সংবিধানকে একটা জাতির সবচেয়ে পবিত্র দলিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংবিধান নামক বইতে কতকগুলি সুন্দর, প্রাঞ্জল ভাষা, কতকগুলি সুন্দর সুন্দর শব্দের বিন্যাস ঘটালেই তার ওপর সংবিধানের উৎকর্ষ নির্ভর করে না। তা নির্ভর করে এর প্রয়োগের ওপর।
Published : 29 Jul 2024, 08:45 AM
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সঙ্গে যার নাম উচ্চারিত হয়, তিনি তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীই ছিলেন না, বরং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নতুন রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিরও সদস্য ছিলেন।
১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর সংবিধান বিল তথা খসড়া সংবিধানের ওপর তিনি যে দীর্ঘ ভাষণ দেন, সেখানে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার রাশ টেনে ধরার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বলেন, ‘সংবিধানে আমরা এমন ব্যবস্থা রাখতে চাই যে, জনপ্রতিনিধি বা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বা যাঁরা শাসনতন্ত্র পরিচালনা করবেন, তাঁদের দ্বারা সাধারণ মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে, এমন ক্ষমতা যেন তাঁদের কখনো না থাকে।’ তিনি বলেন, ‘সংবিধানে যেন এমন কোনো ব্যবস্থা আমরা না করি, যে ব্যবস্থায় কোনো অন্যায়, কোনো শোষণ থাকতে পারে।’
বাংলাদেশর সংবিধানে ‘নির্ভেজাল গণতন্ত্রের’ ব্যবস্থা করা হয়েছে উল্লেখ করে তাজউদ্দীন বলেন, ‘মানুষ যাতে নির্দিষ্ট সময়ে সঠিকভাবে তাদের নির্বাচকমণ্ডলির দ্বারা কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে নির্বাচিত হতে পারে, তার বিধান রাখা হয়েছে এই সংবিধানে। সেটা যাতে বাস্তবে রূপায়িত হয়, তার জন্য প্রত্যেক মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব পালন করতে হবে।’ (ব্যারিস্টার মো. আব্দুল হালিম, বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্ক, সিসিবি ফাউন্ডেশন/২০১৪, পৃ. ৪২৬)।
জন্ম, বেড়ে ওঠা ও রাজনীতি
তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই। গাজীপুরের কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে। বাবার নাম মুহাম্মদ ইয়াসিন খান। মাতা মেহেরুন্নেসা খানম।
তাজউদ্দিন আহমদ ১৯৪৪ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৪৮ সালে আই.এ এবং ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন এবং ঢাকায় আইনব্যবসা শুরু করেন।
ছাত্রজীবনেই তাজউদ্দিন আহমদ সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত হন। ১৯৪৩ সাল থেকে তিনি মুসলিম লীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তবে মুসলিম লীগ সরকারের গণবিচ্ছিন্ন রাজনীতির প্রতিবাদে তিনি এ দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের (১৯৪৯) অন্যতম উদ্যোক্তা। তিনি ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ববাংলা ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে তিনি ভাষা আন্দোলনকালে গ্রেপ্তার হন এবং কারা নির্যাতন ভোগ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য এবং ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন এবং পরে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদ নির্বাচনে তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা সদর উত্তর-পূর্ব আসন থেকে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ফকির সাহাবউদ্দীন আহমদের চাচা মুসলিম লীগ প্রার্থী ফকির আব্দুল মান্নান। তাজউদ্দীন আহমদ পান ১৯ হাজার ৩৯ ভোট। ফকির আব্দুল মান্নান ৫ হাজার ৯৭২ ভোট পেয়ে পরাজিত হন।
১৯৬৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তিনি দলের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন। রাজনৈতিক বিরোধ নিরসনের লক্ষ্যে বিরোধী দল ও সরকারের মধ্যে আলোচনার জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ডাকা গোলটেবিল বৈঠকে (১৯৬৯) তিনি আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি ঢাকা-৫ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পরিষদ (জাতীয় পরিষদ ১০৮) সদস্য নির্বাচিত হন। এই আসনে মোট ভোটার ছিলেন ১ লাখ ৯১ হাজার ৮২। তিনি পান ৯২ হাজার ৮১৯ ভোট।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা-২০ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদ্য নির্বাচিত হন। এই আসনে মোট ভোটার ছিলেন ১ লাখ ৪ হাজার ৩৩৮। তিনি পান ৬২ হাজার ৭৬২ ভোট।
বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে তাজউদ্দীন আহমদ তার কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে ভারতে চলে যান। ১০ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে তিনি এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন এবং বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিবাহিনীর জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন: প্রথম বাজেট পেশ রেডিও-টিভিতে
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বীরের বেশে স্বদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। সংসদীয় শাসনব্যবস্থা চালু করে তিনি নিজেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে। ওই বছরের ১০ এপ্রিল যে গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয়, সেখানে একমাত্র কাজ ছিল নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়ন। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি শেষ হওয়া পর্যন্ত দেশ পরিচালনার জন্য একজন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা গঠনের প্রয়োজন ছিল। বঙ্গবন্ধু তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি তাজউদ্দীনকেই দিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালে জাতীয় সংসদ ছিল না। আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে গণপরিষদে বাজেট পেশ করা যায় না। ফলে বাংলাদেশে প্রথম বাজেট উপস্থাপিত হয়েছিল বেতার ও টেলিভিশনে। পরে সংবাদ সম্মেলনে যথারীতি এ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। আনিসুজ্জামান জানাচ্ছেন, বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই তাজউদ্দীন পারদর্শী ছিলেন। বাক্যগঠন ও শব্দপ্রয়োগে একটু খুঁতখুঁতেও ছিলেন। জুতসই শব্দ না পাওয়া পর্যন্ত কিংবা মনমতো বাক্য গঠন না হওয়া পর্যন্ত তিনি পরবর্তী বাক্যে যেতে চাইতেন না। বিষয় ও ভাষা উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর মনোযোগ ছিল সম্পূর্ণ। (আনিসুজ্জামান, বিপুলা পৃথিবী, প্রথমা/২০১৫, পৃ. ৬৩)।
গণপরিষদে তাজউদ্দীন
সংবিধান প্রণয়নের পুরো প্রক্রিয়ায় খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, কমিটির বৈঠকে মন্ত্রীদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক এবং কামারুজ্জামান খুব কম সময়ই আসতেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ আসতেন মাঝে মাঝে। তাজউদ্দীন যেদিন আসতেন, সেদিন আলোচনায় যোগ দিতেন সাগ্রহে।
গণপরিষদে সংবিধান বিল উত্থাপন করা হয় ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর। আর সংবিধান গৃহীত হয় ৪ নভেম্বর। এর চারদিন আগে ৩০ অক্টোবর সংবিধান বিলের ওপর দীর্ঘ বক্তব্য দেন তাজউদ্দীন আহমদ—যেখানে তিনি মৌলিক অধিকার, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রসহ নানা বিষয়ের ব্যাখ্যা দেন এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য এই সংবিধান কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে আলোকপাত করেন।
সংবিধানকে একটা জাতির সবচেয়ে পবিত্র দলিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংবিধান নামক বইতে কতকগুলি সুন্দর, প্রাঞ্জল ভাষা, কতকগুলি সুন্দর সুন্দর শব্দের বিন্যাস ঘটালেই তার ওপর সংবিধানের উৎকর্ষ নির্ভর করে না। তা নির্ভর করে এর প্রয়োগের ওপর। সেই প্রয়োগ যদি সাচ্চা জনপ্রতিনিধিদের হাতে থাকে, তাহলে অপপ্রয়োগ কোনোদিন হবে না। (গণপরিষদ বির্তক, পৃ. ৪২৫)।
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সমবায়ে জোর
তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আগে সমাজতন্ত্রের কথা মানুষ পরিষ্কারভাবে বুঝত না। যারা সমাজতন্ত্রের বিরোধী ছিল, তারা মানুষের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করত। সমাজতন্ত্রকে ধর্মের সঙ্গে জড়িত করে সমাজতন্ত্রের কথা বললে তাকে ধর্মবিরোধী বলে আখ্যায়িত করা হত এবং মানুষের এক অংশকে এ ব্যাপারে দায়ী করা যেত। কিন্তু এই সংবিধান পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে সমাজতন্ত্র কী? তবে তিনি এও বলেন যে, মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত, প্রত্যেকটি মানুষ সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত কেবল আইন লিখে সুষ্ঠুভাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা সকল দেশেই এক উল্লেখ করে তাজউদ্দীন বলেন, উৎপাদন-যন্ত্র এবং উৎপাদন-ব্যবস্থায় ভূমিসহ সব কিছুর মালিকানা রাষ্ট্রায়ত্ত নয়। আমি বলব সমাজের আয়ত্তে, সমাজের মালিকানাধীন থাকবে। এটাই সমাজতন্ত্রের সঠিক সংজ্ঞা। তিনি বলেন, সব রাষ্ট্র আজও ভূমি রাষ্ট্রায়ত্ত করতে পারেনি। আজকে পূর্ব জার্মানির দিকে তাকিয়ে দেখুন। তারা বিপ্লবের পরে একশো হেক্টরের উপর জমি বাজেয়াপ্ত করেছে বিনা ক্ষতিপূরণে। তারা একশো হেক্টর পর্যন্ত জমি কৃষকের হাতে রেখে দিয়েছে এবং একশো হেক্টরের উপরে ভূস্বামীর যে জমি ছিল, তা বাজেয়াপ্ত করে কৃষকদের মধ্যে বিলি করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে জমি এত অল্প যে, মাথা প্রতি ভাগ করে দিলে আধা বিঘা করেও পাবে কি না, সন্দেহ। কাজে কাজেই আমাদের দেশের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ হবে। তাই এখানে যে সমবায়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছে, সেই সমবায়-পদ্ধতিতে ভূমি একত্র করতে হবে।
তাজউদ্দীন বলেন, ‘ব্যক্তিগত মালিকানা আজও আমরা উচ্ছেদ করতে পারছি না। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা বা আমাদের পরবর্তীকালে আমাদের নির্বাচকমণ্ডলী যদি দাবি করে যে, উচ্ছেদ করতে হবে, তাহলে নিশ্চয়ই তা করা হবে। কিন্তু আজকে এখানে বসে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে, এই পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে ভবিষ্যৎ বংশধরদের উপর কোনোরূপ ব্যবস্থা সুনির্দিষ্ট করে চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে না।’ (গণপরিষদ বিতর্ক, পৃ, ৪৩২)
ইতিহাসের ট্র্যাজিক হিরো
শেষদিকে দেশের রাজনীতি নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। যদিও এর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আরও আগে থেকেই। আনিসুজ্জামান জানাচ্ছেন, সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে তিনি গিয়েছিলেন তাজউদ্দীনের কাছে। তখন আনিসুজ্জামানকে তিনি জানিয়েছেন যে, অক্টোবরে দেশে ফিরে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করবেন। মূলত দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্পকালের মধ্যেই তিনি হতাশা ব্যক্ত করতে শুরু করেছিলেন। প্রশাসনের বিষয়ে কিছু হতাশা ছিল, তবে রাজনৈতিক কারণেই তাঁর হতাশা ছিল বেশি। (বিপুলা পৃথিবী, পৃ. ১১৮)।
একই কথা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর আরেক ঘনিষ্ঠ সহচর এবং সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন। স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, ‘তাজউদ্দীন ভাই আমাদের বললেন, একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা শুনে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন এবং তাঁর মনে হচ্ছে এটা দেশকে এক ভয়ংকর পথে নিয়ে যাবে।…১৯৭৪ সালের অক্টোবরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার কয়েক দিন পরই আমি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে একটি টেলিফোন বার্তা পেলাম যে তাজউদ্দীন পদত্যাগ করেছেন। আমি বঙ্গবন্ধুর অফিসে ছুটে গেলাম এবং মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীনের চলে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলাম। মনে হলো, এ ঘটনা তাঁদের (বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন) ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের যবনিকা টেনে দিলো। (কামাল হোসেন, বাংলাদেশ: স্বাধীনতা ও ন্যায়ের সন্ধানে, প্রথমা/২০২০, পৃ. ১৩)।
তবে তাজউদ্দীন আহমদ যে বেশিদিন মন্ত্রিসভায় থাকতে পারবেন না, সেই ধারণা ছিল তার স্ত্রীরও। তার মেয়ে শারমিন আহমদ লিখেছেন, ‘আম্মার অন্তর্জ্ঞান ছিল প্রখর। বাহাত্তর সাল থেকেই আব্বুকে বলতেন যে, আব্বু মন্ত্রিসভায় বেশিদিন টিকতে পারবেন না, তাঁকে কাজ করতে দেওয়া হবে না।’
শারমিন আহমদের ভাষায়, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল আব্বু ও মুজিব কাকুর বিচ্ছেদ। আর এই দুজনের বিচ্ছেদের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন যে খন্দকার মোশতাক সেটিও জানাচ্ছেন তাজউদ্দীনের মেয়ে। লিখেছেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তান ও সিআইএর প্রতিনিধি মোশতাক ও তার অনুচরদের লক্ষ্য ছিল ত্রিমাত্রিক। এক. আব্বু ও মুজিব কাকুর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা; দুই. মুজিব কাকুর ভুল প্ল্যান পলিসিকে সমর্থন করা; তিন. মুজিব কাকুসহ স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা। আব্বুর সাথে মুজিব কাকুর ভাঙন ধরানোটা ছিল খুব সম্ভবত মোশতাকের প্রথম লক্ষ্য। কারণ মোশতাক জানতেন যে আব্বু ছিলেন মুজিব কাকুর বর্মস্বরূপ। তাঁরা এক থাকলে বাকি দুই লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভবপর নয়। মুজিব কাকুকে আব্বুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার কাজে তিনি (মোশতাক) ব্যবহার করেছিলেন শেখ মনিসহ মুজিব কাকুর কিছু নিকট আত্মীয়স্বজনদের। (শারমিন আহমদ, নেতা ও পিতা, ঐতিহ্য/২০১৪, পৃ. ১৯৫)।
বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীনের এই সম্পর্কচ্ছেদ বা ভাঙনকে বাংলাদেশের জন্য একটি ‘বড় দুর্ভাগ্য’ বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ডেপুটি চেয়ারম্যান, খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামও। লিখেছেন, ‘এটা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, মন্ত্রিসভায় তাঁকে (তাজউদ্দীন) অপছন্দ করতেন এমন কয়েকজন শেখ মুজিব ও তাঁর মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরাতে অবিশ্বাসের বীজ রোপণ করেছেন। তাদের কয়েকজন প্রবাসী সরকারের সদস্য ছিলেন এবং তারা তখন থেকেই তাজউদ্দীনের বিরোধিতা করতেন। ১৯৭১ সালের আগে তার ওপর শেখ মুজিবের যে আস্থা ছিল সেটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তাজউদ্দীন খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মতানৈক্য ও অসন্তুষ্টির ব্যাপারে অনেক সময় তাজউদ্দীন প্রকাশ্যে বলতেন এবং এ ব্যাপারে খুব সাবধানী ছিলেন না।’ (নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ: জাতি গঠনকালে এক অর্থনীতিবিদের কিছু কথা, ইউপিএল/২০০৭, পৃ. ১০০)।
স্মৃতিকথায় নুরুল ইসলাম জানাচ্ছেন, ১৯৭৪ সালের শেষদিকে একদিন তিনি তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করতে যান। সাক্ষাৎকালে তারা ব্যক্তিগত ও দেশের সমস্যা সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করেন। এই আলোচনার পুরো সময়টাতে তাজউদ্দীনকে হতাশাগ্রস্ত মনে হয়েছিল। নুরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ও পরে আমি অনেক ঘনিষ্ঠভাবে তাজউদ্দীনের সঙ্গে কাজ করেছি। তিনি শুধু একজন মহান দেশপ্রেমিকই ছিলেন না, আমার দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন মন্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে দৃঢ়সংকল্প, বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন, যোগ্য এবং অত্যন্ত পরিশ্রমী।’
শারমিন আহমদ জানাচ্ছেন, ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসেই তাজউদ্দীন টের পেয়েছিলেন যে বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর একটি অংশ তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে—এমন খবরও তাজউদ্দীন জেনে গিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় জুলাই মাসের একদিন রাত ১১টার দিকে গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরেই তিনি হেঁটে সোজা চলে যান বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। বঙ্গবন্ধুকে এই ষড়যন্ত্রের কথা জানিয়ে তিনি অবিলম্বে সেনাবাহিনী, বিশেষ করে তার গোয়েন্দা বাহিনীর ওপর নজর দেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই সতর্কবাণীকে গুরুত্ব দেননি। ১৫ অগাস্ট তার মৃত্যুর সংবাদ শোনার পরে তাজউদ্দীন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু জেনে গেলেন না কে ছিল তার প্রকৃত বন্ধু আর কে শত্রু। (নেতা ও পিতা, পৃ. ২১৩)।
‘ধরে নাও চিরদিনের জন্য যাচ্ছি’
১৫ অগাস্ট ১৯৭৫। সকাল সাড়ে ৯টা। সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য রাজধানীর সাতমসজিদ রোডে ৭৫১ নম্বর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। একজন অফিসার দ্রুত গতিতে দোতলার বারান্দায় উঠে এসে নিজেকে ক্যাপ্টেন শহীদ হিসেবে পরিচয় দিয়ে তাজউদ্দীনের স্ত্রীকে বললেন, এই মুহূর্ত থেকে আপনারা কেউ বাসার বাইরে যেতে পারবেন না। বাইরের কেউ বাসার ভেতরে আসতে পারবে না। এ সময় তাজউদ্দীন কিছুটা রেগে গিয়ে ওই অফিসারকে বললেন, ‘বলুন হাউস অ্যারেস্ট। আমাদের গৃহবন্দি করলেন।’ ক্যাপ্টেন শহীদ একটা চাকু চাইলেন। তার হাতে চাকু দেয়া মাত্রই তিনি টেলিফোনের তারটি দ্বিখণ্ডিত করলেন। এরপর টেলিফোন সেটটি নিয়ে নিচে নেমে গেলেন।
এর ঠিক এক সপ্তাহ পরে ২২ অগাস্ট শুক্রবার সকালে বাড়ির সামনে পুলিশের দুটি জিপ এসে থামে। একজন পুলিশ অফিসার বাড়ির ভেতরে ঢুকে তাজউদ্দীনকে বললেন, ‘স্যার আমাদের সঙ্গে আপনাকে যেতে হবে।’ তবে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে সেটি বললেন না। তাজউদ্দীন গোসল করে নাশতা খেয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন জামা-কাপড় নিতে হবে কি না। অফিসার বললেন, নিলে ভালো হয়। তাজউদ্দীন একটা ছোট সুটকেসে কিছু জামা-কাপড় গুছিয়ে নিলেন। সঙ্গে একটি কোরআন শরিফ ও কালো মলাটের ওপর সোনালি বর্ডার দেয়া একটা ডায়েরি—যেখানে তিনি লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালের কথা এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কীভাবে চলবে তার নির্দেশনা।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন, Take it forever (ধরে নাও চিরদিনের জন্য যাচ্ছি)। তাজউদ্দীনের এটিই শেষ যাওয়া। এরপর নভেম্বরের ৪ তারিখ রাত সাড়ে ১২টার দিকে এই বাড়িতে তিনি ফিরেছেন লাশ হয়ে। আগের দিন ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তিন সহকর্মী ও সহযোদ্ধা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানের সঙ্গে তাকেও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
কামারুজ্জামান বাদে বাকি তিনজনকে দাফন করা হয় রাজধানীর বনানী কবরস্থানে। কামারুজ্জামানকে দাফন করা হয় রাজশাহীতে পারিবারিক কবরস্থানে। যদিও কোনো জায়গাতেই আর্মি ও পুলিশের বাধায় পরিবারের কয়েকজন ছাড়া আর কাউকেই কবরস্থানের আশেপাশেও ভিড়তে দেয়া হয়নি।
শারমিন আহমদ লিখছেন, ‘যাঁরা আব্বুর সঙ্গে বনানী কবরস্থানে গেলেন, তাঁরাই বকুল গাছের নিচে আব্বুকে তাঁর শেষ শয্যায় শায়িত করলেন। বড় মামা সোহেলকে ডাকলেন। সোহেলের হাতে পড়লো তাঁর বাবার কবরের প্রথম মাটি।’