শিক্ষাঙ্গনে দস্যুতা

আমাদের শিক্ষাঙ্গনে এখন আর শিক্ষা আছে বলে মনে হয় না। এক পাল দুর্বৃত্তকবলিত স্বেচ্ছাচারীদের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 29 Sept 2022, 03:25 PM
Updated : 29 Sept 2022, 03:25 PM

সুখবরহীন ছাত্ররাজনীতিতে ছাত্রলীগ প্রায়ই অঘটন ঘটিয়ে খবরের শিরোনাম হচ্ছে। এবার তারা রাজধানীর ইডেন কলেজে মারামারি করে, সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন বিরোধীদের পেটাবে, এটাই ‘স্বাভাবিক’ খবর বাংলাদেশে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করে, সন্ত্রাস-দস্যুতা আর দখলদারিত্ব কায়েম করার এই ধারা এখন ভীতিকর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ছাত্রলীগ ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। ইডেন কলেজে গভীর রাতে যেভাবে এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, মেরে-পিটিয়ে তক্তা বানানোর চেষ্টা করেছে, তা রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো।

প্রশ্ন হলো ছাত্র রাজনীতির নামে যারা যারা শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করছে, শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত করছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা বা প্রশাসন কেন তাদের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছে না? কেন তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। শিক্ষার্থীরা একজন আরেকজনকে মারবে পিটিয়ে রক্তাক্ত করবে, গভীর রাতে হল থেকে বের করে দিয়ে হলের গেট লাগিয়ে দেবে, আর প্রশাসন নির্বিকার থাকবে– এটাই কি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার নমুনা?

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসের সচিত্র বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে প্রতিটি গণমাধ্যমে। অথচ কলেজ প্রশাসন এখনও টুঁ শব্দটি করছেন না। যেন কিছুই হয়নি। হল সুপার, কলেজ অধ্যক্ষ কোথায় রয়েছেন? নাকি ঘটনায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়িত বলেই তারা মুখে তালা দিয়েছেন? এত ভয় নিয়ে তারা কীভাবে দায়িত্বশীল পদে রয়েছেন? এবার যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে ‘বাম-সন্ত্রাসী’ কিংবা ‘ছাত্রদল-শিবিরের গুণ্ডা’-দের ওপর দায় চাপানোরও কোনো সুযোগ নেই।

ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ক্ষমাহীন উচ্ছৃঙ্খলতার পর কলেজে সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। ১০ জন সহ-সভাপতিসহ ১৬ জন নেতাকর্মীকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু এটুকুই কি যথেষ্ট? যারা রুম ভাঙচুর করেছে, সন্ত্রাস করেছে, রাতের অন্ধকারে প্রতিপক্ষকে হল থেকে বের করে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হবে না? ইডেন কলেজে যা হয়েছে, তা রীতিমতো ফৌজদারি অপরাধ। কোনো শিক্ষার্থী এমন অপকর্মে লিপ্ত হতে পারে না। তারা কোনোভাবেই ছাড় পেতে পারে না। দস্যুতাকে প্রশ্রয় দিলে শিক্ষাঙ্গন আর শিক্ষাঙ্গন থাকে না, তা ক্রিমিনালদের আখড়ায় পরিণত হয়। ইডেনের মতো ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমনটি হতে দেওয়া যায় না।

যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল তখন ইডেন কলেজে ছিল ছাত্রদলের দাপট। আর গত এক যুগ ধরে চলছে ছাত্রলীগের একাধিপত্য। আমাদের দেশে সরকার-সমর্থিত ছাত্রসংগঠন মার দেবে, অন্যরা মার খাবে-এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি দলের মার-দাতারা তাঁদের ‘বীরত্বের’ জন্য প্রায়ই পুরস্কৃত হন। অন্যদিকে বিরোধী দলের ‘মার-খাওয়ারা’ সংগ্রামী ও ত্যাগী ভাবমূর্তি গড়ে তুলে অপেক্ষায় থাকেন, কখন দল ক্ষমতাসীন হবে এবং তাদের মার-খাওয়ার বিনিয়োগের লাভ জুটবে। বলা বাহুল্য, এসব ঘটনার অধিকাংশই বিচারহীন থেকে যায়। সমস্যাটা তাই কেবল ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের মধ্যে নয়, সমস্যাটা ক্ষমতার চরিত্রের মধ্যে।

আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা বাজাতে বৃহৎ ছাত্র সংগঠনগুলো অপরিমেয় ভূমিকা পালন করছে।

আমাদের দেশে যখন যে দল ক্ষমতাসীন হয়, তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, শাখা-প্রশাখার বিস্ফোরণ ঘটে। বিচিত্র নামে ও রূপে তাদের অসুরিক আবির্ভাব লক্ষ করা যায়। সবচেয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে শিক্ষাঙ্গনে। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন পুরোপুরি ‘ন্যাটো-বাহিনী’ হিসেবে আবির্ভুত হয়। নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে প্রতিপক্ষ কিংবা তাদের ‘বশ্যতা স্বীকারে অনিচ্ছুক’ সকলকে উচিত শিক্ষা দিয়ে শিক্ষাঙ্গন থেকে ‘শিক্ষা’-কে মোটামুটি ঝেঁটিয়ে বিদায় করার আয়োজন চলতে থাকে। গত তিন দশকে বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল-শিবিরের বাড়াবাড়ি এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগের তাণ্ডব আমরা দেখে এসেছি।

প্রসঙ্গত, ইদানীং ছাত্রলীগের নেতৃত্বে যারা আসছেন, তাদের চরিত্র ও আচরণের মধ্যেই রয়েছে একটা দুর্বিনীতি উচ্ছৃঙ্খল মনোভাব। সম্প্রতি সংগঠনের এক নারীকর্মীর সঙ্গে রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাকিবুল ইসলাম রানার কথোপকথনের একটি অডিও নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ওই অডিওতে রানাকে বলতে শোনা যায় যে, ‘বহুত চিটারি-বাটপারি কইরি ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট হইসি, আমি চিটারের সর্দার।’ শুধু তাই নয়, ওই অডিওতে টাকা আর সহসভাপতি পদের লোভ দেখিয়ে একজন নারীকর্মীর সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্ক গড়ারও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। একটি জেলার সভাপতি কীভাবে এমন কথা বলেন? এই যদি হয় ছাত্রলীগের একটি জেলা কমিটির সভাপতির মনোভাব ও ভাষা, তাহলে এই সংগঠনে শুদ্ধি অভিযান চালানো হচ্ছে না কেন?

রাজনৈতিক দলগুলো যেন ইচ্ছে করেই দুর্বৃত্তদের নেতৃত্বে আনছেন, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। হ্যাঁ, আমাদের অর্থনীতিতে পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) তেমন সফল না হলেও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল অঙ্গসংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে এই কৌশলের সফল প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। প্রতিপক্ষ দমন, নিজেদের মধ্যে ‘বীরত্ব চর্চা’, নিজেদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা নিজেরা করা, অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসনকে ‘সহায়তা’ করা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করছে। তারা এখন দেশব্যাপী চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, হত্যা, দখলদারীসহ নানারকম বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। আর তাদের দোসর হিসেবে ভূমিকা পালন করছে প্রশাসন ও পুলিশ। সরকার, পুলিশ, প্রশাসন, সরকারি দল, ছাত্রলীগ– সব এখন মিলেমিশে একাকার!

এখন অনেক ছাত্রের মূল ধান্দা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের লাঠিয়াল বা ক্যাডার হওয়া। কারণ সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনে নাম লেখাতে পারলে তাদের কোনো অভাব থাকে না। যেভাবে খুশি টাকা উপার্জনের সুযোগ পাওয়া যায়। অস্ত্রবাজি, খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ডাকাতি করার লাইসেন্স পাওয়া যায়। এ দুর্বৃত্তরাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জিম্মি করে রাখছে আর প্রশাসনসহ অন্য সবাই তাদের দয়া বা মর্জির দিকে তাকিয়ে থাকছে। এটাই অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে।

সরকারি দলের অনুগত ক্যাডার বাহিনী শিক্ষাকে লাটে ওঠানোর চূড়ান্ত আয়োজনে ব্যস্ত। অথচ এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের তেমন কোনো ভাবনা-চিন্তা-অনুশোচনা নেই, নেই কোনো বিকার। দলের নেতানেত্রীরা বসে বসে যেন মজা দেখছেন। আর মাঝে মাঝে বায়বীয় হুঙ্কার ছাড়ছেন। কিন্তু এই গুণ্ডাদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয়ার ব্যাপারে কঠোর কোনো উদ্যোগ বা সংকল্প এখনো দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শিক্ষাকে ধ্বংস করে, শিক্ষাঙ্গনকে অচল করে কী দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা যায়? দেশ-জাতির কল্যাণ করা যায়? এটাই কি ‘উন্নয়নের রাজনীতি’র নমুনা?

সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে যারা আছেন, তারাও যেন ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারে পরিণত হয়েছেন। বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ, হলের পরিচালক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রক্টরের ভূমিকা দেখলে মনে হয়, তারা নিজেরাই বুঝি ছাত্রলীগের কর্মী। নির্লজ্জ দালালি করা ছাড়া তাদের কোনো নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। অল্পশিক্ষিত-অশিক্ষিত কিছু দুর্বৃত্তের পায়ের নিচে বসে, তাদের ইচ্ছের দাস হয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব নিতে এসব শ্রদ্ধেয় ‘শিক্ষাবিদ’ ও সম্মানিত ভিসিদের কোনো আপত্তি দেখা যায় না। এটাকে আমরা কী বলব, দায়িত্ব গ্রহণের, দায়িত্ব পালনের অসীম আগ্রহ? নাকি পদ ও ক্ষমতার প্রতি অসীম লোভ? দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা?

আমাদের শিক্ষাঙ্গনে এখন আর শিক্ষা আছে বলে মনে হয় না। এক পাল দুর্বৃত্তকবলিত স্বেচ্ছাচারীদের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। ‘ছাত্রছাত্রী’ নেই, আছে মেরুদণ্ডহীন কিছু জড়ের অস্তিত্ব। ‘শিক্ষক’ও নেই, লাজ-লজ্জা, আদর্শ, শক্তি-সাহসহীন ক্লীবদের অক্ষম পদচারণা আছে শুধু। তা না হলে প্রতিবাদ-প্রতিরোধহীনভাবে অপশক্তির দখলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চলে যাচ্ছে কীভাবে? এত ক্ষতি, এত ক্ষত, এত সমালোচনার পরও কেন শিক্ষাঙ্গন দখল করে রাখা গুণ্ডাদের দমন করা হচ্ছে না? তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না?

মাঝে মাঝে নিজের গালে নিজেই থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করে! কেনই বা আমরা খামোখা চিৎকার-চেঁচামেচি করছি? আপাতত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাত্রলীগ নামধারী গুণ্ডাদের জন্য অবাধ এবং উন্মুক্ত করে দেয়াই তো ভালো। ওরা লড়ুক। মরুক। ওরা শক্তি দিয়ে সবকিছু দখল করে নিক। বাকি সবাই পালিয়ে যাক, গুলি খেয়ে মরুক, জাহান্নামে যাক। সব কিছু ছারখার হোক। তাতে কার কী?

নিদান যেখানে অনুপস্থিত, প্রতিবিধানের সম্ভাবনা যেখানে তিরোহিত, সেখানে উপহাস কিংবা বিলাপ করা ছাড়া উপায় কী?