প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় ভারত নানাভাবে চীনের থেকে পিছিয়ে রয়েছে। কূটনৈতিক দিকের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিনিয়োগের দিক থেকেও ভারত পিছিয়ে।
Published : 29 Jan 2024, 05:49 PM
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। নির্বাচন পরবর্তীকালে দুই পক্ষকেই বেশ উচ্ছ্বসিত মনে হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম বিদেশ সফরও শুরু হচ্ছে ভারত থেকেই। এই সফরকে প্রাথমিকভাবে ধরা যায়, ভারতকে গুরুত্ব দেওয়ার ঢাকার নীতির অংশ হিসেবে।
দু-পক্ষের এক যুগেরও বেশি সময়ের সুসম্পর্কের মধ্যেও কিন্তু তিস্তা চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি। এই সুসম্পর্ক ধরে বাংলাদেশের জনগণের সবচেয়ে বেশি আশা ছিল তিস্তা চুক্তি নিয়ে। কিন্তু ওই আশা পূরণ হয়নি। এর মধ্যে আমাদের সরকারও তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে অনেকদূর এগিয়ে গেছে চীনের মাধ্যমে। চীনকে সঙ্গে নিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। গত অগাস্টে প্রধানমন্ত্রী রংপুর অঞ্চলের জনসাধারণের সামনে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন।
নির্বাচনের আগে গত ২১ ডিসেম্বর রাজধানীতে এক সেমিনারে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছিলেন, তার দেশ তিস্তা নদীর উন্নয়নে কাজ করতে আগ্রহী। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলেও আশা প্রকাশ করছিলেন তিনি। ২৮ জানুয়ারি এই বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন বলেছিলেন, চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র। তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশের উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের সঙ্গে কাজ নিয়ে প্রতিবেশী ভারত কোনো আপত্তি তুললে ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
এরই মধ্যে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ভারত সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চীন-ভারতের সম্পর্কের নতুন লড়াইও শুরু হতে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু করতে দেরি হওয়ার কারণ ভারতের বাগড়া। ভারত প্রকাশ্যে কোথাও কিছু বলেনি যদিও। সাধারণত এসব ব্যাপারে প্রকাশ্যে কিছু আসেও না। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে ঝুলে থাকা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিকল্প কোনো কিছু নয় এই তিস্তা মহাপরিকল্পনা। কিন্তু এরপরও নাকি আপত্তি আছে ভারতের। কারণ ভারতের শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে চীনের সহায়তায় তিস্তা প্রকল্পের কাজ ভারতের নিরাপত্তার জন্য নাকি হুমকি। ইউক্রেইনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার কথায় রাশিয়া যেভাবে নিরাপত্তা সীমানার হুমকির কথা বলে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিল অনেকটা ওই রকমই। নিরাপত্তার চেয়েও বড় কথা, চীনের সঙ্গে তিস্তা মহাপরিকল্পনার চুক্তি ভারতের জন্য খানিকটা অপমানজনক। যা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ঝুলিয়ে রাখার ফল। যেখানে ভারতের আন্তরিকতার অভাব ছিল। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সফরে যদি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি আলোর মুখ দেখে তবে সেটা বড় অর্জন হবে।
চীন আর ভারতের সমীকরণ মেলাতে শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় গড়ায় ওই আলোচনা দীর্ঘদিন ধরেই। ভূরাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের একটা মনস্তাত্ত্বিক লড়াই হবে ভারত ও চীনের সঙ্গে। এবারের আওয়ামী লীগ সরকার এই লড়াই মোকাবেলার কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়তে যাচ্ছে। শুধু লড়াই নয়, সারাবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন নতুন সমস্যা যেমন আসে তেমনি সমাধানের সফলতাও আসে। আমাদের নতুন সরকারের সামনে কিছু অমীমাংসিত দ্বিপাক্ষিক বিষয় আছে প্রতিবেশীদের সঙ্গে, সেগুলোও সমাধান হবে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ঝুলে আছে ২০১১ সাল থেকে। এই চুক্তি বাংলাদেশের জনগণের আর্থসামাজিক জীবনের বাইরে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানও নিয়ে আসবে। সরকারের সক্ষমতা প্রমাণের বিষয়ও আছে এর মধ্যে।
নির্বাচনের আগে তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার কথা জানিয়েছিল চীন। নির্বাচন শেষ হওয়ায় চীনের অপেক্ষাও শেষ। ঢাকাও চায় এদেশের জনগণের অপেক্ষার যেন শেষ হয়। কারণ তিস্তা মহাপরিকল্পনা উত্তরবঙ্গের ২ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে। যা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির চেয়ে কম কিছু নয়।
বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সঙ্কটও বেশ জটিল অবস্থায় ঝুলে আছে। যা সমাধানের চাবিকাঠি চীনের হাতে, এমনটাই বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে জটিল এই পরিস্থিতির অনুঘটকও চীন। এই চীনই বার বার রোহিঙ্গা সঙ্কটে সমাধানের কথা বলে হস্তক্ষেপ করলেও তা আবার ঝুলে পড়ে। এভাবে চলে আসছে বছরের পর বছর। চীনের সঙ্গে তিস্তা প্রকল্পের কাজটির মাধ্যমে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের আলোচনা নতুন মাত্রা পেতে পারে।
চীনের পক্ষে এই সুযোগ এসেছে ভারতের কারণেই। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় ভারত নানাভাবে চীনের থেকে পিছিয়ে রয়েছে। কূটনৈতিক দিকের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিনিয়োগের দিক থেকেও ভারত পিছিয়ে। মালদ্বীপ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, নেপাল সবার সঙ্গে সম্পর্কে চীনের চেয়ে পিছিয়ে ভারত। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আপাতত কিছুটা ভালো সম্পর্ক বজায় থাকলেও তা কতদিন ধরে রাখতে পারবে সেটা ভারতের ওপরই নির্ভর করছে। আর ভারতের চির বৈরি পাকিস্তান তো আছেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের প্রতিবেশী সব দেশের সঙ্গেই চীন এমন সম্পর্ক জড়িয়ে পড়ছে যা ভারতের অস্বস্তির কারণ।
বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যদিও ভারত-চীন উভয়েই আওয়ামী লীগের পক্ষে এক সুরে কথা বলেছে। অনেক চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনি বৈতরণী পাড়ি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের সঙ্গে দ্বন্দ্বের মীমাংসা আজ না হয়, কাল হবে। কিন্তু চীন ও ভারতের সঙ্গে মীমাংসা ভিন্ন বিষয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের টানা হুমকির মধ্যে তারা উভয়েই আওয়ামী লীগকে নির্বাচন সম্পন্ন করার সমর্থন যুগিয়ে গেছে। যাবতীয় পরিস্থিতি সামাল দিয়ে সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। এখন পশ্চিমাদের সঙ্গে মনমতো সম্পর্কও এগিয়ে নিতে হবে। কারণ, কাউকে কথা দিলে কথা রাখতে হয়। চাওয়া, চাহিদা ও স্বার্থের প্রতিশ্রুতি মেলাতে হয়।
বাস্তবতা হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সক্ষমতা বাড়লে বাইরের রাষ্ট্রগুলো তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত আবদার নিয়ে হাজির হবার সুযোগ পেত না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সক্ষমতার মাত্রা খুবই দুর্বল। ফলে বিদেশি নজরদারি-খবরদারি দিন দিন বাড়ছে। না হলে সমান সমান লাভালাভ ও খোলামেলা আলোচনায় সামিল হওয়া যেত। অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশের এমন প্রতিবেশী যার দুয়ারে হুট করেই দৌড়াতে হয় বাংলাদেশকে। যেন সুই হারিয়ে গেলেও প্রতিবেশীর দুয়ারে চাইতে যাওয়ার মতো। চাল-ডাল, মরিচ-পেঁয়াজ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য প্রায়ই এরকম পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় আমাদের। খাদ্যপণ্য আমদানির মতো বিষয়গুলোতে আরও বিকল্প রাখতে পারলে ভালো হতো। বাংলাদেশের স্বতন্ত্র অবস্থান ধরে রাখার জন্য ভারতের ওপর একতরফা নির্ভরতা কমানো দরকার।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছে ভারতের কাছ থেকে। বাংলাদেশের নির্বাচনে সমর্থন দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ নিয়ে সরাসরি কথা বলতে বাধ্য হয়েছে তারা। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরকারের জোরালো ভূমিকা বেশ কার্যকর হয়েছে। এরপরও নির্বাচন নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নেপথ্যের কথা আমরা জানি না। আর বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পন্ন হবার পর যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী তারা।
ভিসানীতি ও গণতন্ত্র ইস্যুতে অনেক বেশি কথাবার্তা হয়েছে— যা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে করতে পারেনি তেমনটা। সমালোচনা যাই হোক, নির্বাচনটা ভালোয় ভালোয় হয়েছে। সহিংসতা ও হানাহানি থেকে রক্ষা পেয়েছে দেশ। দেশের মানুষের কাছে গত সংসদ নির্বাচনের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য দিক সম্ভবত এটিই।
বাংলাদেশ যেহেতু সমঝে চলার নীতিতে বিশ্বাসী, সেক্ষেত্রে দুই কূলই রক্ষা করার কঠিন লড়াইয়ে নামতে হবে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কে কোণঠাসা ভারত বাংলাদেশ নিয়ে কী ভাবছে সেটা শুধু নির্বাচনি সমর্থন দিয়েই আঁচ করলে চলবে না। দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্টতাও দেখতে হবে। তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনের যেমন রাজনৈতিক স্বার্থ আছে তেমনি আছে ভারতেরও। ভারত তাদের দীর্ঘসূত্রতাকে গলদ হিসাবে না দেখে তিস্তা চুক্তি আরও ঝুলিয়ে দেয় কিনা সেটাই হচ্ছে দেখার বিষয়।