বিজয় দিবসে চাই নতুন আদর্শ ও চেতনা

রাজনীতিতে সুবিধাবাদ, দেশপ্রেমবর্জিত আখের গোছানোর যে প্রবণতা চলছে তা থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাইলে অবশ্যই বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো যে সে পরিবর্তন করবে না তা আমরা স্বাধীনতার ৫২ বছরে বুঝে ফেলেছি।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 16 Dec 2023, 11:04 AM
Updated : 16 Dec 2023, 11:04 AM

আমাদের স্বাধীনতার মূল আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ছিল অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে স্বশাসন; স্বশাসনের মধ্য দিয়ে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থা গড়ে তোলা। যেখানে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের সব মানুষের অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কারও প্রতি কোনোরকম বৈষম্য করা হবে না। সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের স্বাধীনতার ওই আকাঙ্ক্ষা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। ক্ষমতায় যারাই গেছে তারাই গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিয়ে ক্ষুদ্র দল ও গোষ্ঠী স্বার্থে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছে। এতে করে দেশের সব মানুষের জন্য অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যায়নি। এক শ্রেণির মানুষ ফুলে-ফেঁপে বড়লোক হয়েছে। সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে অন্য সব জাতি-সত্তা ও ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু মানুষেরা চরম বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাদের জমি-জমা কেড়ে নেয়া হয়েছে। তাদের নিরাপত্তার চরম ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে। থানা-পুলিশ-আইন-প্রশাসন কোনো কিছুই তাদের পক্ষে ভূমিকা পালন করেনি।

একাত্তরে কাগজে-কলমে দেশ স্বাধীন হলেও মূলত এদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বৃহৎ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর। ঋণ-সাহায্য-অনুদানের নামে বাংলাদেশকে বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশ ও তাদের স্বার্থরক্ষাকারী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করেছে। আইএমএফ-ওয়ার্ল্ডব্যাংক-এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দেশের রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ হয়। কয়লা-তেল-গ্যাসসহ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর দখল প্রতিষ্ঠার জন্য বৃহত্তর পুঁজিবাদী দেশগুলো বাংলাদেশকে অক্টোপাশের মতো চেপে ধরেছে। আর ঘুষ-দুর্নীতিতে সিদ্ধহস্ত আমাদের সরকারগুলো বিদেশি প্রভুদের কাছে নিজেদের বিবেক ও স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে দাসত্বকেই অলঙ্কার হিসেবে মেনে নিয়েছে। স্বাধীনতার পর গত প্রায় পাঁচ দশকে এটাই আমাদের দেশের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা।

এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলাদেশ আজ বৃহত্তর পুঁজিবাদী দেশগুলোর অবাধ বিচরণভূমিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশের দেউলিয়া রাজনৈতিক শক্তিই তাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে, নিজের শক্তি-সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো শক্ত মেরুদণ্ডসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের আজ বড়ই অভাব।

আন্তর্জাতিক পুঁজির পক্ষের শক্তিগুলো চায় বাংলাদেশ একটি ভঙ্গুর বা দুর্বল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হোক। এতে করে বাংলাদেশের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। পরনির্ভরশীলতা বিস্তৃত হলে বাংলাদেশে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম রাখা সম্ভব হবে। বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক লুটেরাদের কাছে বড়ই আকর্ষণীয়। এখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা গেলে ভারত-পাকিস্তান-চীনকে শাঁসানো সহজ হবে। আর ১৭ কোটি মানুষের বিশাল শ্রমশক্তিকে ব্যবহার ও বাজার দখলের মাধ্যমে স্বার্থ হাসিলের প্রশ্নটি তো রয়েছেই। 

আমাদের রাষ্ট্র জীবন থেকে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ধর্মকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে এক ধরনের মৌলবাদী সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছে। জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের গতিপথকে পেছনে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার নামে আসলে এক ধরনের পশ্চাৎপদ শিক্ষা বিকাশের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও জামায়াতের অবদান প্রধান হলেও আওয়ামী লীগের আপসকামী ও সুবিধাবাদী নীতিও কম দায়ী নয়। সমাজে এর বিষফলও ফলেছে অতিদ্রুতই। মাদ্রাসা শিক্ষার পশ্চাদপদ ভূমিতে মৌলবাদী রাজনীতি সহজেই বিকশিত হচ্ছে।

মুখে ভালো ভালো বুলি আওড়ালেও আন্তর্জাতিক চক্রও অবশ্য চায় বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা বজায় থাকুক। একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে মৌলবাদ চাষাবাদ হোক। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা গণতান্ত্রিক চেতনা মৌলবাদ এবং আন্তর্জাতিক লুটেরা গোষ্ঠী উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ মুক্ত হয়ে গড়ে ওঠার বা বেড়ে ওঠার সুয়োগ পায়। তারা নিজেদের হিস্যা বুঝে নেয়ার জন্যও সোচ্চার হয়। এ ব্যবস্থায় তাই সাধারণ মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়া সহজ হয় না। নয়া উপনিবেশবাদীরা তাই তলে তলে দুর্বল সমাজ কাঠামো ও অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অধিকতর শ্রেয় মনে করে। সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা যদি প্রকট হয়, সরকার যদি লুটেরা শ্রেণির প্রতিভূ হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক চক্র সহজেই তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে পারে। সে জন্যই বাংলাদেশকে ঘিরে আন্তর্জাতিক চক্রের এত তৎপরতা ও আগ্রহ। তারা চায় ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে। এ কাজে এদেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো সবসময়ই তারা সহযোগীর ভূমিকায় পেয়ে যায়।

দুর্বল রাজনৈতিক কাঠামো এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধাবাদী মানসিকতার কারণে এদেশে শুধু যে মৌলবাদী চক্রেরই বাড়-বাড়ন্ত তাই নয়, ক্ষমতা নিয়ে মারামারি-কাড়াকাড়ির ফাঁক গলিয়ে ‘অদৃশ্য শক্তি’ও রাষ্ট্রক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করে আসছে। তাদের এ অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আরও বেশি দুর্বল করে দিচ্ছে। মৌলবাদী চক্রকে শক্তিশালী হতে সুযোগ করে দিচ্ছে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য নেই। গণতন্ত্রের চিরশত্রু মৌলবাদ উচ্ছেদ এবং সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে কোনো প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সংকল্প নেই। এমন মেরুদণ্ডহীন অসার রাজনৈতিক শক্তির কাছে দেশের মানুষ কী আশা করতে পারে? স্বাধীনতার সুফল তো দূরের কথা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার ব্যাপারেই বা তাদের ওপর কতটা ভরসা রাখা যায়?

আসলে আমাদের উল্টোযাত্রা শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পরপরই। আদর্শিকভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মোড়কে পুরো পাকিস্তানকে পুরে দেবার চূড়ান্ত আয়োজনটি সম্পন্ন হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। ১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্টের পর বাংলাদেশের মিলিটারি শাসকরা বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মুছে ফেলে বাংলাদেশকে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছিল এবং গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ইসলামীকরণ করে আদর্শগত দিক দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল।

বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক লুটেরা গোষ্ঠী, সামরিক বাহিনী ও মৌলবাদীদের দুষ্ট চক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। নীতিবিবর্জিত দেশপ্রেমহীন রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রটি-বিচ্যূতি দুর্বলতার কারণে বার বার সেনা হস্তক্ষেপ ঘটছে। সেনা  হস্তক্ষেপের কারণে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। দুর্বল সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর অস্থিতিশীলতা, দুঃশাসন ও অপশাসকের হাত ধরে মৌলবাদী চক্র ক্রমেই সবল হচ্ছে। আন্তর্জাতিক লুটেরা চক্র অপ্রতিরোধ্যভাবে দেশের রাজনীতি ও নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখার সুযোগ পাচ্ছে। দেশের স্বার্থ বা গণমানুষের স্বার্থ ক্রমেই বিপন্ন হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ নাম-কা-ওয়াস্তে স্বাধীন দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও বিদেশি শক্তিই এর মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।

বালাদেশের রাজনৈতিক সংকটের এ সম্পাদ্য থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে যে রাজনৈতিক শক্তি সেই রাজনৈতিক শক্তিও বর্তমানে আন্তর্জাতিক লুটেরা চক্র ও তাদের দোসরদের বশ্যতা স্বীকার করে বসে আছে। দেশের মানুষের স্বার্থের কথা বলে রাজনীতি করলেও একটি বিশেষ গোষ্ঠীর ক্ষুদ্র কোটারি স্বার্থের কাছেই বন্দি হয়ে আছে বাংলাদেশের রাজনীতি।

আওয়ামী লীগ গণমানুষের চেতনা কিছুটা বেশি ধারণ করে বলে আপাত মনে হলেও তারাও দিনে দিনে প্রথাগত কুরাজনীতির কাছে আত্মবিসর্জন দিয়েছে। তারাও জাতীয়-আন্তর্জাতিক লুটেরা গোষ্ঠীর কাছে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে পারেনি। জনগণের শক্তির ওপর বর্তমান নেতৃত্বের বিশ্বাস বা আস্থা আছে— তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।

সবচেয়ে নির্মম পরিহাস হলো, একটি অবাধ-সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে তারা যে ক্ষমতায় আসতে পারে, সেই আত্মবিশ্বাস দলটি হারিয়ে ফেলেছে। আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভূমিকা আরও করুণ! যে আন্তর্জাতিক চক্র দেশে অগণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ে, দেশে ‘গণতান্ত্রিক উত্তরণের’ জন্য এ বিদেশি শক্তির কাছেই তাদের মাথা কুটে মরতে দেখা যায়। 

রাজনীতিতে সুবিধাবাদ, দেশপ্রেমবর্জিত আখের গোছানোর যে প্রবণতা আমাদের দেশে চলছে, তার থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাইলে অবশ্যই বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো যে সে পরিবর্তন করবে না তা আমরা স্বাধীনতার ৫২ বছরে বুঝে ফেলেছি। অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত জনগণের অন্ধবিশ্বাস, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক কুসংস্কারকে মূলধন করে ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতি কখনোই দেশের কল্যাণ সাধন করতে পারে না— এ সত্য বোঝা এবং বোঝানো এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন নতুন চেতনা, নতুন সংগঠন, নতুন কর্মীবাহিনী। অভ্যস্ত স্লোগান, চেনা রাজনীতিকদের বুলি আমাদের কাছে ক্লিশে হয়ে গেছে। এখন বিকল্পের অন্বেষণ করতে হবে। এই বিকল্প মৌলবাদ নয়, অবশ্যই গণমানুষের পক্ষের দেশপ্রেমিক শক্তির। এই শক্তির সন্ধান করতে হবে। এই শক্তিকে গড়ে তুলতে হবে। তরুণ প্রজন্মকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। আপাতত চিন্তার শুদ্ধতা চাই। চাই নতুন আদর্শ ও চেতনা। এই আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে হলে দেশে এক নবজাগরণের প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন আরেক যুদ্ধের। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মকে আরেক মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি করতে হবে। তা না হলে দেশে নির্বাচন হবে, ফি বছর ঘটা করে বিজয় দিবস পালন করা হবে। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না।