কেমন হবে আগামীর বৈশ্বিক রাজনৈতিক অর্থনীতি?

এই বছরের সবচেয়ে আলোচিত খবর ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ, ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়া— বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ ভোট দেবে। বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশ, সরকার ও সংস্থার নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটবে।

মঞ্জুরে খোদামঞ্জুরে খোদা
Published : 2 Jan 2024, 07:49 AM
Updated : 2 Jan 2024, 07:49 AM

করোনা বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিকে আরেক সংকটে নিয়ে যায়। ওই সংকট কাটিয়ে না উঠতেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ তাকে আরও ভয়াবহ রূপ দেয়। চলমান এই সংকটের মধ্যেই নতুন বছরে প্রবেশ করেছে বিশ্ব। বছরের শুরু ও শেষ যুদ্ধের মধ্যেই থেকে গেল বিশ্ব। সঙ্গতই সবার ভাবনা কেমন যাবে নতুন বছর?

এই বছরের সবচেয়ে আলোচিত খবর ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ, ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়া— বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ ভোট দেবে। বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশ, সরকার ও সংস্থার নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটবে। যা বিশ্ব গণতন্ত্রের জন্য এক অভূতপূর্ব বিষয়।

৫ নভেম্বর আমেরিকায়, ১৭ মার্চ রাশিয়ায়, এপ্রিল-মে ভারতে, ৬-৯ জুন ভোট। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, ইউক্রেইন, তাইওয়ানসহ বেশকিছু দেশের নির্বাচন হবে এবার। তবে পরাশক্তিসহ কয়েকটি দেশের নেতৃত্ব ও সরকার পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করছে অনেক সমীকরণ। বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতি-অর্থনীতিতে পড়বে তার প্রভাবও।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় আছেন ২৪ বছর ধরে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর গত দুই দশকে রাশিয়াকে শুধু তিনি শক্তিশালীই নয় বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। ২০২২-এ ইউক্রেইনে সামরিক অভিযানে রাশিয়া চাপের মধ্যে থাকলেও ক্রমেই সামলে উঠেছেন। দেশের অর্থনীতিকেও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। কোনো দৈব না ঘটলে আসন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি পঞ্চমবারের মতো রাশিয়ার ক্ষমতায় থাকছেন। সেখানে তাঁর কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী গড়ে ওঠেনি। সেটা হলে ২০৩০ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় থাকবেন।

নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রপতি ডনাল্ড ট্রাম্প শক্ত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবেন। যিনি ২০২০ সালেই নিজের পরাজয় মেনে নেননি। সুতরাং এবার তিনি আরও বেপরোয় হয়ে মাঠে থাকবেন। তিনি নির্বাচিত হলে সেটা মার্কিন গণতন্ত্র ও ভবিষ্যত বিশ্ব রাজনীতির জন্য বিশেষ অবস্থা হিসেবে নির্ধারিত হবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে তিনি আরও সুসংহত করেছেন। অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতে তাদের অবস্থান আরও এগিয়েছে। আঞ্চলিক রাজনীতির দক্ষ খেলোয়ার হিসেবে নিজের অবস্থান ও গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছেন। এপ্রিল-মের নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হলে ২০২৯ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় থাকবেন।

৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের একতরফা নির্বাচনও আঞ্চলিক রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচন নিয়ে মার্কিন প্রশাসন সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেও কোনো সুবিধা করতে পারেনি। সবকিছু ঠিক থাকলে শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় থাকবেন।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নানা দিক থেকে টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে যেমন তার গুরুত্ব আছে আবার বিশ্ব রাজনীতিতেও রয়েছে নানা প্রভাব ও সমীকরণ। চীন, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, কাশ্মীরসহ অন্যান্য আঞ্চলিক ইস্যু এর সাথে যুক্ত রয়েছে।

২০২৪-এর জুনে ইউরোপিয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ থেকে ৪০০ মিলিয়নেরও বেশি ভোটার ৭২০ জন ইউরোপিয় সংসদ সদস্য বাছাই করবেন। স্বাভাবিকভাবে এই নির্বাচনও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, শান্তি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচন মধ্যপ্রাচ্য তথা মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা বৃদ্ধির কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তাইওয়ানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাই ​​ইং-ওয়েনের ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষে অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল কুওমিনতাং তাইওয়ানের সুরক্ষা, সমৃদ্ধির প্রশ্নে চীনের অখণ্ডতার পক্ষে। সে কারণে তাইওয়ানের নির্বাচন চীন-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। চীনকে রাজনীতি ও অর্থনৈতিকভাবে চাপে রাখা মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তির বড় চ্যালেঞ্জ। চীনকে উপেক্ষা করে মার্কিন প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের তাইওয়ান ভ্রমণ উভয় দেশের সম্পর্ক বিরূপ করেছে।

বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধ হলেও রাশিয়া-ইউক্রেইন ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ বিশ্ব পরাশক্তির ক্ষমতা ও আধিপত্যের প্রধান সমীকরণ হয়ে উঠছে। ইউক্রেইন-ইসরায়েলকে ঘিরে মার্কিন, পশ্চিমা শক্তি, ন্যাটোর প্রভাব-ক্ষমতা, বিরোধ ইতোমধ্যেই চোখে পড়ছে। পশ্চিমাদের তহবিল ও রসদেই শুধু টান পড়েনি, তাদের কেউ কেউ জানিয়েও দিয়েছে তারা আর কোনো অস্ত্র-অর্থ দিতে পারছে না। ইউক্রেইন প্রশ্নে হাঙ্গেরি ইউরোপিয় ইউনিয়নে প্রবল বিরোধী হয়ে উঠছে। অন্যদিকে ন্যাটের প্রভাবশালী সদস্য তুরষ্কও ইসরায়েল প্রশ্নে তাদের বৈরীতার কথা জানিয়ে দিয়েছে।

বাইডেনের অনুরোধ সত্ত্বেও মার্কিন সিনেট ইউক্রেনের জন্য তহবিল আটকে দিয়েছে।এমনকি তারা ইসরায়েলকে সাহায্য ও সমর্থন দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ক্ষিপ্ত বাইডেন সিনেটরদের পুতিনের বন্ধু বলে গালি দিতে ছাড়েননি!

ইউক্রেইনে জেলেনস্কি অস্ত্র ও অর্থ সংকটের কথা পশ্চিমা শক্তিকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। পশ্চিমাদেরও অবস্থা হয়েছে শ্যাম রাখি না কূল রাখি। একদিকে আভ্যন্তরীণ সংকট অন্যদিকে ইউক্রেইন ও ইসরায়েল সংকট। ইসরায়েল সমর্থন করতে গিয়ে যুদ্ধাপরাধ ও বর্বরতাকে সমর্থন করছেন তারা। এ জন্য নিজ দেশগুলোতেও বহির্বিশ্বে তাদের কথিক মানবাধিকার রক্ষার ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তা সত্ত্বে তারা বৃহৎ বাণিজ্যিক শক্তি ইসরায়েলকে নিয়ে ব্যস্ত। ইসরায়েল তাদের বৃহত্তম অস্ত্রের ক্রেতা। আর ইসরাইল ইস্যু হয়েছে রাশিয়ার জন্য শাপেবর।

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ সহসাই শেষ হচ্ছে না। পুতিন পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন রাশিয়ার শর্ত পূরণ হলেই কেবল যুদ্ধ শেষ হতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘ইউক্রেইনের সর্বত্র রাশিয়ান বাহিনী নিজেদের শক্ত অবস্থান রেখেছে।’ অন্যদিকে ইউক্রেইন সেনাবাহিনী ও জেলেনস্কির দ্বন্দ্বের কথাও গোপন নয়। যুদ্ধের মধ্যেও নির্বাচনের জন্য চাপ তৈরি হচ্ছে ইউক্রেইনে। সেখানেও পশ্চিমাপন্থী নেতৃত্বে পরিবর্তনে আসলে অবাক হবার কিছু থাকবে না।

বাইডেন বলছেন, পুতিনকে আর জিততে দেয়া যাবে না! বাইডেন প্রশাসন পুতিনকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিতে নানাভাবে চেষ্টা করেছে। সর্বশেষ পুতিন কাছের লোক প্রিগোজিনকে দিয়েও সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু সফল হয়নি। পুতিনকে ক্ষমতা থেকে কি সরাবেন বাইডেনকেই হয়তো আসন্ন নির্বাচনে সরে যেতে হবে। পুতিন বিশ্বরাজনীতির আরও দক্ষ ও অভিজ্ঞ খেলোয়ার হিসেবে থেকে যাবেন।

বিশ্লেষকদের মতে, আগামীতে বৈশ্বিক গণতন্ত্র চাপের মধ্যে থাকবে, কর্তৃত্ববাদী ঝোঁক-প্রবণতা বাড়বে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ধারা-প্রকৃতিতেও পরিবর্তনের পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক, উদারনৈতিক শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাষ্ট্রগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জের হবে বছরটি। কেননা পরিস্থিতি বলছে, বিশ্বব্যাপী রক্ষণশীল ও কর্তৃত্ববাদী ধারা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

২০২৪-এ পরাশক্তিসমূহের নির্বাচনের কারণে বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রভাব হবে বহুমূখী ও সূদুরপ্রসারী। ৪০টি দেশের দখলে বিশ্বের মোট জিডিপির ৪২ শতাংশ; এসব দেশের মধ্যে চারটি নির্বাচন সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখবে বৈশ্বিক ব্যবস্থায়। বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়া, সংস্থা, ব্যক্তি এ নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কোনো মাধ্যমই খুব আশাবাদী কিছু শোনাতে পারছে না। নানা আশঙ্কার কথা বলছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির হার ৫.৮ শতাংশ হবে বলে ধারণা দিয়েছে। যদিও মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের ২০২৪ সালে শক্তিশালী বৈশ্বিক অর্থনীতির কথা বলছে। তাদের এক প্রতিবেদন বলছে, এ সময়ে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হবে ২.৬ শতাংশ।

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসন আর কতদিন চলবে? ইউক্রেইনের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ থামবে কবে? যুদ্ধ কি পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে? নাকি তা আরও দেশ-মহাদেশে ছড়িয়ে পড়বে? এমন প্রশ্ন উঠছে। বিশ্ব কি তাহলে আরও অসহিঞ্চু হয়ে উঠবে? ওই সম্ভাবনাও অমূলক নয়।

যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির সাথে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক কেমন হবে? মধ্যপ্রাচ্যের সাথে মার্কিনিদের সম্পর্ক যখন শীতল তখন পুতিন ওই অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তারা বলছেন, পুতিন হচ্ছেন তাদের প্রাণের বন্ধু।

চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে ব্রিকসের সম্প্রসারণ এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিকল্প মুক্ত-মানবিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান। এই সমীকরণের সঙ্গে পারস্পরিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়ও ক্রমশ বদলে যাবে। যেমন ইউক্রেইন যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়ার বাণিজ্যিক অংশীদার পরিবর্তিত হয়ে ইউরোপ থেকে এশিয়ামুখী হয়েছে। বাকিটা সময়ই বলবে বিশ্ব কি আবার স্নায়ুযুদ্ধের যুগে প্রবেশ করছে নাকি এর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার রাজনীতি ও অর্থনীতি।