বিএনপি অফিসে খিচুড়ি জব্দ

বিএনপির সমাবেশ, সমাবেশের স্থান নিয়ে বিরোধ, সম্ভাব্য সংঘাতের আশঙ্কাকে ছাপিয়ে আলোচিত হয়ে উঠেছে খিচুড়ি। সত্যি, এই বিপুল পরিমাণ খিচুড়ির কি হলো?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 9 Dec 2022, 06:56 AM
Updated : 9 Dec 2022, 06:56 AM

১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সমবেত হয়েছিলেন বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী। তাদের আপ্যায়নের জন্য দলটির পক্ষ থেকে রান্না করা হয়েছিল কয়েক পাতিল খিচুড়ি। কিন্তু গত বুধবার দুপুরের দিকে পুলিশের অভিযানের কারণে তাদের ভাগ্যে জোটেনি সেই খিচুড়ি।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, বুধবার রাত ৭টায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নয়াপল্টন কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলায় বড় বড় কয়েকটি পাতিলে রান্না করা খিচুড়ি পড়ে রয়েছে। পাশের টেবিলে খিচুড়ি ভর্তি কয়েকটি বাক্সও পড়ে আছে। একটু সামনের যেতেই দেখা যায়, বিএনপি কার্যালয়ের নিচতলায় আটটি বড় পাতিলে রান্না করা খিচুড়ি পড়ে আছে। সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে আরও ১০ থেকে ১২টি বড় পাতিল, সেগুলোতে খিচুড়ি রান্না করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। এ খিচুড়ি রান্না করা হয়েছিল কার্যালয়ে আসা নেতাকর্মীদের জন্য। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে ওই আয়োজনটি ভেস্তে যায়। 

দায়িত্বরত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা এ সময় সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, দেখেন দেখেন সমাবেশ নেই, কিছু নেই তারপরও নেতাকর্মীরা জমায়েত হয়েছেন আবার এখানে রান্না-বান্না করেছেন। এখন পাতিলের পর পাতিল ভর্তি খিচুড়ি পড়ে আছে। 

রাত সাড়ে ৭টার দিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে আনিসুজ্জমান নামে ৭০ বছর বয়সী এক কর্মীকে যখন পুলিশ প্রিজন ভ্যানে নিয়ে যাচ্ছিল তখন মির্জা ফখরুল বলেন, আপনার এই বৃদ্ধ মানুষটাকে নিয়েন না। তার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ আনিসুজ্জমানকে ছেড়ে দেয়।

পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আনিসুজ্জামান বলেন, সমাবেশের জন্য আজ আমি কার্যালয়ে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম অন্যান্য সমাবেশের মতো এখানেও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু দুপুরের দিকে গণ্ডগোল লেগে যায়। তারপরে রান্না করা খিচুড়ি আর খাওয়ার সুযোগ হয়নি কারও। 

এদিকে পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিএনপির কার্যালয় থেকে নগদ ২ লাখ টাকা, ১৬০ বস্তা চাল, পৌনে দুই লাখ পানির বোতল, চালসহ রান্নার উপকরণ উদ্ধার করেছে। এছাড়া অবিস্ফোরিত ১৫টি বোমাও নাকি পাওয়া গেছে।

বিএনপি কার্যালয় থেকে চাল, ডালসহ রান্নার উপকরণ ও রান্না করা খিচুড়ি উদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, “চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি খেয়ে সরকার হটানো যাবে না।”

ওদিকে রাজধানীর নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, “সেখানে ২ লাখ বোতল পানি, ২৮০ বস্তা চাল, কত কিছু নিয়ে গেছে। যাতে দিনের পর দিন সেখানে থাকবে, খিচুড়ি পাক হবে এবং দেশ পাল্টে দেবে। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা আবার ক্ষমতা নেবে, এ ধরনের স্বপ্ন তাদের ছিল।”

বিএনপির সমাবেশ, সমাবেশের স্থান নিয়ে বিরোধ, সম্ভাব্য সংঘাতের আশঙ্কাকে ছাপিয়ে আলোচিত হয়ে উঠেছে খিচুড়ি। সত্যি, এই বিপুল পরিমাণ খিচুড়ির কি হলো? এগুলো কি পুলিশ খেয়ে ফেলেছে? গরিব মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে? নাকি টাকা-চাল-ডালের মতো এগুলোও জব্দ করে রাখা হয়েছে? এই খিচুড়িগুলোর পরিণতি নিয়ে অনেকেই কৌতূহল প্রকাশ করেছেন। আগ্রহ দেখিয়েছেন।

আহা খিচুড়ি! খিচুড়ির কথা শুনলেই আমাদের দেশের অনেকের মনের মধ্যে এক ধরনের উথাল-পাথাল ঢেউ শুরু হয়ে যায়। রসনা-বিলাসী অনেক বাঙালির অন্যতম প্রিয় খাবার খিচুড়ি। সস্তায় পুষ্টিকর আর সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে এর জুড়ি মেলা ভার। একটা পূর্ণ প্লেট খিচুড়িতে আছে প্রায় ১১৭ ক্যালোরি তার মধ্যে ৩২.৩ গ্রাম শর্করা, ৮.৪ গ্রাম প্রোটিন আর চর্বির মাত্রা সামান্য ১.৫ গ্রাম। এর সঙ্গে আছে ফাইবার, ক্যালশিয়াম, আয়রন, ভিটামিন সি।

চতুর্দশ শতাব্দীতে মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন। ইবনে বতুতা তার ভ্রমণ কাহিনির বর্ণনায় লেখেন– ডাল ও ভাত রান্না করে সেই খাবার মাখন দিয়ে পরিবেশন করা হয়। এই খাবারের নাম খিচুড়ি আর এই খিচুড়ি দিয়ে ভারতীয়রা প্রতিদিন তাদের সকালের নাস্তা করার কাজটি সম্পন্ন করে থাকেন। খিচুড়ি নিয়ে অনেক সংস্কার ও মিথ আছে। গ্রামীণ বাংলায় ‘খিচুড়ি’ শব্দটা নাকি অযাত্রা! তাই সাতসকালে, যাত্রাকালে এই নামটি বলতে নেই! যার এত সুখ্যাতি তার এই বদনাম! শুধু তাই নয় গোলমেলে, ভজকট ব্যাপার হলে সেটা নাকি ‘জগাখিচুড়ি’!

উত্তর ভারতে আবার পেট খারাপের মোক্ষম পথ্য নাকি কলাইয়ের ডালের খিচুড়ি। খিচুড়ির এমনই কপাল সুকুমার রায়ের বিখ্যাত কবিতা ‘হাঁস ছিল, সজারু (ব্যাকরণ মানি না)’-এর শিরোনাম ‘খিচুড়ি’!

গবেষকদের তথ্য মতে, মোগল বাদশাহরাও খিচুড়ির প্রেমে পাগল ছিলেন। সম্রাট আকবর সাত রকমের খিচুড়ি পছন্দ করতেন। গুলবদন বেগমের ‘হুমায়ুননামা’-তেও স্থান পেয়েছে খিচুড়ির কথা। জাহাঙ্গীরের ‘লাজেজান’, শাহজাহানের ‘নওরতন’, আওরঙ্গজেবের ‘আলমগিরি খিচুড়ি’ মোগল খানদানে মাইলস্টোন হয়ে আছে। ইংরেজের হাত ধরে খিচুড়ির অনুপ্রবেশ ঘটেছে খোদ ইংল্যান্ডেও!

বাঙালির সাধের খিচুড়ি কিন্তু বর্ষার সঙ্গেও জুড়ে আছে। বৃষ্টি হলে আমাদের খিচুড়ি চাই-ই। হিন্দুদের মধ্যে আবার খিচুড়ির বৈষ্ণব, শাক্তের ভাগ আছে। সাধারণ ঘি, ডাল, চাল সহযোগে রান্নাটি বৈষ্ণবপন্থী। আর খিচুড়িতে পেঁয়াজ, রসুন, মাছ ছুঁইয়ে নিবেদন করা হয় শাক্তপুজোয়। খিচুড়ি যে কত রকমের হয় তার হিসেব কে রাখে! সবজি, ভুনা, ভুজিয়া, সাবু, ভুট্টা, নবরত্ন বিভিন্ন প্রকারের ডাল, মাছ, মাংস, ডিম আরও কত কী!

লখনৌ নবাবিয়ানায় খিচুড়ি নিয়ে বহু কাণ্ড হয়েছে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়ে নবাব আসফউদ্দৌলা। সেকালের মস্ত এক প্রবাদ ঘিরে আছে এই মানুষটিকে কেন্দ্র করে– ‘যো না দেতা মওলা/উও দেতা আসফউদ্দৌলা।’ ঈশ্বর যা দিতে পারে না, এই মানুষটি তাই দেন। তার খানা কিস্যার কথা লিখে গেছেন আবদুল হামিদ শরর। আসফউদ্দৌলা মাংসের কিমা দিয়ে ‘শাহি খিচড়ি’র প্রচলন করেছিলেন। জাফরান, পেস্তা, আখরোট সহযোগে খিচুড়িও রান্নাঘরে ঢুকিয়েছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিচারণ। স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরে এসে তারা তিনভাই পাঁঠার মগজ দিয়ে খিচুড়ি খেতেন। একে খিচুড়ি তায় পাঁঠার মাথার ঘিলু– ধন্য হজমশক্তি!

খিচুড়ি নামের এই খাবারটা খাওয়ার আদর্শ সময় আসলে দুটো– শীত আর বর্ষা। তবে শীত এক নম্বর আদর্শকাল আর বর্ষা দুই নম্বর আদর্শকাল।

পশ্চিমা দেশে ‘কেজেরি’ (kedgeree) নামে যে জিনিসটা হোটেল-রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায়, তা আদতে আমাদেরই খিচুড়ি। ‘ঠাকুর’ যেমন করে ‘টেগোর’, ‘দত্ত’ যেমন করে ‘ডাট’ হয়েছিল, সেই একই কায়দায় ভিক্টোরিয় যুগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ অফিসারদের হাত ধরে খিচুড়ি ইংল্যান্ডে পৌঁছে বিলাতি উচ্চারণে ‘কেজেরি’ হয়ে গেছে।

তবে খিচুড়ি এখনও সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় খাবার। খিচুড়ি রান্না করা সহজ বলে এটা অলস মানুষেরও প্রিয় খাবার। খিচুড়ি নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনিও প্রচলিত আছে।

জোধপুরের প্রতিষ্ঠাতা রাও জোধাকে মেওয়ারের রানা কুম্ভ চিতোর থেকে উৎখাত করেন। সব হারিয়ে রাও জোধা পথে পথে ঘুরছেন আর চিতোর উদ্ধারের চেষ্টা করছেন এবং বার বার বিফল হচ্ছেন। শোনা যায় এক বাটি খিচুড়ি থেকে শিক্ষা পেয়ে তিনি সফল হন।

একবার তিনি এক জাট চাষার ঘরে ক্ষুধায় কাতর হয়ে আশ্রয় নেন। চাষীর বউ রাও জোধাকে চিনতে পারেননি। তিনি তাকে একজন সাধারণ দরিদ্র ক্ষুধার্ত মানুষ মনে করে তার খাওয়ার জন্য এক বাটি খিচুড়ি দেন। রাজা কখনও খিচুড়ি খাননি। না বুঝে খিচুড়ির মাঝে আঙ্গুল ডুবিয়ে খেতে গিয়ে আঙ্গুল পুড়িয়ে ফেলেন। তখনই চাষীর বউ বলে ওঠেন, “তুমি তো দেখছি আমাদের রাজা জোধা রাওয়ের মতো ভুল করো। উনি যেরকম মাঝ দুর্গে আঘাত করে করে পরাজিত হয়, তুমিও তেমনই খিচুড়ির মাঝে আঙ্গুল দিয়ে আঙ্গুল পুড়িয়ে ফেলেছ। খিচুড়ি খেতে হয় কিনার দিয়ে। খিচুড়ির মাঝে গরম ও চারপাশ ঠাণ্ডা।”

এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে জোধা রাও এরপর আর চিতোরের মাঝে আক্রমণ না করে, সীমান্ত অঞ্চলে আক্রমণ করে করে, পনেরো বছর পর আবার চিতোর উদ্ধার করেন।

খিচুড়ি নিয়ে অনেক ইতিহাস আছে, আছে অনেক গল্প। যতদিন বাঙালি সংস্কৃতি থাকবে, ততদিন খিচুড়ি বেঁচে থাকবে। খিচুড়ি বেঁচে থাকুক চিরকাল।

পুনশ্চ: সরকার বিএনপির প্রতি এতটা নির্দয় না হলেও পারত! যে নেতাকর্মীদের জন্য খিচুড়ি রান্না করা হলো, যারা পেট ভরে খিচুড়ি খাবেন বলে অপেক্ষার প্রহর গুণছিল, কিন্তু বেরসিক পুলিশের হস্তক্ষেপের কারণে তাদের খিচুড়ি খাওয়া হলো না। এটা রীতিমতো মানবাধিকার লঙ্ঘন। এই ক্ষতি ও ক্ষতের উপশম কি আদৌ সম্ভব?