চাংক্রান, সাংগ্রাই, বিজু, বৈসু, বিহু শুধু আনন্দোৎসব নয়, এগুলোর সঙ্গে আছে আদিবাসীদের নাড়ির সম্পর্ক। ওই সম্পর্কে ছেদ ঘটায় শিক্ষাব্যবস্থার উদাসীনতা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিবেচনাহীন সিদ্ধান্ত। আদিবাসী শিক্ষার্থীদের এত বড় মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংবেদশীলতার অভাব ও উদাসীনতার কারণে ঘটে যাচ্ছে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। উৎসবের দিনগুলোতে ছুটি দিতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
Published : 08 Apr 2023, 05:16 PM
আর দিন কয়েক পরেই পাহাড়ে চাংক্রান, সাংগ্রাই, বিজু, বৈসু, বিহু উৎসব।
চাংক্রানের কথাটাই আগে বললাম। আমি নিজে একজন ম্রো। পাহাড়ের জাতিগোষ্ঠীগুলোর বর্ষবরণের উৎসবগুলোর মধ্যে খুব একটা বৈসাদৃশ্য আছে এমন নয়।
কেমন করে বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটি জাতি-ধর্মনির্বিশেষে পাহাড়ের মানুষের সবচেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হলো এ নিয়ে আরও জানবার আছে। কথিত আছে, চিংক্লাং ম্রো নামের এক ব্যক্তি ৭০ বছর আগে মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে একটি বুদ্ধমূর্তির সন্ধান পান। ওই মূর্তি পূজাকে কেন্দ্র করে চাংক্রান পই উৎসবের প্রচলন হয়েছিল। আদৌ এমন কোনো গল্পের ভিত্তি আছে কিনা, আমার খোঁজা হয়নি। হতে তো পারে পাহাড়ের অন্য সব জাতিগুলো যে উৎসব করছে, তার একটা ম্রো সংস্করণ প্রয়োজন ছিল। সে যাই হোক, এখন ম্রোরা বিশ্বাস করে, কুড়িয়ে পাওয়া বুদ্ধমূর্তিতে পূজা করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়। তাই চাংক্রান উৎসবে হাজারও পূজারীর ভিড় জমে। এ পূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন উৎসবস্থলে মেলা বসে।
২০১৬ সালের একটা কষ্টের কথা বলব। তখনও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমি। অনেক আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম, চাংক্রান উদযাপন করতে যাব মেনুপাড়ায়। মেনুপাড়া এখন রুইফ পাড়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। পাহাড়ের গ্রামের পর গ্রাম, পাহাড়ের পর পাহাড় নাম বদলের নামে মুসলমানিকরণের কথা তো আপনাদের অজানা নেই। আপনারা যারা নীলগিরি বেড়াতে যান, মুগ্ধ হয়ে ফিরে আসেন আবার নাগরিক জীবনে, তারা জানেন না, নীলগিরি কোনোদিন আমাদের নাম ছিল না, চন্দ্রপাহাড় আমরা চিনি না। আমরা শোং নাম হুং নামে চিনেছি, আমরা তেংপ্লং চূট নামে চিনেছি। এই শোং নাম হুং কীভাবে চন্দ্রপাহাড় হয়ে যায়, এই তংপ্লং চূট কীভাবে নীলগিরি হয়ে যায়? এই ভূমি, এই মাটির প্রত্যেকটা ইঞ্চি আমাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি।
মেনুপাড়ায় না যেতে পারার গল্পটাই বলি আপাতত। ম্রোরা চাংক্রান উদযাপন করে কেন্দ্রীয়ভাবে, মেনুপাড়ায়। আমাদের সঙ্গে বাঙালি বন্ধুরাও কেউ কেউ যেতে চেয়েছিল। অথচ আমারই যাওয়া হলো না পরীক্ষার জন্য। ওইবার আমরা ক্যাম্পাস থেকে গিয়েছিলাম ইপিজেড-এ বিজু করতে। শিল্পাঞ্চলে অনেক চাকমা শ্রমিক আছে। ছাত্রদের মতো শ্রমিকদেরও পাহাড়ের সবচেয়ে বড় উৎসবটিতে যেতে না পারার বেদনা আছে। তবে তারা এই নগরে যাপন করেন পাহাড়ের উৎসব, দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মতো করে।
চাংক্রান, সাংগ্রাই, বিজু, বৈসু, বিহু উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ে এখন সাজ সাজ রব। এরকম আনন্দপূর্ণ সময়ে পাহাড়ের আদিবাসী শিক্ষার্থী বন্ধুদের অনেকে বিমর্ষ মনে রাত জেগে পরীক্ষার পড়া পড়ছে। উৎসবে তাদের বাড়ি যাওয়া হবে না। তাদেরই কেউ কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটির দাবি জানিয়ে প্ল্যাকার্ড দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ঠিক উৎসবের দিনেই তাদের কারও পরীক্ষা, অনেকের আবার গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো কোনো ডিপার্টমেন্টে বেছে বেছে ঠিক এই দিনেই পরীক্ষা নেওয়া হয়। অনেকে সীমিত পরিসরে নিজেরাই উৎসব উদযাপনের চেষ্টা করে, করতে হয়। তখন তারা আবার ছুটির দাবি জানায়, ওইরকম একটা ছবি দেখলাম হেমা চাকমার ফেইসবুক দেয়ালে। পদ্মিনী চাকমা হাতে লিখে জানিয়েছে দাবিটা।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা রাখতে হয়। শিক্ষাব্যবস্থার আগ্রাসী এই রূপের কারণে আদিবাসী সমাজ, সংস্কৃতি ও যাপিত জীবন থেকে একজন আদিবাসী শিক্ষার্থী বিচ্ছিন্ন বোধ করে প্রতিনিয়ত। এই বিচ্ছিন্নতার যাত্রা শুরু শিক্ষার প্রাথমিক জীবন থেকেই। মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষায় পাঠগুলো মুখস্থ করতে হয় তাদের। স্রেফ মানসিক জোর ও উন্নত জীবনের কৃত্রিম আকাঙ্ক্ষার জোরে পরীক্ষায় পাশ করে যায় তারা। এমন সব বিষয় তাদেরকে পড়তে হয় যেসবে তাদের জীবন নিয়ে বোঝাপড়ার কোনো প্রতিফলন থাকে না। নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতির রীতি, বিশ্বাস, ঐতিহ্যের কোনো ছাপ সেখানে থাকে না। এর ফলে পড়াশোনা পাশাপাশি নিজেদের বিশ্বাস ও জীবনবোধকে বিকশিত করার সুযোগ হয়ে উঠেনি। বরং এটি হয়ে উঠেছে আদিবাসী জীবনদর্শন থেকে পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যম।
নানা বাস্তবতার কারণে এই মাধ্যমকে যারা নিজেদের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে তারাই শুধু শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টায় আছে। বাকিদের অধিকাংশই এই লড়াইয়ে হেরেছে। আদিবাসী জুম্ম জনগোষ্ঠীর যারা এখনো প্রাণ-প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত তাদের ছেলেমেয়েরা এই পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমকে একপ্রকার ভয়ই পায়। ওই ভয় ও আশঙ্কার জায়গা থেকে তারা উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার পর আর পড়াশোনার আগ্রহ বোধ করে না। তারা ঝরে পড়ে। উচ্চশিক্ষা থেকে ঝরে পড়াদের কাছে পড়াশোনার অন্য অর্থ দাঁড়ায়, ঘর থেকে দূরে চলে যাওয়া। পড়াশোনা মানেই যেন দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাস থেকে সরে গিয়ে নতুন কোনো বিশ্বাসে, নতুন জীবনবোধের কাছে নিজেকে সমর্পিত করা। আর আমার মতো, আমাদের মতো অনেকে ওই জীবনবোধে নিজেকে জোর করে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করে যাই। ম্রো জনগোষ্ঠীকে নিয়ে অনেকে অনুযোগ করেন যে, তারা পড়তে চায় না। আশির দশকে ম্রোদের গ্রাম থেকে ম্রো শিশুদের একপ্রকার ধরে আনা হতো স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য। গ্রামে শিক্ষক দেখলেই বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের নিয়ে দূরে পালিয়ে নিয়ে যেতেন। স্কুলে পাঠিয়ে আদরের সন্তানকে হারিয়ে ফেলার যে ভয়, তা মোটেও অমূলক ছিল না। তাঁদের দীর্ঘদিনের চর্চিত জীবন দর্শন, প্রকৃতির সঙ্গে তার যে নিবিড় সম্পর্ক ওই সম্পর্কের ছেদ ঘটানো অবশ্যই পীড়াদায়ক।
শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে বেসিক বোঝাপড়া শক্তভাবে গড়ে না ওঠা এবং পড়াশোনার সিস্টেমের সঙ্গে নিজেদের জীবনবোধকে না মেলাতে পারার এই সমুদ্রসম বিপত্তি পার হয়েই আদিবাসী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এতগুলো বিপত্তি পার হয়ে উচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষা নিতে এসেও তাদের পড়তে হয় নানারকম সমস্যায়। আদিবাসীদের অন্যতম বড় ঐতিহ্যবাহী উৎসব চাংক্রান, সাংগ্রাই, বিজু, বৈসু, বিহুর সময়ে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে থাকতে হয় পরীক্ষার চাপ নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় অংশের শিক্ষকদের মধ্যেই এই বিষয়ে কোনো ধরনের সংবেদনশীলতা কাজ করে না। তাঁদের অনেকেই জানেন না এই উৎসবের সঙ্গে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের জীবনবোধের কী সম্পর্ক রয়েছে। এইসব বিষয়ে তাঁদের উদাসীনতা আদিবাসী শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র জীবনবোধের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তৈরির বড় কারণ। এই অসংবেদনশীলতা সংক্রামক ও মারাত্মক। এদেশের মূলস্রোতধারার মানুষের বেশিরভাগ অংশের এই বিষয়ে উদাসীনতা রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় অ-আদিবাসী সহপাঠীদের মধ্যেও এই সংবেদনশীলতা আসে না। কোর্স শেষ করার তাগিদ থেকে অধিকাংশ সময় তারাই এই উৎসবের দিনে পরীক্ষা নেওয়াটাকে সমর্থন করেন। তাঁরাই আগ বাড়িয়ে পরীক্ষা নেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। অথচ এমনও দেখা যায় যে বছরের অন্যান্য দিনে শিক্ষকদের নানা ব্যস্ততার কারণে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস বা পরীক্ষাও পিছিয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব থেকে বঞ্চিত করার মতো অবিবেচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ দেখিয়ে দেয় আদিবাসীদের জীবনের মূল্যবোধের প্রতি চরম ঔদাসীন্য রয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়।
শিক্ষকদের মতো সংবেদনশীল মানুষেরা কেন চাংক্রান, সাংগ্রাই, বিজু, বৈসু, বিহু উৎসবের সময় পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন? কেন আদিবাসী শিক্ষার্থীরা তাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত উৎসবের সময় ছুটি পাবেন না? এমন কিন্তু নয় যে, এই ছুটি মঞ্জুর করার জন্য সংবিধান পরিবর্তন করে কোনো আইন পাশ করাতে হবে। দরকার শুধু একটু সংবেদনশীল হওয়া। আদিবাসী মানুষের জীবনবোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে পরীক্ষা বা ক্লাস বন্ধ রেখে উৎসবের দিনে ছুটি দেওয়া।
স্বতন্ত্র ও বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনযাপনের প্রশ্নে, আদিবাসী অধিকারের প্রশ্নে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের নানা বাঁধা অতিক্রম করে মূলস্রোতের মানুষের কাতারে আসার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। উচ্চ বিদ্যাপীঠে এসে নিজের জীবনবোধ ও শেকড়ের প্রতি যেটুকু আবেগ-অনুভূতি অবশিষ্ট থাকে সেটুকু ধরে রাখার জন্য তাদের প্রাণপণ চেষ্টা করতে হয়। চাংক্রান, সাংগ্রাই, বিজু, বৈসু, বিহু শুধু আনন্দোৎসব নয়, এগুলোর সঙ্গে আছে আদিবাসীদের নাড়ির সম্পর্ক। ওই সম্পর্কে ছেদ ঘটায় শিক্ষাব্যবস্থার উদাসীনতা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিবেচনাহীন সিদ্ধান্ত। আদিবাসী শিক্ষার্থীদের এত বড় মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংবেদশীলতার অভাব ও উদাসীনতার কারণে ঘটে যাচ্ছে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি দেওয়া হোক, শিক্ষার্থীরা চাপমুক্ত হোক। উৎসব হোক জীবনে মুক্তি পাওয়ার প্রতীক।