প্রতিটি রাষ্ট্র বিদেশে অবস্থানরত নিজের নাগরিকের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে কূটনৈতিক মাধ্যমে সদা-সতর্ক দৃষ্টি রাখে। আমিরাতে দণ্ডপ্রাপ্ত ৫৭ জন নাগরিকের ব্যাপারে আমাদের সরকারেরও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা উচিত।
Published : 26 Jul 2024, 06:18 PM
বাংলাদেশ এক অবিস্মরণীয় আন্দোলনের সাক্ষী হয়ে রইল। কোনো রাজনৈতিক দল নয়, কোনো সংঘ-সংগঠন নয়, কোনো জোট নয়, স্রেফ কিছু শিক্ষার্থীর ডাকে অভূতপূর্ব এই আন্দোলনে শরিক হয়েছিল দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী। আন্দোলনে এমন অনেকেই সম্পৃক্ত হয়েছেন, যারা কখনো হয়তো দেশেই থাকবেন না, কখনো কোনো সরকারি চাকরিতে আবেদন করবেন না। সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে সরকারের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত ও ছলচাতুরির প্রতিবাদ জানাতে তারাও অকুতোভয় সৈনিকের মতো নেমেছিল এই আন্দোলনে। কোটাবিরোধী এই আন্দোলনে নেমেছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও। চাকরিপ্রার্থী শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় এমনভাবে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা দেখিয়ে দেশের প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর রাজপথে নেমে আসা, প্রতিবাদে শামিল হওয়াটা ছিল এক বিরল ঘটনা।
শুরুতে অবশ্য কোটা সংস্কার আন্দোলনটি এত বেশি প্রবল ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশ-পাশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু আন্দোলনকারীদের নিয়ে কটাক্ষ এবং পরে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের হামলার কারণে তা ছড়িয়ে পড়ে। আর যখন পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলনকারীদের দমন শুরু করল, তখন তা মহা-বিস্ফোরণের রূপ নেয়।
যে কোনো প্রতিবাদ আন্দোলনেরই পক্ষ-বিপক্ষ থাকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনেও তা ছিল। তবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার পর তা ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে। বেশিরভাগ মানুষই নিজ নিজ অবস্থান থেকে হামলার প্রতিবাদ জানায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরাও প্রতিবাদ-বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেছে।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে হামলার ঘটনার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে বিভিন্ন দেশে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ইতালি, সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকরাও কোটাবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়। বিদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশগুলোতে বাংলাদেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমর্থনে ও হামলার প্রতিবাদে বিভিন্ন ব্যানার প্রদর্শন করেছে প্রবাসী নাগরিকেরা।
কোনো সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ জানানো, স্বাধীন মত প্রকাশ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই স্বীকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার। যা মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু কিছু দেশে এই অধিকারের স্বীকৃতি নেই। তেমন একটি দেশ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাত। সেখানে সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই রাজতান্ত্রিক শাসনকাঠামোর দেশে কোটা আন্দোলনের সমর্থনে কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি প্রতিবাদ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে গভীর বিপদে পড়েছেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আন্দোলনের সমর্থনে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভ করায় ৫৭ বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির আদালত।
গত ১৯ জুলাই বিক্ষোভের সময় দেশটির কয়েকটি রাস্তায় ‘দাঙ্গায় উস্কানি’ দেওয়ার অভিযোগে তিন বাংলাদেশিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অন্য ৫৩ জনকে ১০ বছর করে ও একজনকে ১১ বছরের দণ্ড দেওয়া হয়েছে। সাজার মেয়াদ শেষে দণ্ডিতদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। উল্লেখ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভ করা অবৈধ। ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা জানি মধ্যপ্রাচ্যে যারা যান, তাদের কত না কাঠখড় পোড়াতে হয়। যারা অনেক কষ্টে-সৃষ্টে সেখানে গিয়েছেন, তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থ উপার্জন। অমানুষিক পরিশ্রমের বিনিময়ে যে সামান্য কিছু টাকা পান, তা দিয়ে স্বদেশে পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করেন। এই শ্রমজীবী মানুষগুলোর ৫৭ জন আবেগতাড়িত হয়ে স্বদেশের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের জেলে আছেন।
এই ৫৭ জনের পরিবারে নেমে এসেছে ভয়াবহ অন্ধকার। তাদের নিজেদের জীবনই কেবল অনিশ্চয়তার অন্ধকারে তলিয়ে যায়নি, পরিবারগুলোতেও সীমাহীন দুর্যোগ নেমে এসেছে। পরিবারের আয়রোজগারের প্রধান ব্যক্তিটিকে যখন আকস্মিক ১০ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়, তখন পরিবারের অন্য সদস্যদের অবস্থা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এ ব্যাপারে সরকারকেই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। কীভাবে তাদেরকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনা যায়, শাস্তি মওকুফ করানো যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে।
মনে রাখা দরকার যে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত প্রবাসী আয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশী কর্মরত। তারা কঠোর পরিশ্রমে যে অর্থ উপার্জন করেন, তা দেশে পাঠান। তাদের পাঠানো অর্থ দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে বিশেষ অবদান রাখছে। সেই সঙ্গে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলো, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরা দেশে ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা কোনোটিই পান না। সরকার প্রবাসী শ্রমজীবীদের অধিকার রক্ষায় তেমন যত্নশীল নয়।
আরব আমিরাতে দণ্ডপ্রাপ্ত ৫৭ বাংলাদেশির ব্যাপারেও সরকারের ভূমিকা ইতিবাচক বলে মনে হচ্ছে না। আমিরাতে দণ্ডিত ওই সব বাংলাদেশি নাগরিক সম্পর্কে সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, দুবাইয়ে আন্দোলন করে এরা বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট করেছে। এ জন্য তাদের শাস্তি হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত প্রবাসীদের বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করব না। এটি আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় বিষয়।
প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর বক্তব্যে এক ধরনের ক্ষোভের বহির্প্রকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে। কোটা আন্দোলনের সমর্থনে আমিরাত প্রবাসীদের ভূমিকার কারণেই যে এই ক্ষোভ তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্য কি আদৌ গ্রহণযোগ্য? তিনি সংবিধানের আলোকে মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের সময় বলেছিলেন যে, ‘রাগ-অনুরাগের বশবর্তী হয়ে’ তিনি কোনো কাজ করবেন না। কিন্তু এখন কেন রাগের বশবর্তী হয়ে কথা বলছেন? সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? বর্তমান জমানায় প্রতিটি রাষ্ট্র বিদেশে অবস্থানরত নিজের নাগরিকের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে কূটনৈতিক মাধ্যমে সদা-সতর্ক দৃষ্টি রাখে। আমিরাতে দণ্ডপ্রাপ্ত ৫৭ জন নাগরিকের ব্যাপারে আমাদের সরকারেরও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা উচিত।
মনে রাখতে হবে, দেশের প্রতিটি নাগরিকের সুবিধা-অসুবিধা দেখার দায়িত্ব সরকারের। যারা দেশে বসবাস করেন, তাদের সুযোগ-সুবিধা যেমন দেখতে হবে, প্রবাসী নাগরিকদেরটাও দেখতে হবে। এটা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। আমিরাতে দণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশি নাগরিকদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সহায়তা দেওয়া দরকার। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে উল্লিখিত ৫৭ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে আমিরাতের আদালতের দেয়া রায়ের নিন্দা জানিয়ে নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) তাদের মুক্তি দাবি করেছে। সংস্থাটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের দায়ে তড়িঘড়ি করে বিচারের মাধ্যমে আমিরাত কর্তৃপক্ষ যথেচ্ছভাবে ৫৭ বাংলাদেশীকে সাজা দিয়েছে। এতে বিচারপ্রক্রিয়া-স্বচ্ছতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ ৪৮ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে রায় ঘোষণা করা হলে আসামিদের ন্যায্য বিচার পাওয়ার সুযোগ থাকে না। এ ধরনের সাজা ন্যায়বিচারকে উপহাস করে। ইউএই কর্তৃপক্ষের উচিত দণ্ডিত সবাইকে মুক্তি দেওয়া।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতির মধ্যেই আসলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আদালতের ৫৭ বাংলাদেশিকে দণ্ডদানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাগুলো ফুটে উঠেছে। এ ব্যাপারে তাদের আইনি সহায়তা গ্রহণ করা যেতে পারে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সহায়তাও নেওয়া যেতে পারে।
সবচেয়ে বড় কথা কোটা বাতিলের আন্দোলন সমর্থন করা ও আন্দোলনকারীদের উপর হামলার প্রতিবাদ জানানো কোনো অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। নিপীড়িত প্যালেস্ট্যাইনিদের প্রতি বিশ্বের অধিকাংশ দেশে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে মানুষ সমর্থন ব্যক্ত করছে। গাজায় ইজরাইলি হামলার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এটাই মানবতা। এটাই ভ্রাতৃত্ব। যেখানে অন্যায়, জুলুম, সেখানে প্রতিবাদ থাকবেই। প্রতিবাদকারীদের বিপক্ষে দাঁড়ালে মানবতারই বিপক্ষে দাঁড়াতে হয়। যা কাম্য নয়।
তবে প্রবাসীদেরও একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, আমাদের প্রতিবাদী সত্তাকে আমরা বিসর্জন দিব না সত্য, কিন্তু তা যেন হঠকারী না হয়। ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ বলে একটা কথা আছে। যে দেশে আমরা বাস করব, সেই দেশের নিয়মনীতি অবশ্যই মেনে চলতে হবে। রোমে গেলে রোমান হয়েই চলতে হবে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো মুক্ত সমাজে যা সম্ভব, মধ্যপ্রাচ্যের অতিরক্ষণশীল দেশগুলোতে তা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। আর আমিরাতে ১০ লাখের বেশি বাংলাদেশি বসবাস করেন। মুষ্টিমেয় প্রবাসী বাংলাদেশির জন্য অন্যরা ঝুঁকিতে না পড়েন, সেটাও দেখা দরকার। যে দেশে বসবাস করবেন, সেই দেশের আইন, বিধিবিধান, প্রথার প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল থাকার বিকল্প নেই।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করার দায়ে দণ্ডিত ৫৭ জনের কাছ থেকে অন্যান্য প্রবাসীদের শিক্ষা নিতে হবে। নিজেদের অপরিণামদর্শী আচরণের কারণে যেন পুরো কমিউনিটির মানুষ বিপদে না পড়েন তা নিশ্চিত করা দরকার। মনে রাখতে হবে কয়েকজনের কারণে যেন ভিসা-বাতিলের মতো খড়গ নেমে না আসে।