বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর নীতি-আদর্শের মিল এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার নীতি-আদর্শের মিল দেখেছিলেন। দুজনের ট্রাজিক মৃত্যুও কি এই নীতি-আদর্শের মিলের কারণেই?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 9 Jan 2023, 03:58 PM
Updated : 9 Jan 2023, 03:58 PM

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির পিতা। তার জন্ম ১৯২০ সালে, বাংলাদেশের এক নিভৃত পল্লী টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। তিনি রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম না নিলেও রাজনীতির কবি হয়ে উঠেছিলেন সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়। তার সময়ে রাজনীতির যারা ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র, তাদের সবাই ম্লান হয়েছেন মুজিবের ঔজ্জ্বল্যে। 

ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কন্যা। প্রিয়দর্শিনী হিসেবে পরিচিত, রাজনৈতিক পরিবারে ইন্দিরার জন্ম ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। সেই হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধুর চেয়ে তিন বছরের বড়। ইন্দিরা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পান ১৯৬৬ সালে। ওই বছরই তিনি ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই ছয় দফাই তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। 

দুই দেশের এই দুই নেতার নাম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা হয়ে যাওয়াটা বিস্ময়কর বৈকি! হয়তো কাকতালীয় নয়, কিন্তু কিছু মিল তো পাওয়া যায়ই। ইতিহাস নিয়ম মেনে না চললেও ইতিহাস অস্বীকার করা যায় না। 

একটু ফিরে দেখা যাক

পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর হাবভাব দেখে তিনি এটা বুঝেছিলেন যে বাঙালির অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হলে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে থেকে সেটা সম্ভব হবে না। তবে তিনি তখনই কমিউনিস্টদের মতো ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’ বলে হটকারি স্লোগান দিয়ে মাঠে নামেননি। তিনি মানুষকে প্রস্তুত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। শেখ মুজিবের তৎপরতা শাসকগোষ্ঠীও তীক্ষ্ণভাবেই নজরদারির মধ্যে রেখেছিল। তিনি যে শাসকগোষ্ঠীর জন্য বিপদ হয়ে উঠবেন– এটা বুঝেই তার জন্য বরাদ্দ হয়েছিল জেল-জুলুম। তিনি নত হননি। আপসের পথে হাঁটেননি। তাকে দমন করার যত চেষ্টা করা হয়েছে, তত তিনি বাঙালির হৃদয়ে বেশি ঠাঁই পেয়েছেন। তার সময়ের অন্য সব নেতাকে ছাড়িয়ে তিনি হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। 

সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে মানুষ ভোট দিয়েছিল পাকিস্তানের সরকার গঠনের জন্য। কিন্তু গণবিরোধী শাসকেরা শেখ মুজিবের হাতে তথা বাঙালির হাতে শাসনভার তুলে না দিয়ে পাকিস্তানের ভাঙন অনিবার্য করে তুলল। ওরা শুরু করে বাঙালি নিধনযজ্ঞ আর বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালি শুরু করে স্বাধীনতার যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ। বীর বাঙালি অস্ত্র তুলে নেয়। বাঙালিকে আর দাবিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা ছিল এককথায় অতুলনীয়। ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের যুদ্ধজয় সম্ভব হতো কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা কমে আসছিল। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ছাড়া তার সামনে হয়তো বিকল্প থাকবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চিন্তা তার মাথায় আগেই এসেছিল। ষাটের দশকের প্রথম দিকেই তিনি তার ভাবনার কথা কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহের কাছে তুলে ধরেছিলেন।

সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা আরও সংহত রূপ নিয়েছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা যাবে না, তবে আলাদা হতে চাইলে যে সেটা শান্তিপূর্ণ উপায়ে হবে না, এটাও তিনি জানতেন। তিনি জনগণকে একটি কঠিন লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে তুলছিলেন। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তিনি কোনো যোগাযোগ করেছিলেন কিনা, যোগাযোগ থাকলে সেটা কোন পর্যায়ে ছিল– এসব বিষয়ে কোনো বিশ্বাসযোগ্য বা নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার যোগাযোগ বা আলাপ-পরিচয়ের বিষয়েও কিছু জানা যায় না।

তবে একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি জাতির ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়লে এবং বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে যে অসম যুদ্ধ শুরু হয় তার চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কার্যত ধাত্রীর ভূমিকা পালনে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এসেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলে। তিনি বেঁচে আছেন কিনা, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছিল। তার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাকে মুক্তি দিতে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টিতে বিশ্বজনমত গড়তেও ইন্দিরা গান্ধী রেখেছিলেন অসাধারণ অবদান।

মুজিবনগর সরকার গঠন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দান, শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্য দেওয়ার মতো সব বিষয়েই ইন্দিরা গান্ধী অকল্পনীয় দৃঢ়তা দেখিয়েছেন।

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম দেখা হয় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরার পথে। তিনি ৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে প্রথম গিয়েছিলেন লন্ডন। লন্ডন থেকে ১০ জানুয়ারি দিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দিল্লি বিমান বন্দরে তাকে স্বাগত জানান ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। দিল্লির রাস্তায় বঙ্গবন্ধুর গাড়িবহরে পুষ্প ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। হাজার হাজার নারী-পুরুষ দিল্লি বিমানবন্দরে সমবেত হয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক শেখ মুজিবকে একনজর দেখার জন্য।

বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে দিল্লিতে আয়োজিত সমাবেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “তার শরীরকে জেলখানায় বন্দি করে রাখা হলেও তার আত্মাকে কেউ বন্দি করে রাখতে পারেনি। তার প্রেরণায় বাংলাদেশের মানুষ সয়হসিকতার সঙ্গে লড়াই করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। তিনি প্রেরণা দিতে এখন ভারতে আমাদের কাছে এসেছেন। এই যুদ্ধের সময় আমরা ভারতের পক্ষ থেকে তাদের জন্য তিনটি কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

এক) যে শরণার্থী ভারতে আছে, তারা সময় হলে ফিরে যাবে।

দুই) আমরা মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করব এবং বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়াব।

তিন) শেখ সাহেবকে আমরা দ্রুত জেল থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করব।

আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি।”

এরপর বঙ্গবন্ধু ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রথম রাজনৈতিক ভাষণ দেন। তিনি ইংরেজিতে ভাষণ শুরু করলে উপস্থিত জনতা সমস্বরে বাংলায় বলার অনুরোধ করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীর দিকে তাকালে তিনি স্মিত হাসি দিয়ে বলেন, দে নিড বেঙ্গলি।

তারপর বঙ্গবন্ধু ‘ভাই ও বোনেরা' বলে বক্তব্য শুরু করতেই উপস্থিত জনতা উল্লাসধ্বনিতে চারদিক মুখরিত করে তোলেন।

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, “আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য ও সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছেন, চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলবে না। ব্যক্তিগতভাবে আপনারা জানেন আমি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধকার সেলের মধ্যে বন্দি ছিলাম কিছুদিন আগেও। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আমার জন্য দুনিয়ার এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তিনি চেষ্টা করেন নাই আমাকে রক্ষা করার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে কৃতজ্ঞ। আমার সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার কাছে এবং তার সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। আমার জনসাধারণ ভারতবর্ষের জনসাধারণের কাছে কৃতজ্ঞ। আর যেভাবে এক কোটি লোকের খাওয়ার বন্দোবস্ত এবং থাকার বন্দোবস্ত আপনারা করেছেন– আমি জানি ভারতবর্ষের মানুষ তারাও কষ্টে আছে, তাদেরও অভাব-অভিযোগ আছে, তা থাকতেও তারা সর্বস্ব দিয়েছে, আমার লোকরে সাহায্য করার জন্য, চিরদিন আমরা তা ভুলতে পারব না।

আমরা আশা করি, আপনারা জানেন, বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে, আমি সকল প্রকার সাহায্য সহানুভূতি আশা করি এবং এ-ও আশা করি, দুনিয়ার শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক যে মানুষ আছে তারা এগিয়ে আসবে আমার মানুষকে সাহায্য করার জন্য।

আমি বিশ্বাস করি সেক্যুলারিজমে, আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে, আমি বিশ্বাস করি সোশ্যালিজমে।

আমাকে প্রশ্ন করা হয় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শের এত মিল কেন? আমি বলি, এটা আদর্শের মিল, এটা নীতির মিল, এটা মনুষ্যত্বের মিল, এটা বিশ্বশান্তির মিল।”

মুজিব-ইন্দিরার এই প্রথম সাক্ষাৎ ছিল দুজনের জন্যই গভীর আবেগের বিষয়। আর এই প্রথম সাক্ষাতের মাধ্যমেই দুই সরকারপ্রধানের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কেরও ভিত্তি তৈরি হয়েছিল।

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার নীতি-আদর্শের মিল দেখেছিলেন। দুজনের ট্রাজিক মৃত্যুও কি এই নীতি-আদর্শের মিলের কারণেই? পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারতে চেয়েছিল। কবরও খোড়া হয়েছিল। কিন্তু ফাঁসি দিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু বড়াই করে বলতেন, তাকে কোনো বাঙালি মারতে পারে না। স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল তার প্রত্যাশিত। অথচ ঘটল অপ্রত্যাশিত মৃত্যু। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট একদল বাঙালি সৈনিকের হাতেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিহত হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। 

কয়েক বছরের ব্যবধানে নির্মমভাবে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধীও। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর বিশ্বস্ত দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে মৃত্যু হয় তার। বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন অবস্থায় রাজনীতির পাঠ নিয়ে সেরার সেরা হয়েছেন। দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। আবার দুজনই দেশের জন্য আত্মদানের অমর দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। দুজনের নীতি-আদর্শের মিল যে অটুট বন্ধন তৈরি করেছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তা প্রেরণাদায়ী ও নিয়ামক ভূমিকা রেখেছিল।