হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ঘরের ডিজাইন করার সময় দেয়ালে রঙের ব্যবহার, ফিনিশিং উপকরণ ও আসবাবপত্রের মতো উপকরণগুলো আরোগ্যকারী আবহ তৈরি করে।
Published : 23 Nov 2024, 04:35 PM
আমাদের বড় কন্যার সঙ্গে আমার সম্পর্কটি একটু ভিন্ন কিসিমের। তার বয়স এখন সাড়ে তিন বছর। তো, কন্যার ধারণা হলো তার বাবার চুল পেকে গেছে; বুড়ো হয়ে গেছে। তাই বাবা কিছু জানে না। কাজেই বাবাকে সবকিছু শেখানোর দায়িত্ব যেন তারই। সময় পেলে বাবা-মেয়ে প্রায়ই ঘুরতে বের হয়ে পড়ি। আর তখন কন্যা আমাকে শেখায়, ‘বাবা জানো...?’ আর আমি শেখাই কন্যাকে। এভাবে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, হাসপাতাল ও বিভিন্ন গাছপালা দেখিয়ে জগৎ সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করি তাকে।
সেদিন আমাদের গ্রামের বাড়ির এলাকার একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। কন্যাকে বললাম, ‘বলো তো, ওই ভবনটি কী?’ মেয়ে বলল, ‘জানি না।’ আমি বললাম, ‘এটা কমিউনিটি ক্লিনিক।’ মেয়ে বলল, ‘এটা আবার কী?’ আমি বললাম, ‘এটা একটা হাসপাতালের মতো।’ মেয়ে চুপ। কোনো জবাব দিল না। কিছুক্ষণ পর বাড়ি ফিরে এলাম আমরা। বাড়ি এসে মেয়ে আমাকে বেশ মুসিবতে ফেলে দিল। তার মায়ের কাছে অভিযোগ জানিয়ে বলল, ‘বাবা আমাকে আজ ভুল জিনিস শিখিয়েছে।’ কারণ কমিউনিটি ক্লিনিককে তার হাসপাতাল মনে হয়নি। বিষয়টি আমাকে বেশ ভাবনায় ফেলে দেয়। তাই পরদিন তাকে নিয়ে যাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দেখাতে। কিছু নার্স ও ডাক্তার অ্যাপ্রন পরে যাওয়া-আসা করছিল তখন। দূর থেকে ভবনটি দেখিয়ে তাকে বলি, ‘এটা হলো হাসপাতাল।’ সে তাতে সায় দেয়। তবে তার উপলব্ধি হলো, ‘এটা ভালো হাসাপাতাল না।’
যেমনটি বলছিলাম, বর্তমান লেখাটির অন্যতম চিন্তা সূত্র আমাদের বড় কন্যা। তার সঙ্গে আলাপ ও প্রতিক্রিয়া আমার চিন্তা জগৎকে অনেকদিন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মানুষ একটি ভবন দেখে কীভাবে আন্দাজ করতে পারে যে, ভবনটি কোন প্রতিষ্ঠানের, সেখানকার কার্যক্রম কিংবা অর্থময়তা? রং দেখে? কাঠামো দেখে? নকশা দেখে? পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে? তার মানে কোনো ভবন কি কথা বলতে পারে? কোনো ভবন কি আমাদের নিগূঢ় বার্তা দেয়? তাহলে ওই বার্তা কীভাবে উপলব্ধি করতে পারি আমরা।যেমনটি কমিউনিটি ক্লিনিক দেখে আমার কন্যার মনে হয়েছিল যে সেটি হাসপাতাল নয়। কিংবা উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স দেখে মনে হয়েছিল সেখানকার সেবা উন্নতমানের নয়। এর পেছনে কিছু কারণও হয়তো আছে। জন্মের পর সে যতগুলো হাসপাতাল দেখেছে তার সবই ঢাকা শহরে। এ শহরের হাসপাতালগুলোতে আছে ঝাঁ চকচকে আলো, সাজসজ্জা, কাচ দিয়ে ঘেরা ঘর এবং সুসজ্জিত পেশাদার লোকজনের অভ্যর্থনা। আরও আছে শিশুদের খেলাধুলার জন্য নির্দিষ্ট স্থান। কাজেই কন্যার মনোজগতে হাসপাতাল বলতে এসব ইমেজই হয়তো কাজ করেছে। কিন্তু ঢাকার বেসরকারি হাসপাতাল তো পুরো বাংলাদেশের বাস্তবতা নয়।
যাইহোক, আমাদের বর্তমান আলোচনাটি হাসপাতালে ডাক্তার-নার্স কিংবা অন্যান্য পেশাদার স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের যত্ন বা সেবার গুণগত মান নিয়ে নয়। বরং তারা যেখানে সেবা দেন সেখানকার বাহ্যিক জগৎটি নিয়ে। আরোগ্য ও সেবার প্রশ্নে উন্নত জ্ঞান-দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, মানবিক আবেগপূর্ণ ও মানবিক যোগাযোগ দক্ষতায় প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স ও থেরাপিস্টগণ হয়তো নিম্নমানের ভবন, সাজসজ্জার ও নাকশার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেও সেবা দিতে পারেন। ঠিক একইভাবে হাসপাতাল ভবনের কোন কোন অভিজ্ঞতাগুলো তাদের আনন্দ দেয়; হতাশ করে তা হয়তো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখেন না রোগীরা। তবে কাঙ্খিত উন্নত সেবা তারা পেলেন কিনা তা খেয়াল করেন গভীরভাবে। কাজেই বর্তমান আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো হাসপাতালের স্থাপত্য, নকশা ও উপকরণ কীভাবে রোগীর, স্বজনদের এবং কর্মরত ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মীদের সন্তুষ্টি, আরোগ্যায়ন প্রক্রিয়া, শারীরিক ও মানসিক কল্যাণ নিশ্চিতে কী ভূমিকা পালন করে এবং ওই ভূমিকাটি কীভাবে পালন করে? এই আলোচনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো হাসপাতাল স্থাপত্য কীভাবে যোগাযোগ করে ও বার্তা দেয় তা যোগাযোগবিদ্যার আলোকে খতিয়ে দেখা।
স্থাপত্য কি কথা বলতে পারে?
এখন প্রশ্ন হলো কোনো ভবন বা দালান কি আমাদের সাথে কথা বলতে পারে? জবাব হলো, অবশ্যই পারে না। তবে ভবন বা দালানের প্রতিটি কাঠামোগত উপাদান আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। একটি সুবিন্যস্ত ও সুপরিকল্পনায় নির্মিত ভবনে স্থপত্যবিদ্যার হাজারও শব্দ ও বাক্য প্রোথিত থাকে। এসব শব্দ ও বাক্যের এক ধরনের কার্যকর বিন্যাসে প্রতিটি ভবন আমাদের সুস্পষ্ট বার্তা দেয়। এখন প্রশ্ন হলো, ওই বার্তাগুলো কেমন? জবাবে বলা যায়, বিভিন্ন ধরনের স্থাপত্য ভিন্ন ভিন্ন বার্তা দেয়। এজন্যই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ বা মহাবিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় দেখলেই আমরা বুঝতে পারি এটি কোন ধরনের বিদ্যালয়। কিংবা মসজিদ, মন্দির, গির্জা বা প্যাগোডার ভবন দেখে সেখানকার ধর্মচর্চা সম্পর্কে ধারণা পাই। অন্যদিকে সরকারি ভবন, জাদুঘর, জেলখানা কিংবা উচ্চশ্রেণির বাণিজ্যিক ভবনের সামনে গেলেই ওই ভবন সম্পর্কে আমরা অনুমান করতে পারি। সমাজের উচ্চশ্রেণির লোকজন বাস করে এমন আবাসিক এলাকার ভবনগুলোর দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি ওই এলাকায় বসবাসকারী মানুষগুলো সম্পর্কে। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোর কাঠামোগত ভিন্নতা ও প্রতীক সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সংযোগের ভিন্ন ভিন্ন বার্তা দেয়। হাজার হাজার বছর ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ওই বার্তার মানে আমরা বুঝি। আজও ওই ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণে যে আঙ্গিক ও উপকরণ, কাচ, আলো ও উচ্চতার সন্নিবেশ ঘটানো হয় তাতে স্বর্গের পানে একটি সার্বজনীন দৃষ্টি বা সঙ্কেতের জন্ম দেয়। ঠিক একইভাবে সরকারি আইনি ও প্রশাসনিক ভাবনগুলো জনগণকে সেবা প্রদানে এক প্রচ্ছন্ন বার্তা দিতে থাকে। ওই বার্তার মানে হতে পারে কোনো ব্র্যান্ড, সেবা, ন্যায়, সমতা, বাজার কিংবা বাণিজ্য।
প্রসঙ্গ হাসপাতাল ভবন
হাসপাতাল ও চিকিৎসা ব্যবস্থার ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই উনিশ শতকের মাঝামাঝির আগ পর্যন্ত ইউরোপের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত লোকজন চিকিৎসা সেবার নেওয়ার জন্য হাসপাতালে যেতে অনীহা প্রকাশ করতেন। বরং নিজ বাড়িতেই চিকিৎসা নিতে চাইতেন। ডাক্তারই বাড়িতে এসে চিকিৎসা দিতেন। এর কারণ অবশ্য নিহিত ছিল হাসপাতাল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে। গোড়ার দিকে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা ছিল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল দুস্থ ও দরিদ্র জনগণ, তীর্থযাত্রী, প্লেগ ও অন্যান্য সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদান। এসব হাসপাতালে চিকিৎসার তুলনায় বরং জীবনের শেষ কয়েক দিন কিছুটা আরাম দেওয়ার চেষ্টা করা হতো। ব্যবস্থা করা হতো সতেজ বাতাস, ভালো মানের খাবার, ধর্মীয় সান্ত্বনা এবং সুস্থ হওয়া কিংবা মৃত্যুর অপেক্ষায় বিশ্রামের জন্য তুলনামূল উষ্ণ ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকার ব্যবস্থা। হাসপাতালে যতটা সম্ভব কম জিনিসপত্র বা জাগতিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত উপকরণ রাখা হতো। তখন মনে করা হতো গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চিন্তার বদলে স্বর্গের কথা ভাবা উচিত। এর একটি ক্লিনিক্যাল ব্যাখ্যাও ছিল। আর তা হলো একটি ওয়ার্ডে যত কম বস্তু থাকবে তত সহজে পরিষ্কার করা যাবে। তবে বিশ শতকের গোড়ার দিকে হাসপাতালের মূল দর্শনটি বদলে যেতে থাকে। বিভিন্ন একক ব্যবসায়ী কিংবা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং ডাক্তারগণ জোটবদ্ধ হয়ে মুনাফামুখী চিন্তা থেকে হাসপাতাল নির্মাণ ও পরিচালনা শুরু করেন। এসময় নারী, শিশু, বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী লোকজন, কিংবা বিভিন্ন রোগের জন্য আলাদা আলাদা হাসপাতাল গড়ে উঠতে থাকে। ক্রমেই বদলাতে থাকে হাসপাতালের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কার্যক্রম এবং বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অবয়ব।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে হাসপাতালের নির্মাণ স্থপতিরা সাধারণত বিমূর্ত আকারকে প্রাধান্য দিতেন। হাসপাতালের অভ্যন্তরে খালি ও ফাঁকা স্থান রাখতেন প্রচুর। করিডোরগুলো হতো দীর্ঘ ও প্রশস্ত। এসব করিডোর ও দেয়ালে নকশা ও সাজসজ্জার আধিক্য রাখা হতো না। হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ কক্ষগুলো ছিল যতটা সম্ভব সহজ, সরল ও সাধারণ। বাইরের দেয়ালে সাধারণত সাদা রং করা হতো। এই সাদা রং পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে কাজ করত। অন্যদিকে ভেতরের দেয়ালে ব্যবহার করা হতো প্যাস্টেল রং, বিশেষ করে ধূসর পীচ ও ট্যান ব্যবহার করা হতো। মূলত রোগীদের শান্ত রাখা, সান্ত্বনা দেওয়া মনোবল বাড়ানোর লক্ষ্যেই এটা করা হতো। আর অপারেশন কক্ষগুলো হালকা সবুজ রঙের হতো। কারণ এই রঙে রক্ত সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। অপারেটিং রুমের স্ক্রাবও একই কারণে হালকা সবুজ হয়। হাসপাতালগুলোর চারপাশে থাকত উন্মুক্ত সবুজ মাঠ ও বিভিন্ন গাছগাছালিতে পূর্ণ উদ্যান ও বাগান। মনে করা হতো রোগমুক্তি ও শান্তিপূর্ণ মৃত্যুর জন্য এসব সবুজ মাঠ ও বাগান বেশ সহায়ক। কিন্তু পরবর্তীতে চিকিৎসা ও সার্জারি আরও উন্নত ও কার্যকর হয়ে উঠলে স্থপতি ও প্রশাসকরা এই সুবিধাগুলো বাদ দিয়ে অর্থসাশ্রয় করতে শুরু করলেন। হাসপাতালগুলো আর আরামদায়ক বা আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে উপস্থাপন করা হতো না। বরং মানব শরীর নামক যন্ত্রটির মেরামতের কারখানা হিসেবে দেখা হতো।
আমরা যদি একটু খেয়াল করি বর্তমানেও নানান কিসিমের হাসপাতাল আছে। কিছু হাসপাতাল আছে যেগুলো দেখতে হোটেলের মতো। ঢাকা শহরের নামী বেসরকারি হাসপাতালগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় একেকটি যেন আয়নাঘর। ঝাঁ চকচকে আয়না দিয়ে নির্মিত বেশিরভাগ হাসপাতাল। এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তার স্বজনের জন্য রয়েছে আরামদায়ক ও সুখকর অভিজ্ঞতার ব্যবস্থা। অর্থনৈতিক সামর্থ্য থাকলেই যে কেউ এখানে আরাম ও সুখ ভোগ করতে পারবেন। টাকা দিলেই পাবেন আকর্ষণীয় পরিবেশে থাকার ব্যবস্থা ও উন্নতমানের খাবার। আরও আছে সিঙ্গেল রুমের ব্যবস্থা। এসব রুম থাকে অনেক সাজানো, গোছানো; নানান কিসিমের ছবি, মনোহারী গাছ, শীত ও তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। হাসপাতালের করিডোরগুলো সাজানো উজ্জ্বল রং, অন্দর সাজানো গাছপালা, জানালায় দামী পর্দা, এবং রোগী ও তার দর্শনার্থীদের জন্য আরামদায়ক আসবাবপত্র। শিশুদের জন্য আছে বৈচিত্র্যময় খেলনা। প্রতিটি রুমে একটি করে অতিরিক্ত বেড থাকে যাতে রোগীর স্বজনেরা রাতে থাকতে পারেন। কিছু কিছু গবেষক বলছেন, এই সব জিনিস দ্রুত সুস্থতা লাভে সহায়তা করে। এগুলো বাড়ায় হাসপাতালের বার্ষিক আয় ও বাজার শেয়ার।
আবার কিছু কিছু সরকারি কিংবা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গেলে আমরা দেখতে পাই চিকিৎসকের সাক্ষাতের অপেক্ষায় রিসেপশনিস্টের সামনে বসে আছেন রোগী ও স্বজনেরা। এখানে অসুস্থ ও উদ্বিগ্ন মনের এক দীর্ঘ লাইন। সঙ্গে আছেন আত্মীয়স্বজন ও সেবাকারী। রোগীর অপেক্ষার এই স্থানটিকে একটি বাস বা ট্রেন স্টেশনের মতো দেখায়। তারপর ডাক্তারে চেম্বারের ঢুকলে আমরা দেখতে পাই একটি শক্ত কাগজে মোড়ানো টেবিল যেখানে রোগীকে পরীক্ষা করা হয়; একটি সিঙ্ক ও একটি সোজা চেয়ার। এখানে থাকা সব মানুষই অসুস্থ ও আহত। তারা উদ্বেগ ও বিরক্তির ঘেরাটোপে বন্দী। তাদের চিন্তায় থাকে না অপেক্ষার প্রহরটিতে একটি বই পড়া কিংবা একটি ম্যাগাজিন হাতে তুলে নেওয়া। একটু খেয়াল করলেই আপনি উপলব্ধি করবেন উজ্জ্বল আলো ও পর্দার ওপাশ থেকে ভেসে আসছে কিছু আওয়াজ। এই আওয়াজে ভেসে আসছে মানুষের যন্ত্রণা ও ভয়ের বার্তা।
হাসপাতালে যোগাযোগ ও আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়
আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় আছে: শ্রবণ, গন্ধ, দৃষ্টি, স্পর্শ ও স্বাদ। এসব ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা আমাদের বাহ্যিক জগৎকে উপলব্ধি করি। এসব ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের নিরিখেই জগৎ সম্পর্কে আমাদের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা লাভ করি। কোনো রং আমাদের সুখের অনুভূতি দেয় কারণ এটি একটি সুখী অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কিত। ঠিক একই রং কখনো আমাদের উদ্বিগ্ন করে। কোনো শব্দ হয়তো একজন উপভোগ করেন, আরেকজন হয়তো সেটিকে বিরক্তিকর শব্দ হিসেবে শোনে। কোনো একটি কাপড় বা বিছানার চাদরকে একজন স্বস্তিদায়ক মনে করেন; আরেকজন সেটিকে চুলকানি ও অস্বস্তিকর মনে করেন। এখন প্রশ্ন হলো গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তি কি তার চারপাশ সম্পর্কে এভাবে সচেতন থাকেন?
গবেষণা বলছে, হ্যাঁ। তাদের আরোগ্য ও অভিজ্ঞতার প্রশ্নে এসব অনুভূতি জোরালোভাবে কাজ করে। হাসপাতালের চারপাশের শব্দ, পাশের গাছে পাখিদের ডাক, রোগীর স্বজনদের কথাবার্তার আওয়াজ, বিভিন্ন চিকিৎসা যন্ত্রপাতি উৎসারিত শব্দ; হাসপাতালে ব্যবহৃত বিভিন্ন ওষুধ ও পরিষ্কারকারী উপকরণের গন্ধ, রোগীর খাবার, উচ্ছিষ্ট ও মলমূত্রের গন্ধ; হাসপাতালের দেয়ালে রং, সাজসজ্জা, চেয়ার, টেবিল ও বিছানার বিন্যাস, মানুষের চলাফেরা, ডাক্তার ও নার্সের পোশাক-পরিচ্ছদ; ডাক্তর-নার্স ও অন্যান্য সেবাকর্মীদের আরোগ্যকারী স্পর্শ, দর্শনার্থীদের স্পর্শ; বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ও খাবারের স্বাদ হাসপাতালে রোগী ও তার স্বজনদের আরোগ্য ও অভিজ্ঞতাকে স্পর্শ করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে হাসপাতালের নির্মিত আবহ রোগীর চাহিদা ও আরোগ্যের সঙ্গে জোরালভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই সম্পর্কটি ত্রিমাত্রিক— স্থানিক, আবহ ও প্রয়োজনীয়তা। হাসপাতালে আলো, মেঝে, শব্দের গুণমান, দৃশ্যমান, অভ্যন্তরীণ গুণমান এবং প্রবেশযোগ্যতা ইত্যাদি রোগীর চাহিদা, সন্তুষ্টি ও আরোগ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ঘরের ডিজাইন করার সময় দেয়ালে রঙের ব্যবহার, ফিনিশিং উপকরণ ও আসবাবপত্রের মতো উপকরণগুলো আরোগ্যকারী আবহ তৈরি করে। শুধু তাই নয়, প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান, সবুজ গাছপালা, পানি পড়ার শব্দ, পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ রোগীর দুশ্চিন্তা, হাইপারটেনশন ও হার্টবিটের হার কমাতে ভূমিকা পালন করে।