সারা দেশের মতো যশোরেরও অনেক এলাকায় ইতোমধ্যে গণহত্যার স্থান, বধ্যভূমি, গণকবর, নির্যাতন কেন্দ্রের জায়গা দখল করে বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। অনেক স্থান নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর চরম অবহেলায় অবজ্ঞায় পড়ে আছে।
Published : 26 Mar 2023, 01:31 PM
মুক্তিসংগ্রামের পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, অদ্ভুত এক ধোঁয়াশার মধ্যে আমাদের পথচলা। ‘একাত্তরের সংগ্রাম মুক্তির নাকি স্বাধীনতার’ কিংবা ‘এ যুদ্ধ সামরিক নাকি সর্বতোভাবেই জনযুদ্ধ?’ এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই আমাদের বেড়ে ওঠা। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন পেরিয়ে আজ অবধি চলছে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা আর গবেষণা কাজে সম্পৃক্ততা আমাকে বুঝিয়েছে— স্বাধীনতা ছিল আমাদের প্রথম পদক্ষেপ, মুক্তি চূড়ান্ত লক্ষ্য। সংগ্রাম ছিল মুক্তির। মুক্তিযুদ্ধ সর্বতোভাবেই এক জনযুদ্ধ। কিন্তু পুনরাবৃত্ত ইতিহাসের মতো একাত্তরের বিজয়গাথাও সাধারণের হাতছাড়া হয়ে গেছে। তাই খুঁজতে হবে জনইতিহাস। কিন্তু ইতিহাসের উপাত্ত ক্রমাগত দুর্লভ হয়ে পড়ছে।
মুক্তিসংগ্রামকে ধারণ ও লালনকারী একজন নবীন গবেষক হিসেবে যতই ইতিহাসের মর্মমূলে অনুসন্ধানকে ব্যাপৃত করেছি ততই একটি বিশ্বাস দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে— মানব সভ্যতার ইতিহাসে স্মরণকালের ভয়াবহ গণহত্যা ও জনযুদ্ধের বিজয়গাথা নিয়েই আমাদের একাত্তরের দৃশ্যকাব্য। যে কাব্যের সবটা আমরা আজও জানি না এবং অনেক কিছু আমাদের জানাবোঝার বাইরে চলে গেছে, যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ জেলায় জেলায় নবীন গবেষকদের মাধ্যমে জরিপ চালিয়ে গণহত্যার রোমহর্ষক চিত্র দেশের আপমর মানুষের সামনে তুলে আনছে দেখে গবেষক হিসেবে নিজ জেলা যশোরের জনযুদ্ধ ও গণহত্যা নিয়ে কাজ করার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়েছে। গণহত্যা জাদুঘরের তথ্য মোতাবেক ৩২ জেলার জরিপ অনুযায়ী বধ্যভূমির সংখ্যা ৭২৫টি, গণহত্যা ১৩ হাজার ৬৫০টি, গণকবর আছে এক হাজার একটি এবং নির্যাতন কেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজার ৬২টি।
অনিবার্য সত্য এই যে, ১৯৭১ সালের ২৬৬ দিন ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের মানচিত্রজুড়ে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। প্রতিরোধযুদ্ধ থেকে মুক্তিযুদ্ধে বাংলার মানুষ লড়েছে, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। কোনো বিশেষ রণাঙ্গনে নয় সর্বত্র, ঘরে, রাজপথে, পাহাড়ে, সমতলে। যোদ্ধাদের শতকরা ৮০ জনই ছিল কৃষক। এ কোনো অতিরঞ্জন নয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তাই দেশের আপামর কৃষক, শ্রমিক, আদিবাসী, হরিজন, ছাত্র, শিক্ষক, চিকিৎসক, গৃহিণী, শিশুর ওপর নেমে আসা গণহত্যা ও নির্যাতনের ইতিহাস।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য জন্মের সূবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এখনও পাইনি আমরা। রক্ষিত হয়নি গণহত্যা আর বধ্যভূমির ইতিকথা, গড়ে ওঠেনি স্মৃতির মিনার। আমরা হারিয়ে ফেলেছি স্ব স্ব পরিবারের আত্মত্যাগ, মুক্তিকামিতা আর ঔচিত্যবোধের স্বর্ণালী সময়কে। মানুষকে বারবার ঠেলে দেওয়া হয়েছে পেছনে। মুক্তির সংগ্রামকে চিহ্নিত করা হয়েছে একটি সামরিক যুদ্ধ হিসেবে। নির্মম গণহত্যার স্মৃতিচিহ্ন আজ শুধু বহন করে চলেছে তাদের স্বজন, প্রতিবেশী আর পরিবার। আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে আলোচিত হয় না সামাজিক ইতিহাস, ত্যাগের ইতিহাস। আলোচিত হয় না এদেশটা কীভাবে রূপান্তরিত হয়েছিল গণকবর কিংবা বধ্যভূমিতে। দেশের প্রাচীন জেলা যশোর বা এর প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্ষেত্রেই বিষয়টি একইভাবে প্রযোজ্য।
যশোরের গণহত্যা-গণকবর-বধ্যভূমি বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে দেখা গিয়েছিল সুকুমার বিশ্বাস রচিত ‘একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর’ বইয়ে পাঁচটি গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবরের কথা আছে। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’-এর ৮ম খণ্ডে দুটি গণহত্যা-গণকবর-বধ্যভূমির কথা জেনেছি। পরে সাংবাদিক রুকুনুদ্দৌলাহ রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে যশোর’ গ্রন্থে ১১টি গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্রের কথা উল্লেখ আছে। মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধ কোষ’ ২য় খণ্ডে যশোর জেলার ২১টি গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্রের উল্লেখ পাই। আসাদুজ্জামান আসাদ রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে যশোর’, এম এ হাসান রচিত ‘যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ’, হোসেন উদ্দীন হোসেনের ‘রণক্ষেত্রে সারাবেলা’, ফখরে আলম রচিত ‘যশোরের মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘দক্ষিণের মুক্তিযুদ্ধ’, সফিয়ার রহমানের ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস-যশোর জেলা’, লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক ও কর্নেল মো. আব্দুল মান্নান ভুইয়া পুনঃসম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান’ ৭ম খণ্ড, সুকুমার বিশ্বাস রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধ ও রাইফেলস’ প্রভৃতি গ্রন্থে যশোরে সংঘটিত গণহত্যা, বধ্যভূমি, নির্যাতন কেন্দ্র ও গণকবরের উল্লেখ আছে মাত্র। কিন্তু কোনো সংখ্যা নেই।
কিন্তু গণহত্যা জাদুঘর থেকে ৩২ জেলার যে জরিপ হয়েছে, সেটির যশোর অংশে কাজ করেছেন খুলনার শংকর মল্লিক। তার রচিত ‘গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ - যশোর জেলা’ গ্রন্থে যশোরের ১৪৪টি স্থানে গণহত্যা-বধ্যভূমির নিদর্শনের কথা উল্লেখ আছ। বইটিতে আরও বলা হয়েছে ‘একই স্থানে একাধিক গণহত্যা সংঘটিত হওয়ায় প্রকৃত গণহত্যার সংখ্যা আমাদের হিসাব অনুযায়ী ৬৯৫টি’।
শংকর মল্লিকের জরিপের পথ ধরে তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপর শুধু এপ্রিল মাসেই যশোর শহরে সংঘটিত হয়েছে অন্তত ৭টি গণহত্যার ঘটনা। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত যশোর শহর ছিল মুক্তিকামী মানুষের দখলে। ৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শহরে ঢুকে পড়ে এবং নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। শহর ও শহরতলীর বিস্তীর্ণ এলাকায় শিক্ষক, চিকিৎসক, পেশাজীবী মানুষ, সরকারি কর্মকর্তা, বুদ্ধিজীবী, ক্রীড়াবিদ, অভিনেতা, সাংস্কৃতিক কর্মী, ছাত্র, ইপিআর সদস্য, আইনজীবীসহ পথে-প্রান্তরের হাজারও মানুষ ৪ ও ৫ এপ্রিল মাত্র দু-দিনের মধ্যে হত্যার শিকার হয়। বধ্যভূমিতে পরিণত হয় ইপিআর হেডকোয়ার্টার, তদসংলগ্ন ষষ্ঠীতলা পাড়া, সার্কিট হাউজ, পোস্টঅফিস পাড়া, পুরাতন কসবা, ক্যাথলিক চার্চ, থানা, রেলস্টেশন মাদ্রাসা, পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট, চাঁচড়া, মুড়লী, উপশহর, বড়বাজার, বারান্দীপাড়াসহ শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাজার, উপাসনালয় কিছুই বাদ যায়নি তাদের নিশানা থেকে। অথচ যশোরের সাধারণ মানুষ এ ঘটনাগুলো সম্পর্কে খুব বেশি জ্ঞাত নয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগন্থে যশোরের শহীদ শিক্ষাবিদ, আইনজীবী ও চিকিৎসক হিসেবে ৯৫ জনের সংখ্যা উল্লেখ থাকলেও নাম নেই। হয়তো সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে আছেন তারা, কিন্তু এখন আর ওই ৯৫ জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সংঘটিত গণহত্যাগুলো নিয়ে সামগ্রিক তথ্য সন্নিবেশনের কোনো উদ্যোগও অনুসন্ধানে পাওয়া যায় না। একবার মাত্র ৪ এপ্রিলের শহীদদের কিছু পরিবারকে যুক্ত করে একটি স্মরণসভা হয়েছিল। একটি সংবাদপত্র গণহত্যা বিষয়ক একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। যদিও কোনো কপি সংরক্ষিত নেই ওই সংবাদপত্রের অফিসে। যশোরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগপর্যন্ত এবং বিজয় অর্জিত হওয়ার অব্যবহিত পরে চারটি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ হতো। যেগুলোর কোনো কপি সংরক্ষিত নেই, অন্তত আমি খুঁজে বের করতে পারিনি। বিজয়ের বিশ বছরে স্মৃতি সংরক্ষণের একটি উদ্যোগ গৃহীত হলেও উৎসাহের অভাবে সে কাজ এগোয়নি। ফলে শহীদেরা চলে গেছেন স্মৃতির অন্তরালে, হারিয়ে গেছে বীরত্বগাথা, স্মরণের সকল উদ্যোগ। আজ স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষীদের চাওয়া গণহত্যার শিকার মানুষগুলো পাক শহীদের মর্যাদা। পরিশোধিত হোক ইতিহাসের দায়।
৪ এপ্রিল যশোর সংঘটিত গণহত্যার অন্যতম স্থান ইপিআর ক্যাম্পে ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রি-ক্যাডেট স্কুলের স্থাপনাকাল থেকে জড়িত একজন সিনিয়র শিক্ষক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘স্কুলের কাজে হাত দেবার শুরুতেই পুকুরের কোল ঘেসে একটু মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে আসে মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড়। যেহেতু স্কুলটি জেলা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে স্থাপিত ফলে তাদের খবর দেওয়া হয়। তাদের নির্দেশেই হাড়গোড় আবার মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে এ পর্যন্ত স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যাগ নেওয়া হয়নি। ছেলেমেয়েরা যাতে স্থানটিকে অপবিত্র না করে তাই আমি নিজ উদ্যোগে সেখানে একটি কদম গাছ রোপন করে গাছের চারপাশে বৃত্তাকারে বাধিয়ে দেই। অপর আর একটি স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে স্কুলের স্টোর রুম।’
৪ এপ্রিল গণহত্যার অপর কেন্দ্র সার্কিট হাউজে একাধিক পরিখা খুঁড়ে মানুষকে গলা কেটে হত্যা করে ফেলে রাখা হতো বলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানালেও সেখানেও নেই কোনো স্মারক বা স্মৃতি রক্ষার কোনো উদ্যোগ। নারী নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে মাতৃমঙ্গল-শিশুমঙ্গল হাসপাতাল রূপে।
গণহত্যার স্মৃতি স্মারক খুঁজতে গিয়ে বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি ১৯৭১ সালের ইপিআর অর্থাৎ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস যাদের বর্তমান নাম বিজিবি বা বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ তাদের যশোরস্থ হেডকোয়ার্টারে সংরক্ষিত নেই মুক্তিযুদ্ধের কোনো ইতিহাস বা স্মৃতিচিহ্ন। এমনকি যশোরের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অধিকর্তা পর্যন্ত জানেন না ১৯৭১ সালে শহরের বুকে কোথায় ইপিআর ক্যাম্প ছিল বা তাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা কী ছিল। বিস্মৃতির আস্তরণে হারিয়ে যাচ্ছে শহীদের স্মৃতি, গণহত্যার কাহিনি, স্থান আর বধ্যভূমি। কোনো বধ্যভূমির বুকে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন, স্কুল, কোনো জায়গা হাতবদল হতে হতে থেকে গেছে খণ্ডাংশ রূপে, কোনোটি ঝোপ-জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে হারিয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে।
স্থানীয় মানুষ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে ইপিআর ক্যাম্প সন্নিকটস্থ বৈরাগীর বাগান এবং মুজিব সড়ক ধরে অনেক মানুষকে দীর্ঘ নয় মাসে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সেসব স্থানে ইতিহাসের চিহ্ন মাত্র নেই। মুজিব সড়কের (তৎকালীন জিন্নাহ সড়ক) ইদারাসদৃশ যে স্থানে লাশ ফেলা হতো ওই স্থানে এখন একটি বেসরকারি সংস্থার বহুতল ভবন হয়েছে। বৈরাগীর বাগান বিক্রি হতে হতে বহু খণ্ডে পরিণত হয়েছে। চারজন শহীদের একটি গণকবর রয়েছে জনৈক আব্দুর রহমানের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির পরিখার মধ্যে। সেখানে একটি নামফলক পরিবারের উদ্যোগে দেওয়া হয়েছে। অপর দু-জন শহীদ মকবুল আহম্মেদ ও মোমিনুর রহমান একই কবরে শায়িত রয়েছেন নিজ বাসভবনে। ৫০ বছর ধরে মাটিচাপা দেওয়া রয়েছে শহীদ সত্যরঞ্জন সরকার আর এক নাম না জানা ইপিআর সদস্যের লাশ।
যশোর শত্রুমুক্ত হবার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই মিয়া আব্দুস সাত্তারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় স্থানীয় দৈনিক ‘দৈনিক স্ফুলিঙ্গ’। জাতীয় পত্রিকাগুলোর মতো স্থানীয় এ পত্রিকার পাতায় পাতায়ও দেখা যেত নিখোঁজ সংবাদ। এ অঞ্চলে সংঘটিত গণহত্যার সংবাদ, বীরাঙ্গনা আর নির্যাতিত মানুষের আত্মত্যাগের করুণগাথায় ভরে উঠত পত্রিকার পাতা। ওইসময়ে মানুষের মনে সজীব ছিল নির্যাতনের-লাঞ্ছনার ইতিহাস। কিন্তু পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বের পরস্পর বিচ্ছিন্নতা, হতবিহবলতা, স্বাধীনতা বিরোধীদের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠান এবং কৌশলী রাজ্য শাসন মানুষের স্মৃতি থেকে ধীরে ধীরে মলিন করে দেয় নিখোঁজ মানুষের স্মৃতি, হত্যা আর লাঞ্ছনার ইতিহাস। মানুষ হারিয়ে ফেলে শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণের আগ্রহ।
যশোরের গণহত্যাগুলোর স্বরূপ সন্ধানে দেখা যায় এক অস্বস্তিকর নীরবতা। জেলার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ পর্যন্ত লিখিত গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধের প্রাকপ্রস্তুতি, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ব্যক্তি ও সংগঠনের দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বপালন, যুদ্ধের বহুমাত্রিক বর্ণনা, গণহত্যা-নির্যাতন, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক বিবিধ বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু গণহত্যা-নির্যাতন, বধ্যভূমি, গণকবর এ বিষয়গুলোর আলোচনা ব্যাপকতা পায়নি। ছোট দু-একটি অধ্যায়ে আলোচনা সীমিত রাখা হয়েছে। যদিও যুদ্ধের ব্যাপকতা ও পরিধি বিবেচনায় নিলে লেখকদের এ ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকাটাই স্বাভাবিক।
এভাবে নৃশংস গণহত্যার কারণ, ধরন, প্রকৃতি, গণহত্যা পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে তথ্যভিত্তিক গবেষণা না হওয়া বোধকরি রাষ্ট্রীয়ভাবে চলমান রাজনৈতিক নির্লিপ্ততা, গণহত্যা সম্পর্কিত নীরবতা বা গণহত্যার রাজনীতিরই অংশমাত্র। কিংবা বলা যায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ডিনায়েল বা অস্বীকারের প্রবণতা। কারণ দীর্ঘসময় ধরে গণহত্যাকারী বা তাদের মদদদাতারা সুপরিকল্পিতভাবেই গণহত্যার যাবতীয় নিদর্শন মুছে ফেলার চেষ্টা করে গেছে যেমন, গণকবরের চিহ্ন মুছে ফেলা, কবরে পাওয়া মানুষের হাড়গোড় পুড়িয়ে ফেলা, দলিলাদি নষ্ট করা ইত্যাদি। গণহত্যাকে তারা যে শুধু নিজেরাই অস্বীকার করেছে তা নয়, সমাজ আর জাতিকে আসক্ত করেছে ‘কালেকটিভ অ্যামনেসিয়া বা সম্মিলিত বিস্মৃতি’ প্রবণতায়। যে প্রবণতায় আজ আক্রান্ত আমরা সবাই।
মাঠপর্যায়ে গবেষণা চালাতে গিয়ে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে সহজেই— একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যার স্থান, বধ্যভূমি, গণকবর, নির্যাতন কেন্দ্র ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর চিহ্নিত করে তা সংরক্ষণ করা একান্ত জরুরি। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকুও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। শহীদদের নাম হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে। সারা দেশের মতো যশোরেরও অনেক এলাকায় ইতোমধ্যে গণহত্যার স্থান, বধ্যভূমি, গণকবর নির্যাতন কেন্দ্রের জায়গা দখল করে বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। অনেক স্থান নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর চরম অবহেলায় অবজ্ঞায় পড়ে আছে। যশোর ইপিআর ক্যাম্প ও তদসংলগ্ন এলাকার অবস্থাও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। এহেন বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনুসন্ধান এবং একাত্তরের গণহত্যা-নির্যাতনের ভয়াবহতা, ব্যাপকতা, গভীরতা ও এর নির্মমতা উপলদ্ধি করার জন্য প্রতিটি গণহত্যার এলাকা, বধ্যভূমি ও গণকবর নিয়ে গবেষণা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য। আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে এসেছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম ইতিহাস হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। জনইতিহাস রচনার সময় বোধকরি দ্রুতই শেষ হয়ে আসছে।