কীসের বিনিময়ে কর্নেল অলির মিথ্যাচার?

মেজর রফিক, কর্নেল অলির লেখনির জবাবে সংসদে দাঁড়িয়েই দিয়েছেন, সমস্ত তথ্য উপাত্তসহ প্রমাণ করেছেন যে কর্নেল অলিই বেয়াদবি এবং মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে।

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 5 March 2023, 10:50 AM
Updated : 5 March 2023, 10:50 AM

২০১২ সালের এক সকালে ডেইলি স্টার পত্রিকা খুলেই এর প্রথম পৃষ্ঠার অর্ধেক জুড়ে ছবিসহ এক বিরক্তিকর খবর চোখে পড়েছিল, যাতে উল্লেখ ছিল কর্নেল অলি নামক এক মুক্তিযোদ্ধা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে কয়েক একর জমি দখল করে সেখানে স্থাপনা গড়েছেন।

তখনই স্বপ্রণোদিত রুল জারি করায় কর্নেল অলি আমাদের আদেশক্রমে আমার নেতৃত্বের বেঞ্চে হাজির হন। তার মুখে কোনো লজ্জার ভাব ছিল না। মনে হচ্ছিল, মনে মনে ভাবছেন কত লোকই তো সরকারি ভূমি দখল করে, আমিও তাই করেছি, তাতে কী এমন হয়েছে? হয়তো এ-ও ভাবছিলেন এই বিচারপতি বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। প্রথম আধাবেলা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে বিরতির পর কার্যক্রম শুরু হলে বুঝতে পারলাম তখন তিনি বেশ লজ্জাকাতর, সম্ভবত বহু লোকের উপস্থিতিতে আধাবেলা অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকার কারণে। প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিলাম ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিসহ প্রতিবেদনটি সত্যি কিনা? জবাব না দিয়ে তিনি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দ্বিতীয়বার বলেছিলাম জবাব না পেলে ধরে নেব সংবাদটি সত্য এবং ভূমি দখলের দায়ে তাকে জেলে পাঠানো হবে। এবার ভয়ার্ত মুখেই বলেছিলেন শিগগির তার স্থাপনা ভেঙ্গে জমি থেকে সরে যাবেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কিনা, সে প্রশ্নের জবাবে সগর্বে বলেছিলেন ‘নিশ্চয়ই’। ভূমিদস্যু হিসাবে অভিযুক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে তার লজ্জা হচ্ছে কিনা, সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন তিনি এখনই স্থাপনা ভাঙ্গার নির্দেশ দেবেন। আমি বলেছিলাম তার এই সিদ্ধান্ত আমাকে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে জেলে পাঠানোর দায় থেকে রক্ষা করল। পরবর্তীতে কক্সবাজারের ডেপুটি কমিশনার এবং পুলিশ সুপার আমাদের জানিয়েছিলেন কর্নেল অলি তার বেআইনি দখল এবং স্থাপনা গুড়িয়ে ফেলেছেন। ডিসি এবং পুলিশ সুপারকে ভর্ৎসনা করেছিলাম এই বলে যে তারা কেন আগে ব্যবস্থা নেননি? তারা বলেছিলেন আদালতের আদেশ না পেলে কর্নেল অলির স্থাপনা ভাঙ্গা কঠিন হতো। তারা যা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মুখ খুলে বলেননি, তা হলো কর্নেল অলি অত্যন্ত প্রভাবশালী লোক, যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তাদের জন্য সহজ ছিল না।

সম্প্রতি বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর রফিক পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছেন যে ১৯৭১-এ চট্টগ্রামে কর্মরত তৎকালীন মেজর জিয়া ২৫ মার্চ তারিখের রাত ১১.৪৫ মিনিটে যখন ‘সোয়াত’ নামক জাহাজ থেকে পাকিস্তানি সমরাস্ত্র খালাসের জন্য পাকিস্তানি সামরিক জিপে করে এগুচ্ছিলেন, তখন মেজর রফিক তাকে সে পথ থেকে বিরত থাকতে বললে জিয়া মেজর রফিককে ভয় দেখিয়ে বলেছিলেন তিনি (জিয়া) অবশ্যই পাকিস্তানি অস্ত্র খালাস করবেন কেননা তার ওপর কর্নেল জানজোয়ার নির্দেশ রয়েছে। এর পর জিয়া সোয়াত জাহাজের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন, যদিও তার ইচ্ছা পূরণ হয়নি, কারণ পথিমধ্যে বাঙালি সৈন্যরা জিয়ার পথ রুদ্ধ করেছিলেন।

মেজর রফিক ১৯৭২ সালেই ‘পিপলস ভিউ’ নামক একটি সাময়িকীতে এই কথাগুলো লিপিবদ্ধ করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে তিনি বই আকারে সেগুলো লিখেন। ১৯৮১ সালে মেজর রফিকের বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণেও একই কথা লিপিবদ্ধ করা হয়।

১৯৮১ সালে জেনারেল এরশাদ জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে আইন প্রণয়ন করতে চাইলে মেজর রফিকের পুস্তকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল যে ব্যক্তি ২৫ মার্চ রাত্রিতে পাকিস্তানি সমরাস্ত্র উদ্ধারে যাচ্ছিল, তাকে কী করে স্বাধীনতার ঘোষক বলা যায়? জিয়ার সাফাই গেয়ে মেজর রফিককে মিথ্যাচারী হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন, কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজ এবং কর্নেল আকবর, জিয়া যাদের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রী পদে বসিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করেছিলেন।

এরপর মুক্তিযুদ্ধকালের সেনাপ্রধান কর্নেল ওসমানী বলেছিলেন শাহ আজিজ এবং আকবর মিথ্যা বলছে, মেজর রফিক যা বলেছেন সেটাই সত্য। সংসদে মেজর রফিকের ভাষণ কর্নেল অলির গাত্রদাহের কারণ ঘটিয়েছিল বলে তিনি মেজর রফিককে মিথ্যাবাদী আখ্যায়িত করেছেন। মেজর রফিক, কর্নেল অলির লেখনির জবাবে সংসদে দাঁড়িয়েই দিয়েছেন, সমস্ত তথ্য উপাত্তসহ প্রমাণ করেছেন যে কর্নেল অলিই বেয়াদবি এবং মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পরেও যে জিয়া সোয়াত জাহাজ থেকে, পাকিস্তানি সমরাস্ত্র খালাসের জন্য এগুচ্ছিলেন এবং বাঙালি সৈন্যদের বাধার মুখেই সে যাত্রা পরিহার করেছিলেন, সে কথা কে না জানেন?

কুখ্যাত রাজাকারদ্বয় শাহ আজিজ এবং কর্নেল আকবরের বক্তব্যে অবাক হওয়ার কারণ নেই কেননা এদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার কথা সকলেই জানেন। ‘চোরের সাক্ষী মাতাল’ই হয়ে থাকে।

১৯৮৮ সালে আমি যখন যুক্তরাজ্য ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজারি সার্ভিসের আইন বিষয়ক উপ-পরিচালক তখন একদিন প্রয়াত গাফফার চৌধুরী সাহেব জেনারেল মীর শওকত আলিকে নিয়ে আমার দফতরে এসেছিলেন, আমি যাতে জেনারেল শওকতকে পরিবারসহ বিলেতে থাকার অনুমতির ব্যবস্থা করি। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শওকত সাহেবের শংকা ছিল দেশে গেলে জেনারেল এরশাদ তাকে জেলে ঢুকাবেন। সেদিন জেনারেল শওকত রাখঢাক না রেখেই বলেছিলেন জিয়াউর রহমান কখনো মন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি, বাঙালি সৈন্যদের ভয়ে তিনি ওপার যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। আলাপকালে গাফফার চৌধুরী সাহেব ছাড়াও আমাদের সংস্থার তখনকার পরিচালক মাইকেল বার্নস (প্রাক্তন এমপি) সাহেবও ছিলেন।

জিয়াউর রহমান যে সোয়াত জাহাজ থেকে পাকিস্তানি অস্ত্র খালাসের জন্য যাত্রা করেছিলেন, সে ব্যাপারে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম, তার ‘স্বাধীনতা ৭১’ নামক পুস্তকের ৪৩৪-৪৩৮ পৃষ্ঠায় যা লিপিবদ্ধ করেছেন, নিম্নে তা হুবহু ছাপানো হলো। বইটি কাদের সিদ্দিকী যিনি বাঘা সিদ্দিকী নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, কোলকাতায় বসে ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম প্রকাশ করেছিলেন। দেজ পাবলিশিং হাউজ, ১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কোলকাতা-৭০০০০৬, এর পক্ষে প্রকাশক ছিলেন সুধাংশু শেখর দে। বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য এই বইটি আমি অবশেষে একুশে পদকপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক স্বদেশ রায়ের নিকট থেকে সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি।

“শোনা যায়, ১৯৬৫ সালের পর চট্টগ্রামে মিজো বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণের জন্য চীনের সহায়তায় আইউব খান যে ‘মিজো গেরিলা সাহায্য ক্যাম্প’ খুলেছিলেন তাতে প্রায় এক বৎসর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান ‘প্রশিক্ষক’ হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ৬৫ সাল থেকে ৭০-এর জানুয়ারি, এ সুদীর্ঘ সময় তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।

৭০ সালের গোড়ার দিকে, চট্টগ্রামের বেঙ্গল রেজিমেন্ট ট্রেনিং সেন্টারে ৮ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের গোড়াপত্তন হয়। প্রায় পাঁচ বছর পর ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের (ব্যাটেলিয়ন) সহঅধিনায়ক হিসাবে আবার মেজর জিয়াউর রহমানকে বদলি করা হয়। তিনি সত্যিকার অর্থেই ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের গঠন ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত এই ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট অসম্পূর্ণ ছিল। পাঁচটি কোম্পানি নিয়ে একটি পদাতিক বাহিনী গঠিত হয়। ৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত নবগঠিত ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে সাড়ে তিনটি কোম্পানি ছিল। ৭০-এর ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের পর, পাকিস্তানের ইতিহাসে যখন এক চরম রাজনৈতিক উত্থান পতনের সূচনা হলো, তখন পর্যন্ত জিয়াউর রহমান তার রেজিমেন্ট গঠনের কাজে পুরোপুরিভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ৭১-এর মার্চের ১৫-১৬ তারিখে জিয়াউর রহমানের ব্যাটেলিয়ানের দুটি কোম্পানি চট্টগ্রাম জেটি ও আরেকটি কোম্পানিকে কালুরঘাট সেতু পাহারার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এই সময় কাজের সুবিধার জন্য জিয়াউর রহমান কালুরঘাটের কাছে বিএন কোয়ার্টার ও কন্ট্রোল রুম বসান।

২৪শে মার্চ পর্যন্ত জিয়াউর রহমান নিরুত্তাপেই কাটান। কিন্তু ২৫শে মার্চের মধ্য রাতে ব্যাটেলিয়নের বেশ কয়েকজন সদস্য জিয়াউর রহমানের কাছে নানা ধরনের কঠিন ও ভীতিপ্রদ খবর পৌঁছে দিতে থাকেন। ঐ সময়কার চরম রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সামরিক বিভাগের আভ্যন্তরীণ সন্দেহ, অবিশ্বাস, অসদ্ব্যবহার ও আক্রমণের প্রেক্ষিতে তাদের করণীয় কি, তা জানতে জিয়াকে বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। ২৫শে মার্চের রাত প্রচণ্ড উত্তেজনা ও উদ্বেগের মধ্যে কাটলো। ২৬শে মার্চ সকালে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে জিয়াকে ডেকে পাঠানো হলো। নানা কিছু ভেবে জিয়া ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে যাওয়া স্থির করেন। কিন্তু তার কিছু সহকর্মী তাকে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে যেতে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করেছিলেন।

এত অনুরোধ ও নিষেধ উপেক্ষা করেও তিনি একখানা জীপে ইবিআরসি ক্যান্টনমেন্টের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। তার বেরিয়ে যাওয়ার সময় ৮ম রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ শিবিরে ছিলেন না। তিনি শিবিরে এসেই কমান্ডার কোথায় জানতে চান। কমান্ডার ইবিআরসি হেডকোয়ার্টারের দিকে গেছেন বলে সৈনিকরা তাকে জানালে, ক্যাপ্টেন অলি উন্মাদের মতো একটা মিলিটারি মোটর সাইকেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছোটেন। টাইগার পাসের কাছে তিনি জিয়ার জীপের গতিরোধ করে দাঁড়ান। জিয়ার গাড়ির সামনে অলি তার মোটর সাইকেলটি ফেলে দিয়ে চালকের আসনে বসা জিয়াকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘স্যার, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’ জিয়া স্বাভাবিকভাবেই বললেন, ‘ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছি। ব্রিগেডিয়ার ডেকে পাঠিয়েছেন।’ অলি চিৎকার করে উঠেন, ‘আপনি এখনও ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছেন? গেলেই আপনাকে গুলি করবে। আপনি জানেন কি, গতকাল চারশ’ বাঙালি রিক্রুটকে গুলি করে হত্যা করেছে? কুমিল্লা বেঙ্গল রেজিমেন্ট লাইন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। কুর্মীটোলা ও জয়দেবপুর বেঙ্গল রেজিমেন্টের লাইনের উপর ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। এই সমস্ত জানার পরও কোন সাহসে আপনি ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছেন?’

‘কি করবো? ক্যান্টনমেন্টে না গেলে যে কোর্ট মার্শাল হবে।’ এবার ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘আপনি পাগল হয়ে গেছেন নাকি? কিসের কোর্ট মার্শাল? গুলি, গুলি করে মারবে ওরা। আপনি কিছুতেই ক্যান্টনমেন্টে যেতে পারবেন না,’ বলেই ক্যাপ্টেন অলি তার রিভলভার উঁচিয়ে বলেন, ‘আপনাকে এখনও কমান্ডার হিসাবে মানি। কিন্তু আপনি যদি ক্যান্টনমেন্টে যেতে চান তাহলে আমিই আপনাকে গুলি করবো। পশ্চিমাদের হাতে গুলি খেয়ে মরার চেয়ে বাঙালির হাতে গুলি খেয়ে মরে অনেক শান্তি পাবেন।’ অতিশয় আতঙ্কিত ও উত্তেজিত ক্যাপ্টেন অলি এই কথা বলেই জীপের সামনের সীটে বসে পড়েন। এবার অনুরোধ নয়। আদেশের সুরে বললেন, ‘গাড়ি ঘুরান।’ মেজর জিয়া ক্যাপ্টেন অলি আহমেদের কথামতো গাড়ি ঘুড়িয়ে নেন। তারপর তারা শহরের মধ্যে এসে কালুরঘাট ও চট্টগ্রামের রাস্তার এক পাশে একটি গাছের নিচে বসে পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে ভাবতে শুরু করেন। এই সময় সেখানে আরো দু’জন ক্যাপ্টেন ও একজন লেফটেন্যান্ট এসে উপস্থিত হন। বেশ কয়েকজন বাঙালি সামরিক অফিসারদের দেখে খবরের কাগজের জনৈক হকার চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ অফিসে ছুটে গিয়ে খবর দেয়। খবর পেয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও গণপরিষদ সদস্য আবদুল হান্নান, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহান ও আরো কয়েকজন এসে প্রচুর সমাদর করে তাদের সংগ্রাম পরিষদ অফিসে নিয়ে যান।

বাঙালি সামরিক অফিসাররা তখন সংগ্রামী বাঙালিদের কাছে মহামূল্যবান। চট্টগ্রাম বেতর কেন্দ্র তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণে। ইতিমধ্যেই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ নামে চট্টগ্রাম রেডিও স্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা বারবার প্রচার করা হচ্ছিল। জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, আবদুল হান্নান, এম এ মান্নান ও অন্যান্য বেশ কয়েকজন নেতা স্বাধীনতার পক্ষে হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেশবাসীকে অনুরোধ জানিয়েছেন। সেই সময় প্রভাবশালী কোন লোক পাওয়া গেলেই তাকে দিয়ে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান প্রচার করা হচ্ছিল। দু’তিনজন আনসার অ্যাডজুট্যান্ট, পুলিশের সাবেক ডিআইজি এ ধরনের কিছু লোকের আবেদনও প্রচার করা হয়েছে। এর ঠিক পরেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের পেয়ে সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে যান। হান্নান সাহেব সামরিক অফিসারদের অনুরোধ করেন। ‘আপনাদের নেতা বেঙ্গল রেজিমেন্টকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে একটা আবেদন প্রচার করুন।’ তখন একজন সামরিক অফিসারের আবেদন দেশবাসীর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বারবার সামরিক অফিসারদের বুঝিয়ে বলা হচ্ছিল। এত বুঝিয়ে বলা ও অনুরোধ করা সত্ত্বেও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ও পাক-সামরিক বাহিনীর প্রতি তখন পর্যন্ত অকুণ্ঠ সমর্থক মেজর জিয়াউর রহমানের মধ্যে কোন ভাবান্তর ঘটলো না। বাঙালি সামরিক অফিসারদের মধ্যে সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোন বিবৃতি বা আবেদন প্রচারে ঘোর আপত্তি জানান। এখানেও ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ এগিয়ে আসেন। তিনি জিয়াকে জোরের সাথে বলেন, ‘আপনি বাঙালি সৈনিকদের যুদ্ধে অংশ নেয়ার আবেদন না জানালে আমাদের মধ্যে যিনি সিনিয়র, তিনিই আবেদন রাখবেন। তবে আপনার আবেদন না জানানোর কোন কারণ খুঁজে পাই না। আমরা তো আর ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেতে পারছি না। আমাদের সামনে এখন দুটি পথ খোলা, হয় জয়, নয় মৃত্যু। এর মাঝামাঝি কি কোন পথ আছে? জিয়া এবারও অলি আহমেদ ও অন্য দু-তিন জন সহকর্মীর চাপাচাপিতে বিবৃতি প্রচারে রাজী হলেন। সাথে সাথে তার বক্তৃতা রেকর্ড করার জন্য একটি টেপ রেকর্ডার আনা হলো। এখানে তিনি প্রথম নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে বক্তব্য রাখেন। তার ঘোষণার শুরুটা ছিল এই রকম, ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।’ রেকর্ড করার সময় প্রবল উত্তেজনায় কেউ খেয়াল করেন নি জিয়া সাহেব কি বলছেন। রেডিও সেন্টারে যখন সম্প্রচার করা শুরু হলো, তখন ত্রুটিটা ধরা পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রচার বন্ধ করা হলো। এ কি বলছেন? কে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট? কে স্বাধীনতার ঘোষক? টেপ রেকর্ডার নিয়ে বেতারের লোক আবার সংগ্রাম পরিষদ অফিসে ছুটে এলো। সংগ্রাম পরিষদের নেতারাও রেডিওতে জিয়ার বক্তৃতার প্রথম লাইনটি শুনে ‘থ’ বনে যান। সাথে সাথে রেডিও স্টেশনে ফোন করা হয়, কি ব্যাপার, এটা বন্ধ কর। রেডিও স্টেশন থেকে উত্তর এলো ‘আমরা আগেই বন্ধ করে দিয়েছি। টেপ নিয়ে আপনাদের কাছে আমাদের লোক চলে গেছে।’ এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে জিয়া সাহেব বলেন, ‘আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, আপনারা একটা খসড়া করে দিন।’

এবার সংগ্রাম পরিষদের নেতারা চিন্তাভাবনা করে পাঁচ/ছ লাইনের একটি খসড়া বক্তৃতা লিখে দিলেন। জিয়া বললেন, ‘আমি বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বাঙালি সৈনিক ও দেশবাসীর উদ্দেশ্যে আহ্বান জানাচ্ছি। আপনারা পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বাঙালি সৈনিক যারাই আছেন, তারা অস্ত্র ধারণ করুন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সুস্থ আছেন। তিনি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব নির্দেশ দিয়ে চলছেন। বিশ্ববাসীর কাছে আমি আবেদন জানাচ্ছি, আপনারা আমাদের সাহায্য করুন। আল্লাহ আমাদের সহায়। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’

বেতারে মেজর জিয়াউর রহমানের বক্তৃতা প্রচারের পর অন্যান্য অফিসারদের নিয়ে তিনি সোজা কালুরঘাট চলে যান। সেখান থেকে কোম্পানির লোকজন নিয়ে আবার চট্টগ্রামে ফিরে এসে চট্টগ্রাম-ঢাকা সড়ক ধরে এগুতে থাকেন। ঐ সময় চট্টগ্রাম জেটিতে অবস্থানরত তার দু কোম্পানি বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদেরও উইথড্র করে সাথে নিয়ে নেন। ঢাকার দিকে এগুতে দেখে সেই সময় হয়তো চট্টগ্রামের অনেকে ভেবেছিলেন, জিয়ার নেতৃত্বে সৈন্যরা ঢাকা থেকে এগিয়ে আসা পাক বাহিনীকে বাধা দিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আদতে কিন্তু তা হয়নি। তারা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার দিকে কিছুদূর এগিয়ে শুভপুর ব্রিজের কাছ দিয়ে ত্রিপুরা সীমান্তের শ্রীনগর বিওপি হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের উপর বিখ্যাত শুভপুর ব্রিজ ভারতীয় সীমান্ত থেকে বড় জোড় তিনশ গজ। চট্টগ্রাম-ঢাকা রাস্তা এইখানেই ভারতীয় সীমান্তর সবচেয়ে কাছ দিয়ে গেছে। অফিসার ও অন্যান্য সাজ-সরঞ্জামসহ মেজর জিয়া ভারতের ভিতরে অবস্থান নেন। শুধু সাধারণ সৈনিকরা ব্রিজটি আগলে বসে থাকে। ত্রিপুরা সীমান্তের শ্রীনগর বিএসএফ অবজারভেশান পোস্ট এরিয়াতে মেজর জিয়া তার সেনাদের নিয়ে প্রায় সপ্তাহ দুই ছিলেন। এই শুভপুর ব্রিজে মেজর জিয়ার দলের সাথে হানাদারদের বেশ কয়েক বার সংঘর্ষ হয়। প্রথম দিকে দু’একবার মেজর জিয়ার দলই জয়ী হয়। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে রাস্তা মুক্ত করতে হানাদাররা যখন ট্যাংক ও ভারী অস্ত্র নিয়ে হামলা করে তখন জিয়ার নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা ভারত সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য হন।

২৫শে মার্চের পর এই শুভপুর ব্রিজ ছাড়া মেজর জিয়াকে আর কোথাও প্রতিরোধ কিংবা সংঘর্ষের সম্মুখীন হতে হয়নি। এইখান থেকে জিয়ার দলকে মেঘালয়ের তেলঢালা ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। তেলঢালাতে তারা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তেলঢালা ক্যাম্পে জিয়াউর রহমান তার নেতৃত্বে প্রায় চার হাজার সৈন্যের একটি দল গঠন করেন। যার নাম তার নামানুসারে ‘জেড’ ফোর্স রাখেন।

অক্টোবর মাসে তেলঢালা ক্যাম্প থেকে প্রায় তিন শ’ মাইল পূর্বে সিলেটের ডাউকি সীমান্তে আবার তারা ঘাঁটি গাড়েন। এখান থেকেই পরিকল্পনা তৈরি করা হয় যে, জিয়ার নেতৃত্বাধীন দলটি শেষ যুদ্ধের সময় ওখান দিয়েই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকবে। এবং তারা সিলেট জেলা দখল নেবেন।”

বইয়ের ৪৩৮ পৃষ্ঠায় বাঘা সিদ্দিকী বীর উত্তম যা লিখেছেন, তা নিম্নরূপ;

“মেজর জিয়া ২৮-২৯শে মার্চ চার-পাঁচশ সৈনিক নিয়ে ভারতের শ্রীনগর বিওপিতে পৌঁছে ছিলেন। নয় মাস পর ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর চার-সাড়ে চার হাজার সৈন্যসহ স্বাধীন বাংলার সিলেটে অবস্থান নেন। এর মাঝেও দুচারটি ঘটনা নিশ্চয়ই রয়েছে। এটা প্রমাণিত সত্য যে, তিনি ২৫ শে মার্চ রাত পর্যন্ত পাক সেনাবাহিনীর একজন অনুগত অফিসার ছিলেন। যার পুরস্কার হিসাবে তিনি বিদেশে নানা স্থানে পাক সেনাবাহিনীর ‘গোপনীয় ব্যাপার সংক্রান্ত’ বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছিলেন। আরও একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। মেজর জিয়া যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার ও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তার দু’সন্তান ও স্ত্রী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। বেঙ্গল রেজিমেন্টের অসংখ্য অফিসার ও জোয়ানদের স্ত্রী-পুত্র-পরিজনদের উপর হানাদাররা অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করলেও জিয়ার স্ত্রী ও দু’সন্তান কুর্মীটোলা ক্যান্টনমেন্টে অত্যন্ত সম্মানজনক অবস্থায় ছিলেন।”

একটি কৌতুহলী বিষয় হলো এই যে, জিয়াউর রহমানকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের হিরো হিসাবে চিহ্নিত করতে ধিকৃত রাজাকার শাহ আজিজ এবং কর্নেল আকবরসহ তারাই অতি আগ্রহী ছিল যারা মুক্তিযুদ্ধ তথা পাকিস্তান ভেঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরুদ্ধে ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা সব পালিয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমানকে ত্রাণকর্তা হিসাবে পেয়ে তার ছত্রছায়ায় এক হয়েছিল দেশকে আবার পাকিস্তানে রূপান্তরিত করতে।

যারা জিয়াকে হিরো বানাতে চায় তারা কি বলতে পারবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করার সাথে সাথেই কেন জিয়া মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান জয় বাংলাকে দেশান্তরিত করেছিল, কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দিয়েছিল, কেন কর্নেল মোস্তাফিজ, সোলেমান, কর্নেল আকবর, বিচারপতি সাত্তার, জাদু মিঞা, রহমান বিশ্বাসসহ একঝাক পরিচিত রাজাকার দিয়ে তার অবৈধ মন্ত্রীসভা গঠন করেছিল, কেন জিয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম এবং বৈশিষ্ট্য পাল্টে দিয়েছিল, কেন বাংলাদেশ বেতার, বিমান প্রভৃতি বাংলা শব্দের পরিবর্তে অ-বাংলা শব্দ বসিয়ে ছিল?

যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের জমি দখল করতে পারে, সে মিথ্যাচারী হবে, এটা তো অস্বাভাবিক নয়। ১৯৭১-এ তার ভূমিকা যাই ছিল না কেন, লোভের তাড়নায় সে সবই করতে পারে, তা তার ভূমি দখল কাণ্ডই প্রমাণ করেছে। প্রশ্ন হলো, জিয়ার পক্ষে মিথ্যাচার চালানোর জন্য সে কী পেয়েছিল জিয়া বা তার অনুসারীদের কাছ থেকে?

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার হয়েছে, কিন্তু রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা হয়নি। কর্নেল অলির ’৭৫ পরবর্তী অবস্থান তারই এক বড় প্রমাণ। তাছাড়া সমস্ত পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় এটা পরিস্কার যে কর্নেল অলি আদর্শগত কারণে মুক্তিযুদ্ধে যায়নি, গিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে মৃত্যুবরণ এড়াতে।