‘আওয়ামী লীগের ভোট চুরি করা লাগে না’

১৫৩ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া নিঃসন্দেহ কোনো ভালো দৃষ্টান্ত নয়। তবে আওয়ামী লীগকে এই সুযোগ করে দিয়েছিল বিএনপি ও ভোট বর্জনকারী দলগুলোই। সব দল অংশ নিলে আওয়ামী লীগ মাঠ ফাঁকা পেত না।

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 30 June 2023, 11:46 AM
Updated : 30 June 2023, 11:46 AM

শিরোনামের কথাগুলো বলেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি এক দলীয় সভায় বর্তমান সরকারের অধীনে বিভিন্ন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, “যেসব দেশ আমাদের নির্বাচনের দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তাদেরও বলব, আমাদের যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা আমাদের যে উপনির্বাচনগুলো হলো, সেই নির্বাচনগুলো দেখেন, কীভাবে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে। এরপর আবার কেন প্রশ্ন ওঠে?”

শেখ হাসিনা বলেন, “বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমরা জয়লাভ করেছি। কক্সবাজার মেয়র নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচন...এই নির্বাচন নিয়ে কেউ কোনো কথা, কোনো অভিযোগ করতে পারবে না। আজ যারা নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাদের বলব, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচন যাতে স্বচ্ছ হয়, নির্বাচনে মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে, সেই ব্যবস্থা যে আমরা করতে পারি, সেটা কিন্তু আমরা প্রমাণ করেছি। কাজেই এটা নিয়ে আর কারো কোনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই।”

শেখ হাসিনা বলেছেন, “আওয়ামী লীগের ভোট চুরি করা লাগে না। আওয়ামী লীগ এমনি ভোট পায়। যখনই মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে।”

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার উপরের কথাগুলো অসত্য নয়, আবার পুরোপুরি হয়তো সত্যও নয়। এটা ঠিক, সামরিক শাসক জিয়া, এরশাদ ভোট নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছিল, তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ অন্য মিত্রদের নিয়ে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করেছে। ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ এই স্লোগান নিয়ে আন্দোলনে শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দিয়েছেন। এটাও ঠিক যে, জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদ যেভাবে ভোট ছাড়া ক্ষমতা দখল করেছিলেন, আওয়ামী লীগ কখনো সেভাবে বিনা ভোটে ক্ষমতায় আসেনি। 

২০১৪ ও ২০১৮ সালেও কিন্তু আওয়ামী লীগ বিনা ভোটে ক্ষমতায় বসেনি। নির্বাচন হয়েছে, নির্বাচনে বিজয়ী হয়েই শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেছেন, দেশ শাসন করছেন। তবে ওই দুটি নির্বাচনের বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। আরও অনেকগুলো দল নির্বাচন থেকে বাইরে ছিল। কিছু মিত্র দলকে নিয়ে অনেকটা ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ১৫৩ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া নিঃসন্দেহ কোনো ভালো দৃষ্টান্ত নয়। তবে আওয়ামী লীগকে এই সুযোগ করে দিয়েছিল বিএনপি ও ভোট বর্জনকারী দলগুলোই। সব দল অংশ নিলে আওয়ামী লীগ মাঠ ফাঁকা পেত না। তাছাড়া ভোট প্রতিহত করার জন্য সহিংস আন্দোলন করেও ভোট বন্ধ করতে পারেনি বিএনপি-জামায়াত। আওয়ামী লীগ সংবিধান মেনে নির্বাচন করেছে। মানুষও নিজেরা ভোট দেওয়ার সুযোগ বঞ্চিত হলেও ওই সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরকার পতনের আন্দোলনে শামিল হয়নি। সরকার মেয়াদপূর্তির পর নতুন নির্বাচন দিয়েছে। 

২০১৮ সালের নির্বাচনে নানা নাটকীয়তার পর বিএনপি অংশ নিয়েছে মিত্রদের নিয়ে। বলা হয়েছে, অনেক আসনে প্রকৃত ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি। আগের রাতেই ভোটের বাক্স ভরা হয়েছিল। এই যে এতবড় একটি কারচুপি হলো, তার বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ হলো না কেন? মানুষ কেন এটা মেনে নিল? এমনকি বিএনপির নির্বাচিত কয়জন সংসদ সদস্যও শপথ নিয়ে সংসদে গেলেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে একটি একতরফা নির্বাচন করে বিএনপি কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। মাত্র তিন মাসের মধ্যে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। এ থেকে যদি এমন ব্যাখ্যা হাজির করা হয় যে, বিএনপির ভোট কারচুপি মানুষ মেনে নেয় না। আওয়ামী লীগের ভোট কারচুপির প্রতি জনগণের মৌন সমর্থন থাকে। তাহলে কি বলা হবে? ২০১৮ সালে সব মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে না পারলেও মোটা দাগে তারা শেখ হাসিনাকেই ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে বলেই ওই বিতর্কিত নির্বাচন নিয়েও সরকারবিরোধিতায় সোচ্চার হয়ে ওঠেনি।

এখন সামনে এসেছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি। আর মাস পাঁচেকের মধ্যেই এই নির্বাচন হবে। আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হলে তাতে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। আর সরকার বলছে, নির্বাচন হবে সংবিধানের নিয়ম মেনেই। 

সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতার নিরিখ মানুষ ভোট দিয়ে হয় পুরনো সরকারের প্রতি সমর্থন জানায় নতুবা নতুন কাউকে সরকার গঠনের জন্য নির্বাচিত করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় আছে। দলটি আরও এক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চায়। আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু ভোটে আর ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না বলে অনেকে মনে করলেও বিপরীতটা মনে করার মতো মানুষও দেশে কম নেই। আওয়ামী লীগের ওপর থেকে মানুষের সমর্থন একেবারে উঠে গেলে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা নির্বাচনে দলের প্রার্থীরা জয়লাভ করতে পারতেন না, এমনকি ভোটার উপস্থিতিও এত হতো না। নানা কারণে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমেছে ঠিকই কিন্তু শেখ হাসিনার চেয়ে উত্তম শাসন উপহার দেওয়ার মতো রাজনৈতিক নেতা মানুষের সামনে নেই। অন্যদিকে, করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধে সৃষ্ট নেতিবাচক পরিস্থিতি থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা এবং তাদের জীবন-জীবিকার পাশাপাশি স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতির চাকা সচল রাখার বিষয়টিতে অনেকটাই সফল টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। টানা সাড়ে ১৪ বছরে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে বিস্ময়কর সাফল্যও রয়েছে এই সরকারের।

কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে সৃষ্ট নানা সংকট ভোগাচ্ছে দেশের মানুষকে। বিশ্বে করোনা ও যুদ্ধের প্রভাবে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে চরম সংকটে সবাই। বেড়েছে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতিও। যদিও এত কিছুর পরও দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ ভাগে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। তারপরও মানুষকে এই সংকট মোকাবিলায় অনেকটা হিমশিম খেতে হচ্ছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না।

বলছেন, এসব সংকটের মধ্যেই আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে আরেকটি সংকট সৃষ্টির চেষ্টা চলছে নানা মহল থেকে। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, ততই নানাবিধ কলাকৌশলের প্রয়োগ শুরু হয়েছে দেশি-বিদেশি নানা মহল থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি এবং বিশ্বের প্রভাবশালী সংস্থা ও ব্যক্তিদের বক্তৃতা-বিবৃতি সবকিছুতেই আগামী জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার ‘তাগিদ’ দেওয়া হচ্ছে।

সরকার এসব বিষয়ে সচেতন আছে বলেই মনে হয়। আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু হবে বলেই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও বার বারই নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে। বিএনপি বলছে, সরকারের কথায় তাদের আস্থা নেই। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব না। তাই আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের কথা বলছে দলটি। জুলাই মাস থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসপার-ওসপার করার আশা করছে বিএনপি। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপির আন্দোলন সফল হবে না। বিএনপি যেমন মিত্রদের নিয়ে নানা রকম ছক কষছে, সরকারেরও তো আছে পালটা প্রস্তুতি। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল ও বিচক্ষণতার সঙ্গে বিএনপি অতীতে একবারও সফল হওয়ার নজির দেখাতে পারবে না। দেশের মানুষের মনে যত অসন্তুষ্টিই থাক না কেন, শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে অলআউট আন্দোলনে যাবে বলে মনে না হওয়ার একাধিক কারণ রয়েছে।

মানুষের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। ক্ষমতার অনেক পরিবর্তন মানুষ দেখেছে। নির্বাচিত রাজনৈতিক কিংবা অনির্বাচিত সরকারের শাসনের অভিজ্ঞতা মানুষের আছে। কোনো শাসনেই সাধারণ মানুষ শেখ হাসিনার সরকারের চেয়ে ভালো ছিল না। শেখ হাসিনার শাসনামলে ধনবৈষম্য বেড়েছে, আবার একেবারে ভূমিহীন লাখ লাখ মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁইও পেয়েছে। কোন আমলে দুর্নীতি হয়নি, পুঁজি পাচার হয়নি? কিন্তু শেখ হাসিনার আমলে গরিব মানুষের জন্য সাহায্য-সহযোগিতাও তো বেড়েছে। বিনামূল্যে বই দেওয়াসহ সামাজিক সুরক্ষা বলয় তৈরি করা হয়েছে। মানুষ সরকার পতনের আন্দোলনে যাওয়ার আগে এসব হিসাবনিকাশ একেবারেই করবে না, সেটা কি হবে? বিএনপি যেমন মিত্র বাড়াতে চাইবে, আওয়ামী লীগও তো তা চাইবে। দরকষাকষির ক্ষমতা কি আওয়ামী লীগের বেশি না বিএনপির? নির্বাচনে টাকা এখন একটি বড় ফ্যাক্টর। টাকা কার বেশি, আওয়ামী লীগের, না বিএনপির? 

সব থেকে বড় প্রশ্ন, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন কি আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? আমেরিকা বা তার মিত্রদের ওপর বিএনপির অতি নির্ভরতা দলটির এক বড় দুর্বলতা। বাইডেনের সঙ্গে মোদীর বাংলাদেশ নিয়ে কী কথা হয়েছে কিংবা হয়নি, সেটা নিয়ে অতি কৌতূহলী না হয়ে সাধারণভাবে এটা ভাবা দরকার, ভারতের জন্য শেখ হাসিনার সরকারের চেয়ে বড় বন্ধু হওয়ার দল কি বিএনপি-জামায়াত? আমেরিকা মুখে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও দেশে দেশে তাদের অতীত রেকর্ড কি খুব আশাবাদী হওয়ার মতো? 

সরকার পতনের স্বপ্নে মশগুল না হয়ে বিএনপি যদি আওয়ামী লীগের সামনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় এবং তারা ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের থেকে ভালো শাসন কীভাবে উপহার দেবে, তার একটি বিশ্বাসযোগ্য রূপরেখা উপস্থিত করে, সেটাই হবে উত্তম। বিএনপির নতুন মিত্র গণ অধিকার পরিষদের ড. রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হকে নুর একে অপরের বিরুদ্ধে বিদেশি এজেন্ট হওয়ার যে অভিযোগ এনেছেন, তা-ও কিন্তু বিএনপি শিবিরের ঘর নড়বড় অবস্থারই আভাস দেয়। জামায়াতে ইসলামীও কি আর বিএনপির জন্য জানবাজি রাখবে? ইসলামি দলগুলো আলাদা মোর্চা গঠন করলে সুবিধা কি বিএনপির হবে? 

ভোটারদের প্রতি আস্থা থাকলে ভোটের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, যেটা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালে। ভোট রুখে দেওয়ার আন্দোলন সফল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।