বাংলাদেশ অনেকের কাছে এখন উন্নয়নের রোল মডেল। ভূরাজনৈতিকভাবেও বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ। তবে সরকারের পতন ঘটিয়ে অস্থিরতা তৈরির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে কেউ গুটি চালছে কি না, সে বিষয়ে রাজনীতি সচেতন সবারই লক্ষ্য রাখাদরকার। ভালোর জন্য পরিবর্তন ঘটিয়ে আরও খারাপ অবস্থায় পড়ার অতীত অভিজ্ঞতা কি আমাদের নেই?
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের নজরদারি যেভাবে বাড়ছে, সেটা কি আমার ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য কোনো ভালো বার্তা দিচ্ছে? তাছাড়া যারা আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে গণতন্ত্রের মশালবাহী হিসেবে বিএনপিকে বাহবা দিচ্ছেন, তারা কি বিএনপির অতীত একেবারেই ভুলে গেছেন? গরম কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় আরাম খোঁজার রাজনীতির শেষ কোথায়?