যুদ্ধাহতের ভাষ্য-১১৩: স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকারদের চরিত্র কখনও বদলায় না

প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, “তোমরা স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকারদের কাছ থেকে সর্তক থেকো। নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলো। তোমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধাদের দোয়া থাকবে সবসময়।”

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 28 August 2022, 01:27 PM
Updated : 28 August 2022, 01:27 PM

“যমুনা নদীকে ঘিরেই ছিল আমাদের জীবন প্রবাহ। নদীতে মাছ ধরতাম, সাঁতার কাটতাম। নদীর বুকে ভেসে থাকতে অন্যরকম লাগত। সাঁতর কেটে যেতাম দূরের বালু চরে। শরীরে বালু মেখে চরের মধ্যেই চলত ফুটবল আর হাডুডু খেলা। ওই আনন্দটা সত্যিই অন্যরকম ছিল। মাঝেমধ্যে বন্ধু সিরাজুল, মজিবুর রহমান ভূঁইয়া, আব্দুল আউয়াল, মোতালেব, হাফিজুর রহমান ফকির, করিম, আব্দুল হাকিম, মকবুল ভূঁইয়া, জিয়াউল হক জালাল প্রমুখকে নিয়ে নৌকা ভাসাতাম। নদীর বুকে চলত আমাদের আনন্দভ্রমণ। রাতে নৌকায় শুয়ে খোলা আকাশে তারা দেখা, ভাটিয়ালি গানের সুরে বিমোহিত হওয়ার স্মৃতিতে আজও আন্দোলিত হই।

বর্ষা এলেই যমুনা আরও প্রমত্ত হতো। চারপাশ জলে ভাসিয়ে নদীর রূপও যেত বদলে। নদী পাড়ের বসতি ঘরে পানি উঠত তখন। চালায় বসে বড়শিতে মাছ ধরেছি সে সময়। যুমনা এখন আগের মতো নাই। চর পড়ে বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। নদীর দিকও গেছে পাল্টে। আগে রুই, বোয়াল, চিতল, আইড়সহ নানা প্রজাতির মাছ মিলত। যমুনায় এখন আগের মতো মাছও নাই। নদীকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। দুষণ চলছে ক্রমাগত, বালি উত্তোলনও থেমে নেই, ব্রিজ করতে গিয়ে নদী শাসনও হয়েছে। ফলে প্রমত্ত যমুনার আগের রূপও পাল্টে গেছে। তবুও এই নদীকে ঘিরে এখনও আমাদের জীবন আবর্তিত হচ্ছে।”

নদীপাড়ের মানুষ হওয়ায় যমুনা নদীর স্মৃতি তুলে ধরেই আলাপচারিতা শুরু করেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুস সামাদ। তার বাড়ি জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার চর সরিষাবাড়ি গ্রামে। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে যুদ্ধদিনের নানা ইতিহাস ও স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে।

ইউনুস আলী ও ময়না খাতুনের তৃতীয় সন্তান আব্দুস সামাদ। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি চর সরিষাবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অতঃপর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন আরামনগর হাইস্কুলে। ১৯৭০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন সরিষাবাড়ি কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন ওই কলেজেরই ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।

চরাঞ্চলের জীবন তাদের। কোনো রাজনীতিও বুঝতেন না সামাদরা। কিন্তু দেশের জন্য ঊনসত্তরের আন্দোলনের সময় সরিষাবাড়ি ও জামালপুরের বিভিন্ন জায়গায় মিছিল করতে যেতেন।

তার ভাষায়, “সকালে সরিষাবাড়ি উপজেলা সদরে এসে মিটিং করেছি। মিটিং চলত সরিষাবাড়ির গরিশংকর মাঠ ও রেলওয়ে ময়দানে। সেখানে বক্তব্য দিতেন আব্দুল মালেক সাহেব, গনি সাহেব, মজিদ মেম্বার প্রমুখ। তারা দেশ নিয়ে নানা বৈষম্যের কথা তুলে ধরতেন, শেখ মুজিবের আন্দোলনের কথা বলতেন। এছাড়া মানুষের মুখে মুখে শুনেছি ঢাকার আন্দোলনের খবর।

প্রবল আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়, ১৯৭০ সালে। আমাদের ওখানে এমপিএ পদে দাঁড়ান আব্দুল মালেক সাহেব। তাকে জেতাতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষের কাছে ভোট চেয়েছি। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা দেয় না। শুরু হয় আরেক আন্দোলন। সবাই তখন চিন্তিত। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে সারা দেশের বাঙালিরা।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। আমাদের কাছে ওটাই ছিল স্বাধীনতার নির্দেশ। ওই ভাষণ আমরা শুনি রেডিওতে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করতে হবে.......এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তখনই বুঝে যাই যুদ্ধ ছাড়া এ দেশ মুক্ত হবে না।”

সরিষাবাড়িতে আপনারা কী করলেন?

“নিজেদের মধ্যে যোগাযোগটা বাড়াতে থাকি। ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু হয়। লোকমুখে সে খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। সরিষাবাড়িতে তখনও আর্মি আসেনি। কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষে কিছু বাঙালি শান্তি কমিটি গঠন করে। আর্মি আসার আগে তারাই অত্যাচার শুরু করে। আরামনগর বাজারের ভেতর চারজন কর্মকারকে হত্যা করা হয়। হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও আক্রমণ চালায়। এখানে শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন সালাম তালুকদারের বাবা রিয়াজ তালুকদার। এপ্রিলে আর্মি এলে শান্তি কমিটির সহযোগিতায় তারা বিভিন্ন জনকে ধরে নিয়ে টর্চার করতে থাকে। আমরা মিছিল-মিটিং করতাম। তাই টার্গেটে ছিলাম। পেলেই ধরে নিয়ে যাবে। তখন সিরাজ ভাই, সায়েদ ভাই, মকবুল ভূঁইয়া, মুজিব ভূঁইয়া, করিম, আব্দুল মোতালেব প্রমুখ যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। কিন্তু পরে সবাই আসে না। আমরা ৫-৬ জন ভাবলাম থাইক্যা লাভ নাই। এবায়ও মারবে ওবায়ও মারবে। তাই মে মাসের শেষের দিকে দেশের জন্য ঘর ছাড়ি।”

পুবলদীঘা ইউনিয়নের ডিগ্রী পাস ছেলে ছিল ফজলুর রহমান। তার সঙ্গে দুটি নৌকায় সামাদসহ প্রায় দেড়শ যুবক যুদ্ধে যান। যমুনা নদী দিয়ে মোল্লারচর হয়ে তারা ভারতের নোঙ্গরপাড়ায় পৌঁছান। ওখান থেকে হেঁটে চলে যান মাহেন্দ্রগঞ্জে। কিন্তু সেখানে তখনও মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট শুরু হয়নি। ফলে তারা শরণার্থী হিসেবেই থাকেন, এক থেকে দেড় মাস।

এরপর কী ঘটল?

শুনি আব্দুস সামাদের মুখে। তার ভাষায়, “মাহেন্দ্রগঞ্জ বাজারের পাশে ছিল একটি মাদ্রাসা। সেখানেই থাকতাম আমরা। একদিন খবর এলো মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করা হবে। দৌড়ে গিয়ে লাইনে দাঁড়াই। অনেক যুবককে রিক্রুট করা হলো ওইদিন। সাত দিন পর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় মেঘালয়ের তুরা থেকে বিশ মাইল উত্তরে তেলঢালা নামক জায়গায়। ওখানে যে আর্মির ব্রিগেড ছিল আমরা জানতাম না। গিয়ে দেখি তিনটা ব্যাটেলিয়ান– ফাস্ট, থার্ড ও এইট। পুরো ব্রিগেডের দায়িত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। আমাদের সবাইকে এই তিন ব্যাটেলিয়ানে ভাগ করে রাখা হয়। আমি ছিলাম থার্ড ব্যাটেলিয়ানে, ই-কোম্পানিতে। সেখানে কিছুদিন চলে প্রাথমিক ট্রেনিং।

পরে সেক্টর ভাগ হলে ক্যাম্পে আসেন মেজর আবু তাহের। তার বাড়ি নেত্রকোণায়। ময়মনসিংহের সবাইকে একত্রিত করা হয় তখন। তিনি আসাতে আমরাও খুব খুশি হই। সবার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমরা কমান্ডো ট্রেনিং করবা। দেশ স্বাধীন হবে। তোমরা যে যার মতো আবার স্কুল-কলেজে ভর্তি হবা।’ তার কথা শুনে আর্মির লোকেরা তো অবাক হয়ে বলত– ‘এই ছেলেরা কি পারবে বারো ঘন্টা কমান্ডো ট্রেনিং করতে!’ কিন্তু রাত নাই দিন নাই আমরা দেশের কথা ভেবে ট্রেনিং করেছি।

আটাশ দিন ট্রেনিং হয় আমাদের। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ২৬৩৫৬। এসএলআর, এসএমজি, রাইফেল, স্টেনগান চালানো, টুইঞ্চ মর্টার, ব্রিজ ভাঙার জন্য একপ্লোসিভ ফিট করা প্রভৃতি শেখানো হয়। পাহাড়ের ওপরে ছিল ক্যাম্প। পানির কষ্ট ছিল খুব। একবার পাহাড় থেকে অনেক নিচে পড়ে গিয়েছিলাম। শরীরে তখন মারাত্মক ক্ষত তৈরি হয়। কিন্তু তবুও ট্রেনিংটা চালিয়ে যাই। নৌবাহিনীর দুজন লোক স্টিমারে মাইন ফিট করা শেখায়। ট্রেনিংয়ে আমাদের ওস্তাদ ছিলেন সুবেদার সিদ্দিক। বেশ কড়া ছিলেন তিনি। এছাড়া সুবেদার আরজ আলী, জলিল, আব্দুর রউফের কথা এখনও মনে পড়ে। তারাই আমাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিলেন।”

ট্রেনিং শেষে সামাদরা যুদ্ধ করেন ১১ নম্বর সেক্টরে। প্রথমে পাঠানো হয় কামালপুরে। জামালপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম কামালপুর। এখানকার বিওপি এলাকায় প্রায় দেড়শ সৈন্য নিয়ে পাকিস্তানি বেলুচ রেজিমেন্ট শক্ত ঘাঁটি গাড়ে। চারদিকে মোটা গাছের গুঁড়ি ও কংক্রিটের সাহায্যে তারা গড়ে তোলে দুর্ভেদ্য বাঙ্কার। তাদের সঙ্গে ছিল রাজাকাররাও। সেখানে দুইদিন ফাইট করেন তারা। কিন্তু টিকতে পারেন না। ওই যুদ্ধে শহীদ হন সরিষাবাড়ির সহযোদ্ধা মোজাম্মেল হোসেন আর মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন দেওয়ানগঞ্জের কাইয়ুম।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদের ভাষায়, “মোজাম্মেল মারা গেছে এটা প্রথমে বুঝি নাই। ধানের জালার মধ্যে পজিশনে ছিল। যখন শেল এসে পড়ে তখন আমরা সরে পড়ি। কিন্তু মোজাম্মেল সরতে পারে না, তার শরীরে শেল এসে পড়ে। দুদিন পর ফিরে এসে ওর ক্ষত-বিক্ষত লাশ আমরা পাই। কাইয়ুমের গুলি লেগেছিল পেটে। পরে চিকিৎসা হলে সে বেঁচে যায়।

এরপর নৌবাহিনীর দুজন সদস্যসহ মেজর আবু তাহের নিজে আমাদেরকে মাহেন্দ্রগঞ্জ কুমারপাড়া থেকে নৌকায় বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাঠান। সেখানকার স্টিমার ডুবিয়ে দিতে হবে। আমাদের ১৭ জনের সাথে নৌবাহিনীর লোকমান হোসেন (চট্টগ্রাম বাড়ি) আর কুমিল্লার সামাদ ছিলেন। কিন্তু সেখানে অপারেশন করতে পারিনি। কারণ অপারেশন করতে হতো রাতে। কিন্তু স্টিমারগুলো সারাদিন থেকে সন্ধ্যায় চলে যেত। ফলে অপারেশনের সুযোগ আমরা পাই না।

পরে মেজর তাহের স্যার নির্দেশ দেন সরিষাবাড়ি বা সিরাজগঞ্জের দিকে অপারেশন করার। ওই সময়ই কানাইপাড়ায় যোগাযোগ হয় দারোগা কোম্পানির কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সুজাবত আলীর সঙ্গে। উনি ছিলেন পুলিশের সাব-ইন্সেপেক্টর। তার কোম্পানিতেই আমরা যুক্ত হই। খুবই সিরিয়াস ও সাহসী যোদ্ধা ছিলেন তিনি। দিন-রাত নৌকার ছইয়ের ওপর থাকতেন। নাওয়া খাওয়া ছিল না। দুর্ধর্ষ সব অপারেশনের পরিকল্পনা করতেন দারোগা সুজাবত। তার নেতৃত্বেই আমরা অপারেশন করেছি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর থানায়, জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের ফেরি ডোবানো, বয়রা বাজারে রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ, দেওয়ানগঞ্জ স্টেশনের আংশিক ধ্বংস করা, বাউশি রেলব্রিজ ওড়ানো প্রভৃতি স্থানে।

সরিষাবাড়ির বাউশি রেলব্রিজ অপারেশনের সময় মারাত্মকভাবে আহত হন এই বীর যোদ্ধা। পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশফায়ারের গুলি লাগে তার কোমরের বাম পাশে।

কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনটিতে?

জানতে চাই আমরা। উত্তরে খানিকটা নীরবতা। অতঃপর বলতে থাকেন এই সূর্যসন্তান। তার ভাষায়, “জগন্নাগঞ্জ থেকে জামালপুরের মূল যোগাযোগটা হতো বাউশি রেলব্রিজের মাধ্যমে। নির্দেশ আসে ওই রেল ব্রিজটা ভেঙে দিয়ে জগন্নাথগঞ্জের সাথে জামালপুরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার। চরে বসে এ অপারেশনের প্ল্যান হয়। সুজাবত কমান্ডার, লুৎফর রহমান লোদা, মান্নান কমান্ডার, মাসুম খান, আমিরুল কমান্ডার প্রমুখ কোম্পানি কমান্ডাররা একত্রে পরিকল্পনা করেন। বাউশি ব্রিজ ভাঙ্গার দায়িত্ব পড়ে দারোগা কোম্পানির ওপর। কিন্তু কাজটা খুব সহজ ছিল না। কারণ ব্রিজের পশ্চিম পাশে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি।

দারোগার নেতৃত্বে আমরা ছিলাম ১৭ জন। ১০ অক্টোবর ১৯৭১ মূল অপারেশনটা হয়। এক্সপ্লোসিভ ও ডেটোনেটর নিয়ে শ্যামগঞ্জ কালিবাড়ি থেকে আগের রাতে রওনা হই। সরিষাবাড়ি বাউশির উত্তর দিকে আরও দুটি স্টেশন আছে। প্রথমে বাটারা স্টেশনের যাই। এর উত্তর পাশে একটা ব্রিজ আছে। ওখানে ছিল বাইশ জনের মতো রাজাকার। ব্রিজ পাহারা দিতো তারা। গোলাগুলি করলে ওরা ভয়ে আত্মসমর্পন করতে চায়। কিন্তু তাদের আত্মসমর্পন করাতে কে যাবে? কেউ রাজি হয় না। পরে আমি, দারোগা, রফিক ও নৌ বাহিনীর সামাদ– এই চারজন ওদের ক্যাম্পে ঢুকে হ্যান্ডস অ্যাপ করাই। অতঃপর ওদের পাঠিয়ে দিই কালিবাড়িতে।

প্রথম বাটারা এবং পরে আরেকটি স্টেশন পুড়িয়ে দেই। এরপর পজিশনে যাই বাউশি ব্রিজের কাছাকাছি, ছোট্ট একটা কামার বাড়িতে। বাম সাইডে ছিল রেললাইন। তার পাশে আমাদের কাভারিং পার্টি। পাক বাহিনীরা হাত উপরে তুলে ব্রিজ পার হতে থাকে। সবাই ভাবে তারা আত্মসমর্পন করবে। আসলে ব্রিজ পার হাওয়ার জন্য ওটা ছিল তাদের কৌশল। ওরা বাজারের পাশ দিয়ে নেমেই এগোতে থাকে। কিন্তু আমাদের কাভারিং পার্টি তাদের প্রতিরোধ করে না। ওই সুযোগে ওরা আমাদের ৫০-৭০ গজ সামনে এসে অ্যাটাক করে।

সকাল তখন ৯টার মতো। তুমুল গোলাগুলি চলছে। ওদের ব্রাশের গুলিতে প্রথম মারা যায় সহযোদ্ধা জালাল, কামারপাড়া বাড়ি ছিল তার। হঠাৎ নৌবাহিনীর সামাদের পেটেও শেল এসে পড়ে। তিনি খুব সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। যেকোনো অপারেশনেই আগে যেতেন। ব্রাশফায়ারের গুলিতে শহীদের মাথার খুলিও উড়ে যায়। ওদের দিকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম। কিছুই করতে পারিনি আমরা। একাত্তরের রণক্ষেত্রে বহু বীর এভাবেই দেশের জন্য জীবন দিয়েছিলেন অকাতরে।

সামনে কী অপেক্ষা করছে কেউ জানে না। শাহজাহান আর দারোগারও গুলি লাগে ওইদিন। আশেপাশের সবাই রক্তাক্ত। আমি ধানখেতের ভেতর দিয়ে ক্রলিং করে সাইডে এগোই। হঠাৎ পায়ে একটা ধাক্কা লাগে। মনে হলো কেউ বাম পা টান দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। পরনে খাকি হাফপ্যান্ট। পেছনে কোমরের বাম দিকে হালকা জ্বলছে। হাত দিয়ে দেখি রক্ত। আঙ্গুল দিতেই হাড়ের গুড়ো বেরিয়ে আসে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ধানখেতে আসার জায়গাটা রক্তে লাল হয়ে গেছে। তখনই বুঝে যাই গুলি খাইছি। প্রথমে ভয় পেয়ে যাই। খানিক পরেই নিজেকে সামলে নিই, জীবন তো বাঁচাতে হবে।

রক্ত গিয়ে ক্রমেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সামনে ছিল পুকুর। পুকুরের পশ্চিমপাড়ে আমি, রাজাকার আলবদর আর আর্মিরা পূর্বপাড়ে। পেছনে ছিল প্ল্যাটুন কমান্ডার রফিকুজ্জামান বিএসসি। তাকে হ্যান্ডস আপ করতে বলে ওরা। উত্তর পাশে ইটখোলায় আবুল কালাম আজাদকে দেখি লেলিন পজিশনে ফায়ার দিতেছে। গুলি লাগার পরও আমি সাঁতর কেটে ওপাড়ে উঠি। ওরা আমার দিকে ক্রমাগত গুলি করছে। কানের কাছ দিয়ে গুলি চলে যাচ্ছে। সামনে ছিল শাহজাহান। তার পায়ের গোড়ালিও উড়ে গেছে। সে পড়ে গোঙ্গাচ্ছে, এগোতে পারছে না। কোনোরকমে উঠে একটা বাড়িতে যাই আমি। সেখানে এক বুড়ি মা তুলে নিয়ে আমাকে পানি খাওয়ায়। পরে সহপাঠী আব্দুল হামিদ আমাকে নৌকায় নিয়ে চলে যায় শ্যামগঞ্জ কালিবাড়ি। জ্ঞান তখনও ছিল। সেখানে এক গ্রাম্য চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। অতঃপর সহযোদ্ধাদের সহযোগিতায় চিকিৎসার জন্য আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রথমে মাহেন্দ্রগঞ্জ, পরে তুরা ও গৌহাটি হয়ে লক্ষ্ণৌ এবং শেষে বিহার সামরিক হাসপাতালে।

কোমরের ভেতর থেকে গুলি বের করে আনা হয় লক্ষ্ণৌ হাসপাতালে, অপারেশন করে। ক্ষত স্থানে বেশ কয়েকদিন চলে ড্রেসিং। ড্রেসিংয়ের সময়ে ভেতরে গজ ঢুকিয়ে পরিষ্কার করা হতো। কী যে কষ্ট হতো তখন। মনে হয়েছে জীবন বের হয়ে যাবে। দেশ স্বাধীনের খবরও পাই বিহার সামরিক হাসপাতালে। সকল যন্ত্রণা ভুলে তখন স্বাধীনতার আনন্দে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি। ওইদিনের অনুভূতি ঠিক বোঝাতে পারব না ভাই। অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতাকে। এটা এখন আপনারা অনুভবও করতে পারবেন না।”

যে দেশের স্বপ্ন দেখে যুদ্ধে গেলেন, স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিলেন– স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?

এ মুক্তিযোদ্ধার অকপট উত্তর, “স্বাধীনতা পাইছি। কিন্তু আমাদের মন তো স্বাধীন হয় নাই। একটা সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা চাইছিলাম। যে দেশে অভাব থাকবে না, দুষ্কৃতিকারী থাকবে না, দুর্নীতি থাকবে না। কিন্তু সেটা তো এখনও হয় নাই।”

তিনি আরও বলেন, “সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করলেই দেশ আরও এগোবে। সরকার বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছে। কিন্তু তৃণমুলের নেতারা তো সে চেতনার ভেতর নাই। সবাই সবার মতো পয়সা কামায়। আর তাদের অপকর্মের দোষ এসে পড়ে সরকারপ্রধানের ওপর। এটাও বন্ধ করতে হবে। তা না হলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হবে কীভাবে?”

তবে স্বাধীনতাবিরোধী ও জামায়াতপন্থী অনেকেই স্বাধীন এই দেশকে পাকিস্তান বানাতে চায়। এদেরকে পাকিস্তান চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “পরাধীনতা আমরা দেখছি। ছয় আনা দিস্তা কাগজ কিনতে পারি নাই, অথচ এদেশেই কাগজ তৈরি হইছে। দামের কারণে চিনিও খেতে পারি নাই। বাঙালিরা বড় কোনো চাকরি পেত না। এখন গ্রামে গ্রামে সচিব পাবেন। অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে আমরা পেছনে ফেলেছি। তবুও তারা খুশি নন। আসলে স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকাররা এদেশের উন্নতি মেনে নিতে পারে না। এদের চরিত্রও কখনও বদলায় না।”

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগার অনুভূতি প্রকাশ করেন এই সূর্যসন্তান। বলেন, “দেশের উন্নতি দেখলে, মানুষের ভালো থাকা দেখলে আনন্দিত হই ভাই।”

খারাপ লাগে কখন?

“যখন দেখি টাকা ছাড়া কোনো কাজ হচ্ছে না। স্বার্থের জন্য চলছে দুর্নীতি। তখন কষ্ট লাগে। দুর্নীতির জন্য তো আমরা এ দেশ স্বাধীন করিনি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় দুর্নীতি থাকতে পারে না।”

প্রজন্মের হাত ধরেই দেশটা একদিন অনেক এগিয়ে যাবে। কিন্তু প্রজন্মকে ধরে রাখা ও তৈরি করার দায়িত্বও আমাদেরকেই নিতে হবে। এমনটাই মত দেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুস সামাদ। প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, “তোমরা স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকারদের কাছ থেকে সর্তক থেকো। নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলো। তোমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে মুক্তিযোদ্ধাদের দোয়া থাকবে সবসময়।”

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন