আমরা যদি ধরে নিই রিসাইকেল করতে পারা বর্জ্যের পুরোটাই প্লাস্টিকজাত বর্জ্য, তখন একটি সম্পূরক প্রশ্নের উদ্ভব হয়, কোন ধরনের প্লাস্টিক রিসাইকেল হয়েছে?
Published : 11 Dec 2023, 10:26 AM
ভাষ্যটি স্ববিরোধী হতে পারে। কেননা আমরা সবাই বলি যে প্লাস্টিক পরিবেশবান্ধব নয়— এটা একধরনের দূষকও বটে। প্লাস্টিক নিয়ে সারা দুনিয়ার ডামাডোলে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্রনিক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্লাস্টিক নিয়ে আলোচনা চলছে হরদম। কিন্তু প্লাস্টিক ছাড়া আমাদের জীবনমান ধরে রাখা এককথায় অসম্ভব। এটা আমরা নিজেরাই হিসেব করে দেখতে পারি। রোজ ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাবার আগে যে সব বস্তুর সংস্পর্শে আসা হয়, তার মধ্যে কতগুলো প্লাস্টিক বা প্লাস্টিকজাতীয় তার একটা খসড়া করতে পারি ‘এসো নিজে করি’র মতন। ব্যবহার্য্য পণ্যের মধ্যে যেহেতু প্লাস্টিকের উপস্থিতি দৃশ্যমান এবং এর থেকে পরিত্রাণ পাবার সম্ভাবনা খুব কম বলেই ধরে নেয়া যায়। প্লাস্টিকের বদলে অন্য আর কী থাকতে পারে যা দিয়ে আমরা প্লাস্টিকের ব্যবহারকে কমাতে বা প্লাস্টিককে প্রতিস্থাপন করতে পারি, তা আমার জানা নাই।
আমাদের সরকার যদিও কিছু খাদ্যপণ্য, যেমন চালের জন্য পাটের তৈরি বস্তাকে বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু আরও যে খাবার আমরা খাই যেমন আটা, চিনি, ডালের বস্তা হয়তো এখনও প্লাস্টিকেরই। পাটের বা কাপড়ের বস্তার স্বল্পতাও একটা বড় কারণ। চাইলেই চট করে একটা কিছু করে ফেলা যায় না। তার ওপর বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের জন্য তো চটজলদি কিছু করা আরও কঠিন।
একইভাবে খুচরা পণ্য যেমন ডাল, আটা, তেল, মশলা, বিস্কুট, চানাচুর আরও যা কিছু বাজারে বা মুদি দোকানে দেখা যায়, তার সবই প্লাস্টিকের মোড়কে থাকে। এর ব্যত্যয় যদি দুয়েকটা থেকে থাকে সেটাকে পরিসংখ্যানে নিয়ে আসা অসম্ভব প্রায়। প্লাস্টিকের অনেক ধরন থাকলেও সাধারণভাবে আমরা একে দুই দলে ফেলতে পারি। প্রথমটি শক্ত বা হার্ড প্লাস্টিক। যেমন বালতি, পানির বোতল, ড্রাম, টেবিল চেয়ার ইত্যাদি। এই ধরনের প্লাস্টিক থেকে তৈরি পণ্যগুলো আকারে বড় এবং পুনঃব্যবহার যোগ্য হয়। পানির বোতলকে আমরা যেমন একবারের বেশি ব্যবহার করতে পারি, বালতি বা জগের ব্যবহার তো আরও অনেক বেশিদিন ধরে হয়। সাধারণত এই ধরনের প্লাস্টিকে তৈরি পণ্যের দামও বেশি হয়।
আরেক দল হলো নরম বা সফট প্লাস্টিক। এই দলে পড়বে শক্ত নয় এমন সব ধরনের প্লাস্টিক। খাবারের মোড়ক, বস্তা, ব্যাগ, পলিব্যাগ, পলিথিন শিট ইত্যাদি। নাম যেহেতু সফট আমরা ধরেই নিতে পারি এই ধরনের প্লাস্টিকের পণ্য নিজে নিজের আকার ধারণ করতে পারে না। শুধু সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকে তৈরি থালাবাটি, বাসন-কোসন ছাড়া। এগুলো হার্ড প্লাস্টিকের মতো মনে হলেও উৎপাদন এবং স্থায়িত্বের বিচারে সফট প্লাস্টিকের মতো আচারণ করে। তাই আমরা একেও সফট হিসেবে ধরে নেব।
এই সব ধরনের প্লাস্টিকই আমাদের বেশ পছন্দের। ক্রয়যোগ্য পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য হয় মোড়কজাত পণ্যের পরিমাণ কমতে থাকে নয়তো গুণগত মান। ১০ টাকার কোনো পণ্যের দাম যদি ১০ বছর পর ১০ টাকাই থাকে আবার এর মধ্যে যদি আপনার আমার বেতন বৃদ্ধি পায় তবে বুঝতে হবে সেই ১০ টাকার পণ্যের গুণগত মান ১০ বছর আগের মতন নেই। বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে এর সম্পর্ক হলো কিছু না করলেও প্রতি বছর অল্প করে হলেও বেতন বৃদ্ধি পায় অর্থের মান কমে যাওয়ার কারণে। এটা বৈশ্বিক সত্য। তাই সব কিছুর দাম বাড়ে। কাজেই কোনো পণ্যের দাম না বাড়লে সেখানে প্রশ্ন রাখার জায়গা তৈরি হয়। সেখানে প্রশ্ন হলো আমরা কি একই মানের এবং একই পরিমাণের পণ্য পাচ্ছি কি না? সত্য হলো সম্ভবনা ক্ষীণ। এখানে পণ্য উৎপাদক বা ব্যবসায়ীদের দোষ দিয়ে কাজের কিছু হবে না। কারণ তারা ক্রেতার সক্ষমতার কথা ভেবেই পণ্য উৎপাদন বা বিপণন করে থাকেন। আমাদের কাছে যখন টাকা বেশি থাকে তখন আমরা বেশি জিনিস কিনি। আবার পণ্যের দাম বেশি হলেও হয়তো আমরা বেশি সংখ্যায় কিন্তু পরিমাণে কম পণ্য কিনি। অংকটা জটিল মনে হলেও আসলে জটিল নয়।
ধরা যাক, আগে আমরা এক মণ চাল কিনতাম। এক মণ চাল আসত একটা বস্তাতে। এখনও তাই পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা কত জন সেটা কিনি এখন? কিন্তু মাসের বাজার বলে যে একটা ব্যপার ছিল সেটা তো সত্যি। এখনও আছে। অনেকে এখনও তাই করে থাকেন। এটা রেওয়াজের প্রশ্ন নয় বরং সাশ্রয়ী। কিন্তু এর সঙ্গে একটা ব্যপার যুক্ত। আমরা একসঙ্গে মাসের প্রথমে এক মণ চাল কেনার সামর্থ্য রাখি কি না। অনেকেই রাখেন আবার অনেক বড় অংশ হয়তো রাখেন না। আবার যারা রাখেন তারা নিজের সুবিধার জন্যে একবারে বড় বাজার না করে ছুটির দিনে সাপ্তাহিক বাজার করে থাকেন। তখন কেউই হয়তো একমণি বস্তা কেনেন করেন না। তার প্রয়োজনও পড়ে না, কারণ সামনের সপ্তাহে আবার কেনা যাবে— এই প্রস্তুতি থাকে। এখানে কনভিনিয়েন্স একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। আমরা সব জায়গায় কনভিনিয়েন্স খুঁজি। এটা ভোক্তা কেন্দ্রিক অর্থনীতির অন্যতম হাতিয়ার। তার মানে যার অর্থ আছে তিনিও মাসে অন্তত একের অধিক প্যাকেটজাত চাল বা খোলা বাজার থেকে পলিথিন ব্যাগে চাল কেনেন।
আবার যাদের ক্রয় সক্ষমতা কম তারা এক মণ চাল একসঙ্গে কিনবেন না। হয় তারা কম কিনবেন অথবা বেশি বার কিনবেন। যদি মাসে এক মণ চালই তাদের লাগে এবং তারা যদি এক মণ চালই ক্রয় করেন তবে তারা হয়তো ৮ থেকে ১০ বারে কিংবা আরও বেশি বারে এই একমণ চাল কিনবেন। তার মানে হলো দুই জায়গাতেই সংখ্যা বাড়ছে। পরিমাণ সমান কিংবা কম বেশি যদি হয়েও থাকে।
এত কিছু বলা হলো একটা কারণে, আমরা না চাইলেও প্লাস্টিকের মোড়ক বা পলিব্যাগ থেকে দূরে থাকতে পারব না বা এর সংখ্যা কমানোও কঠিন হবে। ক্রয় সক্ষমতার সঙ্গে এর সরাসরি সংযোগ যে আছে তা আমরা দেখতে পেলাম। আবার যেহেতু ছোট জিনিস কেনা কনভিনিয়েন্ট তার কারণে বার বার ক্রয় করার প্রবণতা আপনা থেকেই বেড়ে যায়। যে কারণে ক্রয়কৃত পণ্যের মোড়কের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে বা থাকবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে ২০২০-২১ সালে ৩৪২টি পৌরসভা থেকে প্রায় ৮০ লাখ টন বর্জ্য অপসারণ করতে হয়েছিল। এখন প্রশ্ন আসে এর মধ্যে প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য কতখানি ছিল? ওই পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ৮০ লাখ টনের মধ্যে মাত্র তিন দশমিক ১৫ শতাংশকে পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বা রিসাইকেল করা সম্ভব হয়েছে। আমরা যদি ধরে নিই রিসাইকেল করতে পারা বর্জ্যের পুরোটাই প্লাস্টিকজাত বর্জ্য তখন একটি সম্পূরক প্রশ্নের উদ্ভব হয়। কোন ধরনের প্লাস্টিক রিসাইকেল হয়েছে?
শুরুর দিকে আমরা প্লাস্টিককে দুই ভাগে ভাগ করেছিলাম, শক্ত আর নরম। শক্ত প্লাস্টিকে তৈরি পণ্য সংগ্রহ করার সম্ভাবনা যেমন বেশি তেমনি একে রিসাইকলেও করাও তুলনামূলকভাবে সহজ। তাই আমরা রাস্তাঘাটে শক্ত প্লাস্টিক বর্জ্য সরারচর পড়ে থাকতে দেখি না। সেই পণ্যই রিসাইকেল বেশি হবে যা সহজে রিসাইকেল করা যায়, সংগ্রহ করার খরচ কম এবং চাহিদা ও বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। শক্ত প্লাস্টিক বর্জ্য তাই চক্র অর্থনীতি বা সার্কুলার ইকোনমির এক বড় অংশ।
একইভাবে যে সব বর্জ্য তুলে নিয়ে আসতে খরচ ও সময় বেশি লাগে, আবার সেটাকে যদি রিসাইকেল করা কঠিন হয় বা করা গেলেও যে খরচ পড়ে, তার থেকে নতুন পণ্যের দাম কম, তবে তার রিসাইকেল্ড হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তাই আমরা রাস্তাঘাটে, পুকুর-নদীর পাড়ে, বাস-লঞ্চ টার্মিনালে, ড্রেনে, ডোবা-নালায়, নিচু পতিত জমিতে এই ধরনের নরম প্লাস্টিক বেশি দেখতে পাই। নরম প্লাস্টিকের মধ্যে আবার অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল যুক্ত চিপসের প্যাকেট এবং অন্যান্য যা কিছু, তাদের রিসাইকেল্ড হবার সম্ভাবনা একদম নেই বললেই চলে। তাই এদের সব থেকে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। যদি একটা মুদি দোকান দেখা হয়, তবে দেখা যাবে সংখ্যার দিক থেকে দোকানে এই ধরনের মোড়কজাত পণ্যই বেশি। এর কারণ হলো আমরা, ক্রেতারা এই জাতীয় পণ্য বেশি কিনে থাকি। এটা প্রয়োজনের থেকে বেশি আনুষঙ্গিক। আমাদের কিনতে ভাল লাগে আবার এই পণ্যগুলো দেখতেও ভাল। বাচ্চাদের হাতে এ জাতীয় পণ্য ধরিয়ে দেয়ার প্রবণতা প্রায় সব ক্রয়ক্ষমতার মানুষের মাঝেই দেখতে পাওয়া যায়। আমরা কি খুব বেশি সময় এই পলিথিন ব্যাগগুলো না নিয়ে থাকতে পারি? পারি না, বরং আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বলি ভাই দোকানদার দিয়ে দিলে কী করব? এই অজুহাত আমাদের নিজেদের। এমন ফ্রিতে নিতে নিতে কখন যে সেটার প্রতি আমাদের নির্ভরতা জন্মে গেছে তা হয়তো আমরা নিজেরাই বুঝে উঠতে পারিনি। অনেকগুলো ব্যাগ নিয়ে বাজার বা শপিং থেকে বের হওয়াটা বিশেষ রকম স্মার্টনেস বলে মনে করি আমরা।
কিন্তু এই বর্জ্যগুলো কোথায় যায়? যদি কেউ তুলে বা সংগ্রহ না করে তবে আমরা যেখানে ফেলে দেই, এই বর্জ্যগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আশেপাশে পড়ে থাকে। আবার সংগ্রহ করাও কম হয়, কারণ সংগ্রহ করলেও বাণিজ্যিক কোনো সুবিধা থাকে না। আমরা যদি খেয়াল করি, আমাদের চারপাশের ডোবা-নালাতে এই জাতীয় বর্জ্য বেশি। শুধু একারণেই যে এই বর্জ্যগুলো যেসব স্থান থেকে সংগ্রহ করা হয় তা বেশি দূরে নিয়ে যাওয়া বা পরিবহন খরচ না বাড়িয়ে আশেপাশে ফেলে দেয়া হয়। ফেলার জন্য ডোবা বা পুকুর অতি উত্তম স্থান, কেননা হালকা মোড়কগুলো কিছুদিন ভাসতে থাকলেও সময়ের সঙ্গে তলিয়ে যায়। কিন্তু তারা কোনো দিনই প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায় না।
আবাসন সংকুলানের জন্য আমাদের অনেক জলাশয়, সেটা পুকুর বা ডোবা, যে নামেই ডাকি না কেন, ভরে ফেলা হয়। ভূমিদস্যুতা রয়েছেই। মাটি, বালু দিয়ে যেমন জলাশয় ভরাট করা হয়, তেমনি দৃষ্টির অগোচরে ভূমিদস্যুরা ধীরে ধীরে এই জাতীয় বর্জ্য দিয়েও জলাশয় ভরাট করে থাকে। এ ধরনের কাজে মোড়কজাতীয় প্লাস্টিক আমাদের প্রথম পছন্দের। তাই দেখা যায় পৌর এলাকার বাইরে রাস্তার আশেপাশে কিংবা গৃহস্থালির আশেপাশের ছোটোখাটো ডোবা, পুকুরগুলোতে দিনের পর দিন এই ধরনের বর্জ্য আলাদা করে না সরিয়ে অন্যান্য বর্জ্যের সঙ্গে ফেলা হয়। এতে সময় এবং খরচা দুই বাঁচে।
এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আছে অনেক। তবে সবথেকে বেশি দৃশ্যমান সেন্টমার্টিন্স দ্বীপে। সেন্টমার্টিন্স দ্বীপে বাজার পার হয়ে আরও দক্ষিণমুখী হাঁটা ধরলে ডানে বামে যে কয়টা ডোবা ছিল তাতে এখন আর পানির কোনো অস্তিত্ব নাই। যে প্লাস্টিকগুলো বিক্রি হয় না তার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে এই পুকুর বা ডোবাগুলো। এমন উদাহরণ আমরা নিজেরাই দিতে পারি।