এবার ট্রাম্প বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেনে। ওই ফল পরিমাণে ও বিষে যে আরও বেশি হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাইডেন-কমলা জুটি ট্রাম্পের জন্য ওই পথ প্রশস্ত করে গেছেন।
Published : 29 Nov 2024, 04:28 PM
গত চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন-কমলা জুটির শাসনামলে তাদের কাউকে নিয়ে কিছু লেখার উৎসাহ অনুভব করিনি। কিন্তু ডনাল্ড জে ট্রাম্প বক্সিং রিংয়ে প্রবেশ করতেই লিখতে উৎসাহিত হয়েছি। এই হচ্ছে ট্রাম্পের ক্ষমতা। সাধারণ মানুষকে তিনি নাড়া দিতে পারেন। ট্রাম্পিয়ান বৃক্ষে ফলের শেষ নেই— কবিতা থেকে শুরু করে আনন্দ সবই জন্মায়। হ্যাঁ, ট্রাম্প যে কাব্যপ্রেরণার উৎস এ সত্য ২০১৭-তেই প্রমাণিত। ওই বছর খ্যাতিমান সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিস্টোফের উদ্যোগে আমেরিকায় একটি ‘ট্রাম্প কবিতা প্রতিযোগিতা’ আয়োজিত হয়েছিল। ক্রিস্টোফ নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি লেখায় (ট্রাম্প ইজ ইনসপিরেশনাল ... ফর পোয়েট্রি, ২১ অক্টোবর ২০১৭) ওই স্মৃতিচারণ করেছিলেন। অতএব দেখা যাচ্ছে এক অন্যতম ট্রাম্পবিরোধী সাংবাদিকের কথাতেই, তার লেখার শিরোনামেই— ট্রাম্প কবিতার জন্য প্রেরণা।
না, প্রতিযোগিতায় যে ২,৭৫০টি কবিতা জমা পড়েছিল তার সবগুলোতেই কিন্তু তাকে নিয়ে বিদ্রুপ ও ক্ষোভের প্রকাশ ছিল না, ছিল কাব্যিক প্রশংসাও। একটি কবিতার শিরোনামই তো— কে বলেছে ট্রাম্প ও কবিতা একসঙ্গে যায় না? (হু সেইজ ট্রাম্প অ্যান্ড পোয়েট্রি আর ইনকমপিটিবল?) কথাটা আমি নিজে একবার বলেছিলাম বৈকি, কিন্তু সেটাই কি তার কানে গেছে? কী করে গেল ওই গভীর রহস্যের জট আমি আজও খুলতে পারিনি। (এটি আমার এক ট্রাম্পিয়ান দাবি) ওই নারী আইনজীবী তার কবিতায় আমাদের সুকান্তকে উলটে দিয়ে বলেছেন, ‘গদ্যের ব্যর্থতার পর হয়তো কেবল কবিতাই, সাহসী ও শক্তিমান এমন ট্রাম্পিয়ান সময়ে।’
আমি না হয় এক পাতা গদ্যই লিখলাম এই ট্রাম্পিয়ান সময়ে। যদিও এরকম সময় মূলত কবিতারই— বলছেন নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি লন্ডনের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক ওরলান্ডো রিড তার সাম্প্রতিক এক লেখায়— জন মিল্টন’স প্যারাডাইস লস্ট মোরনড এ রেভোলুশন বিট্রেইড। (জ্যাকোবিন সাময়িকী, ২৫ নভেম্বর ২০২৪) বের্টোল্ট ব্রেখটের ১৯৩৯ সালের একটি কাব্যিক কথাকে উদ্ধৃত করেছেন তিনি: “অন্ধকার সময়ে/ আর কী গান হবে?” উত্তর, “হ্যাঁ, তখনও গান হবে/ অন্ধকার সময় নিয়ে।” এরপর রিড লিখেছেন, “রাজনৈতিক ব্যর্থতার কালে কবিতা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে? ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম শাসনামলে এই প্রশ্নটা নিয়ে আমি প্রায়ই ভেবেছি, যে আমল এখন আবার হাজির হয়েছে। মানুষের তখন সাধারণ কথা ছিল, আমরা একটা অন্ধকার সময়ে বাস করছি। সন্দেহ নেই এখন আবার আগামী মাস ও বছরগুলোয় সবাইকে সেইরকম সময়ে বাস করতে হবে।”
ট্রাম্পিয়ান বৈশিষ্ট্য সমাজে ও দেশে এক বিশেষ রাজনৈতিক-আদর্শিক সময়কে নির্দেশ করে। ট্রাম্পের নামে হলেও এটি ট্রাম্পোত্তীর্ণ। এটি এক বৈশ্বিক ঝোঁক যা ডানপন্থী শক্তি ও আদর্শের আধিপত্য নিশ্চিত করে। এটি সংকীর্ণ গোষ্ঠীবাদ, জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, যুদ্ধবাজি, ধর্মান্ধতা, বিভক্তি ইত্যাদির রাজনৈতিক অপব্যবহার করে ও করছে। এটি বাস্তবতা ও অবাস্তবতা এবং সত্য-মিথ্যার বিভাজনকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে তোলে। কেবল তাই নয়, এর একটি অরওয়েলিয়ান মাত্রা আছে যাতে করে সত্য ও মিথ্যার সম্পূর্ণ রূপান্তর অর্থাৎ সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করা সম্ভব— যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশে এখন যা হচ্ছে। সকল সাল ডিলিট হয়ে এখন কেবল একটি সাল অস্তিত্বমান হচ্ছে— ‘১৯৮৪’। আর জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’-এর রাষ্ট্রচরিত্র ও বিগ ব্রাদারের ক্ষমতায় আরোহণ।
তবে নাইনটিন এইটি ফোরের চেয়েও উদ্ভট সময় এটি। এ হলো তথ্যবিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ। সবই বাটন টিপে হয়! চোখের পলকে দিনকে রাত ও রাতকে দিন, জীবিতকে মৃত ও মৃতকে জীবিত, খুনীকে সাধু ও সাধুকে খুনী, অবনতিকে উন্নতি ও উন্নতিকে অবনতি— সবই বানানো যায়। ট্রাম্প নিজেও এই ট্রাম্পিয়ান সময়ের এক প্রোডাক্ট, ট্রাম্পিয়ান বৃক্ষেরই একটি ফল মাত্র। তার অন্য সতীর্থরা হলেন নরেন্দ্র মোদী, বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, ভ্লাদিমির পুতিন প্রমুখ।
ট্রাম্পের সঙ্গে এদের মিল জেনেটিক পর্যায়ের বললেও অতিরঞ্জন হবে না। জ্যাকোবিনে রিচার্ড সিলভারস্টেইন তার লেখায় (ট্রাম্প ২.০ মিনস মোর পেইন ইন দ্য মিডল ইস্ট, ২৭ নভেম্বর ২০২৪) ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর এই মিলের কথা স্পষ্ট করে বলেছেন, “ইসরায়েলি নেতার সঙ্গে ট্রাম্পের মিল ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যে ও রাজনৈতিক আদর্শে। উভয়েই অসুস্থ আত্মকামী যারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থকেই জাতির স্বার্থ বলে মনে করেন। উভয়ই কর্তৃত্ববাদী যারা সর্বত্রই শত্রু দেখতে পান। উভয়েই নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে গণতন্ত্র ধ্বংস করতে প্রস্তুত।” লেখাটির আরেক জায়গায় বলেছেন, “ডনাল্ড ট্রাম্পের ও বিবি নেতানিয়াহুর রাজনীতি ও মনমেজাজ তাদেরকে জোড়মানিকে পরিণত করেছে।”
সব ট্রাম্পিয়ানেরই এই একই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। মোদী ও পুতিন ছাড়াও আরও অনেক ট্রাম্পিয়ান আছেন যারা কেউ ইতোমধ্যে ক্ষমতায়, কেউ ক্ষমতার দোরগোড়ায়, কেউ লাইনে আছেন আর কেউ ক্ষমতা থেকে বহু ক্রোশ দূরে যে ব্যবধান ঘোচার সম্ভাবনা নেই। এই ট্রাম্পগোষ্ঠীর ভূমিকা সারা বিশ্বকে বিপদসংকুল করে তুলেছে। ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসায় তারা এবার দ্বিগুণ শক্তি অর্জন করল।
ট্রাম্পিয়ান বৃক্ষের তিতা ফল গতবারই মানুষ অনেক ভোগ করেছিল। এরমধ্যে কয়েকটি: ২০১৭-এর ৬ ডিসেম্বর ফিলিস্তিনিদের আকাঙ্ক্ষা পায়ে দলে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা, যে ইরান পারমাণবিক চুক্তি ছিল বারাক ওবামার এক অনন্য অর্জন ২০১৮ সালের মে মাসে ট্রাম্পের ঘোষণায় তা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা, ২০২০-এর ৩ জানুয়ারি ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানি সামরিক নেতা কাসেম সুলেমানিকে হত্যা, ২০১৭-এ প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে এসে উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক ঐক্যে ফাটল তৈরি, ২০২১-এর ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে ক্যাপিটল প্রাসাদে কংগ্রেস অধিবেশনে আক্রমণ করে বাইডেনের ক্ষমতায় আরোহণকে বানচাল করার চেষ্টা ইত্যাদি।
তো এবার ট্রাম্প বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেনে। ওই ফল পরিমাণে ও বিষে যে আরও বেশি হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাইডেন-কমলা জুটি ট্রাম্পের জন্য ওই পথ প্রশস্ত করে গেছেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে তারা অক্ষরে অক্ষরে ট্রাম্পের পদাঙ্ক অনুসরণ করে গেছেন। অতএব ট্রাম্পের দরকার হবে শুধু সেই পলিসিই আরও সম্প্রসারিত করে বাস্তবায়ন করা। তার সকল হিংসাত্মক মধ্যপ্রাচ্য নীতি বিশেষ করে ফিলিস্তিন ও ইরানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড আরও বাড়ানো যাবে চলমান বাইডেন পলিসির নামেই। অতএব শান্তির দূত হিসেবে তার তকমা অক্ষতই থাকবে।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এভাবেই তাদের সবরকম বর্তমান নীতি ও পদক্ষেপ দ্বারা ট্রাম্পকে আরও শক্তিশালী করে দিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্পের এই দ্বিতীয় আগমনে মনে হচ্ছে মার্ক্সের প্রথম কথা ঠিক যে, ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয়। কিন্তু প্রথমবার ট্র্যাজেডি ও দ্বিতীয়বার প্রহসনে পরিণত হয় কিনা তা দেখবার বিষয়। ট্রাম্পের এই দ্বিতীয় আগমন নিয়ে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক ম্যাট কার্প জ্যাকোবিনে (ইটস হ্যাপেনিং অ্যাগেইন, ৬ নভেম্বর) লিখেছেন, “বেশিরভাগ দ্বিতীয় মেয়াদের মত এর সমাপ্তি হওয়ার সম্ভাবনা সমর্থকদের হতাশায়, অজনপ্রিয় সব পদক্ষেপ গ্রহণের অপচয়ে, নিন্দার রটনায়, গলফের মাঠে সময় কাটানোর মাঝে। কিন্তু ডেমোক্র্যাটরা যদি শ্রমজীবী ভোটারদের বড় অংশকে জয় করতে না পারে, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ট্রাম্পের উত্তরসূরীরাই সুবিধাভোগ করবে।”
এখন কেবল ভরসা— ট্রাম্পের এই দারুণ প্রত্যাবর্তন প্রহসনে না হলেও অন্তত কমেডিতে পরিণত হোক। লোক হাসানোর ও কবিতা লেখায় অনুপ্রেরণা যোগানের সে ক্ষমতা ট্রাম্পের আছে বৈকি! যখন ‘অদ্ভূত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ’ তখনও কবিতা ও গান হোক, ব্রেখটের বা জীবনানন্দ দাশের মত হোক অন্ধকার নিয়েই।