বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সার্থক মূর্ত প্রতীক। তিনি বিশ্বশান্তি আন্দোলনের একজন মহান সেনানী ও অগ্রনায়ক এবং সমকালীন বিশ্বে মানব জাতির মুক্তি সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অন্যতম।
Published : 14 Aug 2023, 04:36 PM
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদিনে বা রাতারাতি নেতা হননি। তাঁর মধ্যে নেতৃত্ব গুণ ছিল সহজাত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের যে দীর্ঘ ও ধারাবাহিক ছোটবড় সংগ্রাম তার প্রতিটিতেই ছিল শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ অংশগ্রহণ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার অসৎ পরিকল্পনা থেকেই। এটা তাই একদল বিপথগামী সেনাকর্মকর্তার ব্যক্তিগত আক্রোশ বা হঠাৎ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল না। এর পেছনে ছিল দেশি-বিদেশি শক্তির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফল। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় যারা চায়নি, যারা চায়নি বাঙালি জাতি স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে বিশ্বসভায় মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক—তাদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর, ১৯৩৫ সালের (ব্রিটিশ) ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ইতোপূর্বে গঠিত আইনসভাই পাকিস্তানের গণপরিষদের মর্যাদা লাভ করে। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্ব এ গণপরিষদের ওপরই ন্যস্ত ছিল। কিন্তু দীর্ঘকালের মধ্যেও প্রথম গণপরিষদ কোনো শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়নি।
১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়লাভ করে। পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে গণপরিষদ নতুনভাবে পুনর্গঠিত হয়। নবগঠিত (দ্বিতীয়) গণপরিষদের ৮০ জন সদস্যের মধ্যে ৪০ জন ছিলেন পূর্ববাংলা থেকে নির্বাচিত। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এ নতুন গণপরিষদের অন্যতম সদস্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলে থাকা অবস্থায় ১৯৫৫ সালের জুন মাসে পাকিস্তান দ্বিতীয় গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি ১৯৫৬ সালের সংবিধানের অধীনে গঠিত পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করার আগপর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন।
পাকিস্তান গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, বাঙালির স্বাধিকার-স্বায়ত্তশাসন, মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, মানুষের ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান নিশ্চিতকরণ, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অনুসৃত দমন-পীড়ন নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এছাড়া সামরিক শাসনবিরোধী, নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি প্রশ্নেও তিনি বক্তব্য দিয়েছেন ওইসব ফোরামে। তরুণ বয়সে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য প্রদানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু একজন সক্রিয় ও সফল পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাজপথে যেমন জনগণের অধিকারের প্রশ্নে তিনি থেকেছেন উচ্চকণ্ঠ, তেমনি পার্লামেন্টকেও তিনি ব্যবহার করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন গণঅধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র হিসেবে। এই লেখায় আমরা তার কিছু প্রতিফলন লক্ষ্য করব।
১৯৫৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ—পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে একীভূত করে এক ইউনিট চালু করার প্রস্তাব করা হয় গণপরিষদে। পূর্ববাংলা থেকে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্টের সদস্যদের সহায়তায় বিলটি পাস করানো হয়েছিল, যা ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে অন্তভুর্ক্ত হয়। বিল উত্থাপন থেকে শুরু করে পাস করানো পর্যন্ত সময়কালে বঙ্গবন্ধু এই বিলের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন এবং একই সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি। যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালে ২১ দফা দাবিনামার ভিত্তিতে পূর্ববাংলায় নির্বাচিত হয়েছিল। ২১ দফার অন্যতম দাবি ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের অনেক সদস্য শেরেবাংলার নেতৃত্বে ২১ দফাকে পদদলিত করে পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিটকে সমর্থন করে। একমাত্র আওয়ামী লীগ তার বিরোধিতা করেছিল। এক ইউনিটের বিরোধিতা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু গণপরিষদ অধিবেশনে যুক্তফ্রন্ট সদস্যদের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত গণপরিষদ অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ববাংলার মধ্যে বৈষম্য হ্রাস করার আহ্বান জানান। যদিও পূর্ববাংলার জনসংখ্যা শতকরা ৫৬ ভাগ, তবুও পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে সমমর্যাদা দেওয়া হয়েছিল সংখ্যা-সাম্য নীতির মাধ্যমে। এই বৈষম্য সত্ত্বেও পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বঙ্গবন্ধু রাজনীতি, অর্থনীতি, চাকরি, শিক্ষাসহ সবক্ষেত্রে সম অবস্থান নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, পররাষ্ট্র, মুদ্রা ও দেশরক্ষা বিভাগ থাকবে কেন্দ্রের হাতে, আর বাকি সব বিষয় প্রদেশের হাতে থাকবে। ওই বক্তৃতায় তিনি ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য হ্রাসের আহ্বান জানিয়েছিলেন। সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও গভর্নর জেনারেল কেন ৭২ হাজার টাকা বেতন পাবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু। তার মতো আরও অনেক বেশি বেতনভোগী লোকদের বেতন কমিয়ে নিম্ন বেতনভুক কেরানি-পিয়নদের বেতন ৭৫ টাকা থেকে অন্তত দশ টাকা হলেও বাড়ানোর প্রস্তাব করেন।
বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যও বঙ্গবন্ধু বারবার সোচ্চার হয়েছেন পাকিস্তান গণপরিষদে। ১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারি গণপরিষদ অধিবেশনে তিনি বাংলাকে উর্দু ও ইংরেজির পাশে স্থান দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে এই তিনটি ভাষাতেই গণপরিষদের কার্যবিবরণী রক্ষা করার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তার কার্যকারিতা তেমন ছিল না। এমনকি দৈনিক ভিত্তিতে প্রচারিত আদেশগুলো শুধু উর্দু ও ইংরেজিতে হতো। বাংলায় কেন প্রচার হচ্ছে না সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু পয়েন্ট অব প্রিভিলেজে প্রশ্ন করেন। পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে একটি জাতীয় ভাষা সৃষ্টির প্রস্তাব করা হলে বঙ্গবন্ধু তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষার বিষয়টিকে ভয়াবহ বলে আখ্যায়িত করেন এবং সরাসরি বাংলা ও উদুর্কে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানান। এই মর্মে একটি সংশোধনীও তিনি গণপরিষদে উপস্থাপন করেন। ওই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারিতে তিনি একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ইংরেজির পরিবর্তে দুটি রাষ্ট্রভাষাকে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করার পাশাপাশি পাকিস্তানের সব জাতীয় ভাষা যথা– পশতু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি, বাংলাকে যথাযথভাবে বিকশিত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যও আহ্বান জানান। উদাহরণ হিসেবে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের উল্লেখ করেন, যেখানে রুশ ভাষার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতির ভাষার উন্নয়ন ঘটানো হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব মতে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে পাঁচ মিনিট জাতীয় পরিষদ অধিবেশন মূলতবি করা হয়েছিল।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের গৃহীত শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রশ্নাতীত ব্যাপার ছিল না। সংগত কারণেই তিনি সোচ্চার ছিলেন এই ব্যাপারে। ১৯৫৬ সালের ২১ জানুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে এই বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু অমুসলমানদের ভূমিকা ও অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তিনি প্রশ্ন করেন, যদি এই সংবিধান মুসলমানদের জন্য হয় তাহলে কি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ প্রভৃতি ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য আলাদা সংবিধান রচনা করতে হবে। যদি সত্যি সত্যিই এটা ইসলামি সংবিধান হয় তাহলে ন্যায়বিচার, সমতা, সততা, সমবণ্টন ইত্যাদির অনুপস্থিতি কেন ঘটেছে এই সংবিধানে, এই প্রশ্নের অবতারণা করে বঙ্গবন্ধু এই সংবিধানকে ইসলামের নামে ভাঁওতাবাজি বলে চিহ্নিত করেন। পাকিস্তানে যেসব জমিদার ও পুঁজিপতি আছে তাদের সম্পদ জনগণের মাঝে বণ্টন করা সম্পর্কে কোনো কথা সংবিধানে না বলায় ওই সংবিধানকে একটি ধর্মের নামে ধাপ্পাবাজির দলিল বলে তিনি অভিহিত করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি ধনবৈষম্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান পান মাসিক ১২ হাজার টাকা ও একজন চাপরাশি পান মাত্র ৪৫ টাকা। ইসলামের ইতিহাসের খলিফাদের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ওই সময়টাকে ইসলামি শাসন বলা হয়, কারণ তখন তারা জনগণের সম্পদ নিজের জন্য ব্যবহার করেননি। আর পাকিস্তানে ধনবান জমিদাররাই সব সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হয়েছে। সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে।
একই দিনে প্রদত্ত বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু নির্বিশেষে যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করার জন্য প্রস্তাব করেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু ছিল। গণতন্ত্রের স্বার্থে, পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিকশিত করার লক্ষ্যে তিনি পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি একুশ দফার ভিত্তিতে নতুন করে সংবিধান রচনার আহ্বান জানান। যাতে বাঙালি-পাঞ্জাবি নির্বিশেষে সব জাতি-ধর্ম-বর্ণের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। গণতান্ত্রিক বিধিমতে সংবিধান রচিত হলে আওয়ামী লীগ সহযোগিতা প্রদান করবে বলে বঙ্গবন্ধু প্রতিশ্রুতি দেন। অন্যথায় জনগণ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে তিনি ঘোষণা করেন।
রাজনীতিতে নারীদের অধিক সংখ্যায় অংশগ্রহণের গুরুত্ব সেই পঞ্চাশের দশকেই বঙ্গবন্ধু অনুভব করেছিলেন। পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদে নারীদের জন্য ১২টি সংরক্ষিত আসন ছিল, যার ৩টি ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ২০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ করার একটি প্রস্তাবের প্রতি বঙ্গবন্ধু সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত গণপরিষদ অধিবেশনে। এই প্রসঙ্গে তিনি মোল্লাতন্ত্রের চরম সমালোচনা করে বলেন, তারা নারীদের রাজনীতিতে আসতে দিতে চায় না। তারা নারীকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখতে আগ্রহী। অথচ সমাজের অর্ধেক নারীদের রাজনীতির বাইরে রেখে রাজনীতির বিকাশ আশা করা যায় না।
ওই বছরের বাজেট বক্তৃতায় অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্যের চিত্র অনুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেন। ২১ মার্চ, ১৯৫৬ তারিখে প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি পূর্ববাংলায় শিল্পায়নের পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। জনবল বেশি পূর্ববাংলায়। সেখানে কাঁচামালও সহজলভ্য। অথচ শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলাকেই শিল্পের দিক দিয়ে পশ্চাৎপদ করে রেখেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে মুসলিম লীগের শাসকদের কারসাজিতে কীভাবে পশ্চিমে শিল্প গড়ে উঠেছে পূর্ববাংলাকে বঞ্চিত করে সেই চিত্র তুলে ধরেন। পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের উদ্যোগে যে ৬১টি শিল্প প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, তার মধ্যে মাত্র ১৭টির পরিকল্পনা হয় পূর্ববাংলায়। তার মধ্যে মাত্র ৩টি সম্পূর্ণ হয়েছে। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে সবই শেষ হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া শেয়ার কেনা থেকেও বাঙালিদের ইচ্ছাকৃতভাবে বঞ্চিত করে রাখা হয়। শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের কোনো কর্মকর্তাই বাঙালি নয় বলে বঙ্গবন্ধু তথ্য প্রদান করেন। এমনকি পূর্ববাংলায় যেসব শিল্প উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে সেখানেও বাঙালি নেই। শ্রমিকও নেওয়া হয় না বাঙালিদের থেকে। অথচ শাসকগোষ্ঠী সব মুসলিম ভাই ভাই বলে। এটা আসলে ভাঁওতাবাজি বলে বঙ্গবন্ধু অভিযোগ করেন। সংবিধানে যদিও শিল্পায়নকে প্রদেশের আওতায় আনা হয়েছে কিন্তু কোনো বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা করা হয়নি। তাহলে কীভাবে শিল্পায়ন হবে বাংলাদেশে? অতঃপর তিনি পূর্ববাংলায় শিল্পায়নের স্বার্থে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অর্থমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।
পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন ফোরামে এই ধরনের বক্তব্য অনেকবার দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তান জাতীয় সংসদকেও তিনি বাঙালিদের অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্মে পরিণত করেছিলেন ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত সময়কালে। তাঁর পার্লামেন্টারি বক্তব্যগুলো সেদিন বাঙালিদের জাতীয় অধিকার তথা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিকাশে অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য, প্রস্তাব, রাজনৈতিক সংকটে প্রদত্ত সমাধান, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে গৃহীত পদক্ষেপ পর্যালোচনা করলে শুধু গণশক্তিরই প্রকাশ দেখতে পাওয়া যাবে। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকচক্র শত চেষ্টা করেও বঙ্গবন্ধুকে পথভ্রষ্ট করতে পারেনি। কী বুদ্ধিতে, কী সাহসে, কী বিক্রমে বঙ্গবন্ধুকে পরাস্ত করা পাকিস্তানি শাসকবর্গের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির পিতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থপতি ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। বাংলার আপামর জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা-বিক্ষোভ সর্বোপরি আবহমান বাংলার বৈশিষ্ট্যকে তিনি নিজের জীবনে আত্মস্থ করেছেন। তাঁর কণ্ঠে বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্বের যেখানেই মুক্তি সংগ্রাম চলেছে, সেখানেই ছিল তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সার্থক মূর্ত প্রতীক। তিনি বিশ্বশান্তি আন্দোলনের একজন মহান সেনানী ও অগ্রনায়ক এবং সমকালীন বিশ্বে মানব জাতির মুক্তি সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অন্যতম।
হত্যা করে ইতিহাস থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টা সফল হয়নি। ইতিহাসের যিনি স্রষ্টা তাঁকে কি ইতিহাস থেকে খারিজ করা যায়? জীবিত শেখ মুজিবের মতো মৃত শেখ মুজিবও তাই আজ বাংলাদেশের মানুষের কাছে সমান স্মরণীয়, বরণীয়।